টিকাপ্রাপ্তি : জুলাইয়েও বিশ্ববিদ্যালয় খোলা নিয়ে অনিশ্চয়তা
চীন থেকে টিকা আনতে জোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছে সরকার। বলা হচ্ছে, চীনা টিকা পাওয়া গেলে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে দেয়া হবে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের। শিক্ষার্থীদের টিকাপ্রাপ্তির ওপরই নির্ভর করছে বিশ্ববিদ্যালয় খোলার বিষয়টি। সেক্ষেত্রে দুই ডোজ টিকা দেয়া শেষ করে আগামী দুই মাসেও দেশের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আবাসিক হল খোলা এবং সশরীরে ক্লাস-পরীক্ষা শুরু করা যাবে কি-না, সে বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কোনো কর্তৃপক্ষ নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারছে না।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চীনা টিকা নিয়ে বর্তমানে একধরনের জটিলতা দেখা দিয়েছে। দুই ধাপে চীনের তরফ থেকে বাংলাদেশকে ১১ লাখ টিকা উপহার দেয়া হলেও সম্ভাব্য চুক্তি বা বাণিজ্যিক লেনদেনের টিকাগুলো কখন আসবে নিশ্চিত নয়। এজন্য বসে না থেকে অন্য কোনো সহজলভ্য মাধ্যম থেকে টিকা সংগ্রহ করে যত দ্রুত সম্ভব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফিরিয়ে আনতে হবে শিক্ষার্থীদের।
যদিও কবে নাগাদ শিক্ষার্থীদের টিকাদান কর্মসূচি শুরু হবে সে বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্ট কোনো কর্তৃপক্ষ নিশ্চিতভাবে কিছু বলতে পারছে না। তারা আশা করছেন, দ্রুতই শিক্ষার্থীদের টিকাদান শুরু হবে। এরপর খোলা হবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো।
অবশ্য বেশ কিছুদিন ধরেই শিক্ষা মন্ত্রণালয় বলে আসছে, সব শিক্ষার্থীকে টিকা দিয়ে আবাসিক হলে ফেরানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে তারা।
সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেন, ‘চীন থেকে ছয় লাখ ডোজ টিকা আসছে। আবাসিক শিক্ষার্থীদের অগ্রাধিকার দিয়ে সব শিক্ষার্থীর টিকা নিশ্চিত করা হবে। তারপর আবাসিক হল খুলে দেয়া হবে।’
চীনের ওই ছয় লাখ ডোজ টিকা আসছে রোববার। এ টিকার দুই ডোজ প্রয়োগ সম্পন্ন করে অপেক্ষা করতে হবে অ্যান্টিবডি তৈরি হওয়া পর্যন্ত। এক্ষেত্রে সাধারণত ২৮ দিন সময়ের প্রয়োজন হয়। সে হিসেবে সারাদেশের সব বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীকে টিকার আওতায় এনে আগামী জুলাইয়েও আবাসিক হলগুলো খোলা সম্ভব হবে না বলে ধারণা সংশ্লিষ্টদের।
গত ৩১ মে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে মন্ত্রিসভার ভার্চুয়াল বৈঠক শেষে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, ‘চীনের ভ্যাকসিন যদি চলে আসে, যেটা আমরা এখন পাওয়ার পথে, অ্যাগ্রিমেন্টের পথে। অ্যাগ্রিমেন্ট হওয়ার পর আশা করি, জুন মাসে ৫০ লাখ, জুলাইয়ে ৫০ লাখ এবং আগস্টে ৫০ লাখ ডোজ পেতে পারি। প্রথমদিকে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের সেই টিকা দেয়ার ব্যবস্থা আমরা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে করবো। শিক্ষকদের আমরা দিচ্ছি। আমরা চাই, ভ্যাকসিন নিয়ে তারা স্বাভাবিক লেখাপড়া শুরু করুক। এক বছর লেখাপড়ায় বিঘ্ন হয়েছে।’
বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের ভাষ্য
টিকার বিষয়ে সর্বশেষ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কী জানিয়েছে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়টির উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান জাগো নিউজকে বলেন, ‘এখন পর্যন্ত কিছু জানায়নি। কিছু হলে সাংবাদিকরা আগেই জানতে পারবেন। এটা আমাদের প্রসেসে নেই। এটা জাতীয়ভাবে হয়। ভ্যাকসিন ব্যবস্থাপনার প্রটোকল আছে।’
টিকার বিষয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার অধ্যাপক এস এম মনিরুল হাসান জাগো নিউজকে বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের তালিকা অনেক আগেই পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। টিকার উপযোগিতা অনুযায়ী সরকার শিক্ষার্থীদের টিকা দেবে। অথবা আমাদের কোনো নির্দেশনা দিলে সেভাবে কাজ করা হবে।’
এ বিষয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক ড. নূরুল আলম জাগো নিউজকে বলেন, ‘বেশ কিছুদিন আগে শিক্ষার্থীদের টিকা দেয়ার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন থেকে শিক্ষার্থীদের তালিকা চাওয়া হয়েছিল। আমরা আগ্রহী শিক্ষার্থীদের তথ্য নিয়ে তা সংশ্লিষ্টদের কাছে পাঠিয়েছি। অনেক শিক্ষার্থী এরই মধ্যে টিকা পেয়েছে। পরে আবারও সরকার থেকে টিকার জন্য বলা হলে আমরা পদক্ষেপ নেব। শিক্ষার্থীদের সুরক্ষার জন্য যা যা করা দরকার করব। তবে বিশ্ববিদ্যালয় খোলার সিদ্ধান্ত সরকারের ওপর নির্ভরশীল।’
আবাসিক হল খোলার বিষয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ড. রবিউল হাসান ভূঁইয়া বলেন, ‘ইউজিসির সঙ্গে যোগাযোগ করে আমরা জেনেছি যে, আবাসিক শিক্ষার্থীদের টিকা দিয়ে তারপর হল খোলার চিন্তাভাবনা রয়েছে। টিকাদান সম্পন্ন করার পরই হয়তো আমরা হল খোলার তারিখ জানতে পারব। একটা আবাসিক হলে একজন আক্রান্ত হলে সব শিক্ষার্থীরই আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। পড়াশোনার জন্য হলে এনে শিক্ষার্থীদের ঝুঁকিতে ফেলে দেয়া কতটা যুক্তিসঙ্গত, সেটাও ভাবার বিষয়।’
যা বলছে ইউজিসি
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ম্যানেজমেন্ট বিভাগের পরিচালক (অতিরিক্ত দায়িত্ব) মো. জামিনুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, ‘টিকা নিয়ে আমাদের এখনো কোনো কিছু জানানো হয়নি এবং এরকম কোনো বিষয়ে আলোচনা হয়নি।’
ইউজিসির চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. কাজী শহিদুল্লাহ বলেন, ‘টিকার বিষয়টি মন্ত্রণালয় দেখছে। মিটিংয়ে আমি জোরালোভাবে বলেছি দ্রুত সময়ের মধ্যে টিকা দেয়ার ব্যবস্থা নিতে। তারা আমাদের আশ্বস্তও করেছে।’
‘স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় আমাদের আশ্বাস দিয়েছে ভ্যাকসিন এলে আমাদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে দেবে। আমার ধারণা, এটা (টিকাদান) দ্রুত শুরু হবে। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার অসুবিধা অনুভব করছে। প্রধানমন্ত্রী নিজেও চান শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া হোক। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকলে সবকিছু অসম্পূর্ণ থাকে। কারণ শিক্ষার সঙ্গে সবকিছু সংযুক্ত।’
চীনা টিকার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের একটি অগ্রাধিকার আছে। যদিও সিনোভ্যাকের কথা বলছিল কারণ সিনোভ্যাক দ্রুত আসার একটি সম্ভাবনা ছিল। এখন যেহেতু একটু জটিলতা তৈরি হয়েছে সেহেতু এখন যেটা সহজলভ্য থাকবে সেটি দিয়ে দ্রুত শুরু করতে হবে। বসে থাকলে হবে না আমাদের টিকা দিতে হবে।’
ইউজিসি চেয়ারম্যান আরও বলেন, ‘সিনোফার্মের টিকা না এলে আমরা বসে থাকতে পারব না। অন্য কোথাও থেকে টিকা আনলে সেটি দিয়ে দিতে হবে। আমাদের বসে থাকা যাবে না। সিনোফার্ম না এলেও আমাদের অন্য কোনো টিকা দেয়া হবে বলে আমার বিশ্বাস।’
ক্লাস শুরুর বিষয়ে অধ্যাপক শহীদুল্লাহ বলেন, ‘ক্লাস শুরু করতে হলে শুধু আবাসিক শিক্ষার্থীদের দিলে হবে না, অনাবাসিকদেরও দিতে হবে। কারণ আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসরুমে সেই পরিমাণ আসন নেই, যেখানে সামাজিক দূরত্ব মেনে বসা সম্ভব। টিকাদান শুরু হলে আবাসিক শিক্ষার্থীরা আগে টিকা পাবে। পরে অনাবাসিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা পাবে।’
শিক্ষাঙ্গন খোলার সম্ভাব্য সময়ের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘টিকাদান কর্মসূচি শুরু হলে আমরা দুটি ডোজ না নিয়ে শিক্ষার্থীদের ওঠাতে পারব না। টিকা স্বাস্থ্য ও সময়বিধি মেনে নিতে হবে।’
পরীক্ষার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘পরীক্ষা নিতে আমরা মানা করিনি। পরীক্ষার বিষয়ে নির্দিষ্ট সময় না থাকলে শিক্ষার্থীরাও পড়তে বসে না। প্রত্যেকটা বিশ্ববিদ্যালয় নিজ দায়িত্বে পরীক্ষা নেবে। আমরা এর দায় নিতে পারব না। কারণ তারা মাঠ পর্যায়ে দেখতে পাচ্ছে। তারা যদি মনে করে এখন নেয়া নিরাপদ তাহলে তারা নিতে পারবে।’
শিক্ষার্থীদের দাবি এবং হতাশা
টিকাপ্রাপ্তির এ অনিশ্চয়তা নিয়ে হতাশার কথা জানিয়েছেন শিক্ষার্থীরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের স্নাতক শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী রেজাউল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের পরীক্ষার তারিখ দিয়েছে। এখন হল বন্ধ। পরীক্ষা দেয়ার জন্য ঢাকায় আসতে হবে। ঢাকায় সবকিছুতেই খরচ। এই মুহূর্তে বাসাও তেমন খুঁজে পাচ্ছি না। মেসে থেকে স্নাতক শেষ বর্ষের মতো গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা দেয়া খুব কঠিন। আবাসিক শিক্ষার্থীরা এভাবে অভ্যস্ত না।’
ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী মনির হোসেন বলেন, ‘হল না খুলে পরীক্ষা নেয়ার বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন দায়সারা আচরণ করছে। এতে শিক্ষার্থীদের অনেক ভোগান্তির শিকার হতে হচ্ছে এবং হবে। বিশেষ করে নারী শিক্ষার্থীরা তাদের বাসা খুঁজতে গিয়ে অনেক হয়রানির শিকার হবেন। আমাদের দাবি, দ্রুত হল খুলে আমাদের পরীক্ষা নেয়া হোক।’
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী শাফিউল বাশার জাগো নিউজকে বলেন, ‘হল খুলে দিয়ে ক্লাস, পরীক্ষা স্বাভাবিকভাবে চালানো উচিত বলে মনে করি। সঙ্গে সঙ্গে দ্রুত শিক্ষার্থীদের টিকা দেয়ার ব্যবস্থা করা উচিত। টিকা না দিয়ে হল খুললে স্বাস্থ্যঝুঁকি থাকবে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, শিক্ষার্থীরা কি বাড়িতে স্বাস্থ্যবিধি মানছেন? স্বাভাবিকভাবেই তারা বাস, ট্রেন, লঞ্চ, হাট-বাজারসহ যাবতীয় দৈনন্দিন কাজকর্ম করছে। এদিকে, বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবনে বড় একটা ক্ষতি হচ্ছে।’
হল খোলার বিষয়ে ছাত্র ইউনিয়ন জাবি সংসদের সাধারণ সম্পাদক রাকিবুল রনি বলেন, ‘নানা জটিলতা ও টিকা স্বল্পতার কারণে এখনো অনেক শিক্ষার্থী টিকা নিতে পারেননি। দ্বিতীয় দফা রেজিস্ট্রেশনের সুযোগ দিয়ে বাদ পড়া শিক্ষার্থীদের ভ্যাকসিনেশনের আওতায় এনে দ্রুততম সময়ের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়কে সচল করার বিকল্প নেই। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যে পদ্ধতিতে অনলাইনে পরীক্ষা নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সেটি দীর্ঘমেয়াদে শিক্ষার্থীদের ক্যাম্পাস থেকে দূরে রাখবার পাঁয়তারা বলে মনে করছি। কারণ পরীক্ষা পদ্ধতি খুবই দীর্ঘসূত্রতার বলে জানতে পেরেছি।’
এসএস/এইচএ/এমএস