জোট রাজনীতি থেকে সরে যাচ্ছে বিএনপি?
ওয়ান-ইলেভেনের শাসকদের বিদায়ের পর ২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে শোচনীয় পরাজয় ঘটে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোটের। এরপর থেকে জোট রাজনীতি নিয়ে নতুন করে ভাবতে শুরু করে দলটি। চারদলীয় জোট সম্প্রসারণের মাধ্যমে ১৮ দলীয় জোট গঠন করে বিএনপি। অন্যদিকে ক্ষমতায় এসে নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বাতিল করে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার।
২০১৪ সালের নির্বাচনের পর জাতীয় পার্টি (কাজী জাফর) ও সাম্যবাদী দল (একাংশ) ১৮ দলীয় জোটে যোগ দিলে এটি ২০ দলে পরিণত হয়। কিন্তু জোট রাজনীতিতে তেমন কোনো ফল ঘরে তুলতে পারেনি বিএনপি, বরং অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই জোট তাদের জন্য যেন বোঝা হয়ে গেছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সার্বিক বিবেচনা করে আপাতত জোটবদ্ধ রাজনীতি নয়, এককভাবে চলতে চাইছে বিএনপি। দলটি চলছেও সেভাবে। ২০১৮ সালের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিএনপি যে স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষা নিয়ে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠন করেছিল, সেই স্বপ্ন পুরোটাই ভেস্তে গেছে। বরং এই ঐক্যফ্রন্ট করতে গিয়ে নিজেদের অস্তিত্বকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে ফেলেছে দলটি। অন্যদিকে বিএনপির দীর্ঘ সময়ের রাজনৈতিক বন্ধুরাও দূরে সরে গেছে। সেজন্য জোটবদ্ধ পথচলার ক্ষেত্রে এবার ভাবার সময় এসেছে।
‘একলা চলার’ পথ বেছে নিয়েই জোট থেকে বেরিয়ে আসছে বিএনপি
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির এক শীর্ষ নেতা বলেন, এ দলের জন্য জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ছিল আদর্শহীন জোট। আর তার মূলনেতা হয়ে গিয়েছিলেন ড. কামাল হোসেন। যার রাজনৈতিক জীবনের কোনো সফলতার কথা জানা নেই অনেকেরই। অন্যদিকে, বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট এখন শুধু কিছু ‘টোকাই’ আর ‘রাজনৈতিক বেপারীদের’ পুনর্বাসন কেন্দ্র।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, জোট থেকে শেখ শওকত হোসেন নিলুর (প্রয়াত) নেতৃত্বাধীন এনপিপি, মাওলানা আবদুল লতিফ নেজামীর (প্রয়াত) নেতৃত্বাধীন ইসলামী ঐক্যজোট, জেবেল রহমান গানির নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি-বাংলাদেশ ন্যাপ, খোন্দকার গোলাম মোর্ত্তজার নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টি-এনডিপি বের হয়ে গেলে সংখ্যাতত্ত্ব ঠিক রাখতে গিয়ে যাদের দিয়ে বিএনপি এই দলগুলোর পুনর্জন্ম দিয়েছে, তাদের নেতারা সবাই প্রশ্নবিদ্ধ। এমনকি রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে এক বিবৃতি লেখারও ক্ষমতা নেই তাদের। আবার কেউ মানবপাচারকারী, কেউ পাসপোর্ট জালিয়াতি চক্রের সদস্য। অন্যদিকে জোটের প্রধান দল বিএনপির সমালোচনা করায় তাদের পরোক্ষ মদদে কর্নেল (অব.) ড. অলি আহমদের লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি-এলডিপি, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি ও জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি-জাগপার মধ্যে যে ভাঙন হয়েছে, তাতে জোট আরও বেশি গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছে।
সবকিছু বিবেচনায় এককভাবেই পথ চলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি। দলটির নীতিনির্ধারকদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ইতোমধ্যে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টকে এড়িয়ে চলা শুরু করেছে বিএনপির দীর্ঘ সময়ের জোট ২০ দল ও বিগত জাতীয় নির্বাচনকালীন জোট। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন তারেক রহমান ইতোমধ্যে নীতিনির্ধারকদের এ সিদ্ধান্তে নিজের সম্মতিও জানিয়ে দিয়েছেন বলে একটি সূত্রে জানা গেছে।
অ্যাডভোকেট সৈয়দ এহসানুল হুদা। ফাইল ছবি
২০ দলীয় জোট শরিক দলের এক শীর্ষ নেতা বলেন, ‘অনেকদিন ধরেই জোটের কোনো কার্যক্রম নেই। নেই কোনো সমন্বয় বা বৈঠকও। অবশ্য বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) কারণেও অন্য সবকিছুর মতো রাজনীতিতে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। সে কারণে জোটের কোনো কর্মকাণ্ড নেই বলা হলেও প্রকৃত অর্থে বিএনপি এককভাবেই চলছে— এটা না বোঝার মতো বিষয় নয়।
তিনি আরও বলেন, ‘জোটের প্রধান দল বিএনপি। তারা যে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে। বিএনপি ডাকলে জোট শরিকরা হাজির হয়, না ডাকলে কোনো কথাও বলতে পারে না।’
বিএনপির বেশ কয়েকজন সিনিয়র নেতা বলেন, বহু আগেই জোট ছেড়ে নিজস্ব রাজনীতির দিকে মনোযোগ দেয়া উচিত ছিল বিএনপির। কারণ, বিএনপি দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় ও জনসমর্থিত রাজনৈতিক দল। জনগণের ভালোবাসা নিয়ে জিয়াউর রহমানের হাতে গড়া এ দল বারবার বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় এসেছে। তাই বিএনপিকে অন্যের সাহায্য নিয়ে দেশে রাজনীতি করতে হবে না। শুধু নিজেদের রাজনীতিটা করলেই জনগণের গ্রহণযোগ্যতা অতীতের মতো পাওয়া যাবে।
প্রায় অকার্যকর জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ও ২০ দলীয় জোট
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির এক ভাইস চেয়ারম্যান বলেন, বিএনপিকে ঘুরে দাঁড়াতে হলে ২০ দল ও ঐক্যফ্রন্টকে বাদ দিতে হবে। এছাড়া জোটের দলগুলো তো নেতাসর্বস্ব। বরং তাদের দল বিলুপ্ত করে দেয়া উচিত। তাদের না আছে জনবল, না আছে জনসমর্থন। দুই জোটের ওপর ভরসা করা নিজেদেরই ক্ষতি। তাই বিএনপিকে নিজের অবস্থান ধরে রাখতে হবে।
বিএনপি জোটের অন্যতম শরিক বাংলাদেশ জাতীয় দলের চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট সৈয়দ এহসানুল হুদা জাগো নিউজকে বলেন, ‘২০ দলীয় জোট কার্যত অচল। বেশকিছু দিন হয়ে গেল কোনো যৌক্তিক কারণ ছাড়াই জোটটি অকার্যকর করে রাখা হয়েছে। এটা জোটের সবচেয়ে বড় শরিক দল বিএনপির অনীহা বা রাজনৈতিক কৌশল হতে পারে। কিন্তু বিএনপির একলা চলো নীতি বর্তমানে তেমন কোনো দৃশ্যমান সফলতা অর্জন করেছে বলে আমি মনে করি না। যেখানে আজকে এই জালেম সরকারের পতনের জন্য একটি বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য দরকার, সে জায়গায় আমরা আজকে থমকে আছি।’
তিনি বলেন, ‘বিএনপি তার নিজস্ব গতিতে চলছে এবং জোটকে কার্যকর করার জন্য কোনো পদক্ষেপ এখন পর্যন্ত গ্রহণ করেনি। অদূর ভবিষ্যতেও তাদের জোট নিয়ে কোনো চিন্তা-ভাবনা আছে কি-না, সে ব্যাপারে আমাদের সঙ্গে কোনো আলাপ-আলোচনা করেনি। বর্তমানে আমরা লক্ষ্য করছি, জোটের কয়েকটি দল তাদের আদর্শের বাইরে গিয়েও কিছু দলের সঙ্গে রাজপথে আন্দোলনের চেষ্টা করছে। দুঃখের বিষয়, তারা বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তির জন্য কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিতে পারেনি। আমার কাছে এটাকে ডাবল স্ট্যান্ডার্ড (দ্বৈত নীতি) বলেই মনে হচ্ছে। এ ব্যাপারে জোটের বৈঠক অতি জরুরি এবং আমাদের যে অভিন্ন লক্ষ্য সে ব্যাপারে একটি জোরালো পদক্ষেপ নেয়া উচিত।’
আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী। ফাইল ছবি
বিএনপি জোটের কার্যক্রম দৃশ্যমান নয়, জোট রাজনীতি থেকে বিএনপি সরে যাচ্ছে কি-না, জানতে চাইলে দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘না। এখন তো আমাদের সবাই যুগপৎ, যার যার জায়গা থেকে কাজ করছি। জোটের কিছু না, সবাই একই পথে চলছি। সেটা তো মানুষ বোঝে না। জোট মানে সবাই মনে করে একত্রিত হতে হবে। একত্রিত, এক জায়গায় তো দরকার নেই। আমার পথ একটা হতে হবে। ওই পথে সবার চলতে হবে। যার যার অবস্থান থেকে একটা পথে চলতে হবে। তখন যেটা প্রয়োজন সেটা করা হবে। পথ একটাই। ওদিকে সবাই চলতে থাকবে; কেউ আগে, কেউ পিছে, কেউ ডানে, কেউ বামে চলতে চলতে যে প্রয়োজন হবে তখন দেখা যাবে। রাজনীতিতে আগেভাগে কিছু না, যখন যা প্রয়োজন তখন তাই করতে হবে।
জোট রাজনীতি থেকে বিএনপি সরে যাচ্ছে কি-না জানতে চাইলে ২০ দলীয় জোটের সমন্বয়কারী বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেন, ‘এমন কিছু আমাকে কেউ বলেনি। এখানে মন্তব্য করার কিছু নেই।’
কেএইচ/এমএসএইচ/এইচএ/এএসএম