পাকিস্তানিদের বর্বরতার কথা বিশ্বকে জানাতে চেয়েছিলাম
ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের রাজধানী আগরতলার প্রখ্যাত ফটো সাংবাদিক রবীন সেনগুপ্ত। একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশে অবস্থান করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বর্বরতার চিত্রধারণ করেছিলেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধে অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ রবীন সেনগুপ্ত বাংলাদেশ সরকারের কাছ থেকে পেয়েছেন ‘বন্ধু সম্মাননা’।
সম্প্রতি ৮৬ বছর বয়সী এই প্রবীন ফটো সাংবাদিক তার ক্যামেরার চোখে দেখা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে জাগো নিউজের সঙ্গে কথা বলেছেন।
জাগো নিউজের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, একাত্তরে তার বয়স ছিল প্রায় ৪০ বছর। তার বিয়ের মাত্র ৮ মাস পরই তিনি মুক্তিযুদ্ধ কাভার করতে বাংলাদেশ চলে আসেন। তবে অনেকেই তার বাবাকে বলেছিলেন মুক্তিযুদ্ধে যেতে বাধা দিতে। তখন তার বাবা বলেছিলেন ‘মুক্তিযুদ্ধে গিয়ে আমার ছেলে যদি শহীদ হয় তাহলে আমি নিজেকে একজন গর্বিত বাবা মনে করবো।
মুক্তিযুদ্ধের বর্ণণা দিয়ে রবীন সেনগুপ্ত বলেন, আগরতলায় তাদের ‘সেন অ্যান্ড সেন’ নামে একটি স্টুডিও ছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময় ক্যামেরার ফ্লিম শেষ হলে তিনি বাংলাদেশ থেকে আগরতলায় চলে আসতেন। সেখানে সবগুলো ফ্লিম ডেভেলাপ করে ইংরেজি ও বাংলায় ক্যাপশন লিখে তার ছোট দুই ভাই বিশু সেনগুপ্ত ও শম্ভু সেনগুপ্তকে বলে দিতেন কোনো সাংবাদিক এলে তাদের যেন বিনামূল্যে সেই ছবি দিয়ে দেয়া হয়।
তিনি বলেন, আমি চেয়েছিলাম সারাবিশ্ব জানুক বাংলাদেশে কি হচ্ছে। নিরস্ত্র বাঙালিদের উপর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী কীভাবে বর্বরোচিত হামলা চালিয়ে মানুষ মারছে। রক্ত ঝড়ার ছবি ও আগুনের ছবিতো আর সাদা কালোতে আসবে না, তাই সে ছবিগুলো আমি রঙ্গীন তুলেছিলাম। আমি লন্ডনের সংবাদপত্রেও ছবি পাঠিয়েছিলাম। বিশ্বের অনেক দেশ থেকে সাংবাদিক ও চিত্রগ্রাহকরা আমাদের এখানে এসে আখাউড়া সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশ গিয়েছে।
তিনি আরও বলেন, ৪-৫টি ক্যামেরা নিয়ে চিটাগাং থেকে ঢাকা পর্যন্ত পাগলের মতো ছুটেছি আমি। প্রধানত আমার মুক্তিবাহিনী বা গ্যারিলা বাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ ছিল। ৪ ডিসেম্বর আমাদের ইন্ডিয়ান আর্মি যখন জলে, স্থলে ও আকাশে যুগপদভাবে পাকিস্তানিদের উপর আক্রমণ করল তখন তারা (পাকিস্তানি) গণহত্যা চালিয়ে ঢাকার দিকে পালিয়ে যায়, যাওয়ার আগে তারা আশুগঞ্জ রেলব্রিজটি ডিনামাইট চার্জ করে উড়িয়ে দিয়ে যায়। তখন শিয়ালের পেছনে কুকুর যেমন ছুটে তেমনি আর্মিদের সঙ্গে আমরা সাংবাদিকরাও ছুটলাম তাদের পিছু পিছু। সেময় ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে জেলের ভেতর যাদের আটকে রাখা হয়েছিলো পালিয়ে যাওয়ার আগে পাকিস্তানি হানাদাররা তাদের হত্যা করে কুরুলিয়া খাল ও তিতাস নদীর পাড়ে লাশ ফেলে রেখে যায়। আমি তখন দুই নদীর পাশে দু`থেকে আড়াইশ লাশ পড়ে থাকতে দেখেছি। তবে সাংবাদিকরা যেন লাশের ছবি তুলতে না পারে সেজন্য পাকিস্তানিরা লাশের চারদিকে মাইন পেতে রেখেছিল। এর ফলে আমার ছবি তুলার জেদ চেপে গেল। সহকর্মীরা বার বার বলছিল, দাদা যাবেন না, যাবেন না। তবে আমাদের আর্মিরা শিখিয়েছিল মাইন পাতা থাকলে কিভাবে আমাদের মুভ করতে হবে। আমাদের বলা হয়েছিল যেখানে নরম জায়গা সেখানে পা না দিয়ে শক্ত জায়গায় পা দিতে হবে। এভাবে পা টিপে টিপে ৪/৫টা ছবি তুলে আমি আবার ফিরে আসি। আমি ফিরে আসার পর আমার সহকর্মীরা আমাকে ধরে কেঁদে বলল রবীন দা কি অসম সাহস নিয়ে আপনি ছবি তুলেছেন। চারদিকে শুধু লাশ আর লাশ। বিকৃত লাশগুলো থেকে পঁচা দুর্গন্ধ বের হচ্ছিল। ভৈরবেও ঠিক একই অবস্থ ছিল। নোয়াখালী, চট্টগ্রামে একই ভাবে শুধু লাশ আর লাশ চোখে পড়ে।
মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে একটা অপারেশন করেছিলাম কুমিল্লার কোম্পানিগঞ্জে। তখন সালদা নদীতে (বর্তমান কসবা উপজেলা) পাকবাহিনী একটি কনভয় রেশনের জন্য আখাউড়ায় যাচ্ছিল, যা দূরবিনের মাধ্যমে আমাদের চোখে পড়ে। সিদ্ধান্ত নিলাম এই কনভয়টাকে উড়িয়ে দিতে হবে। আমাদের ট্রেনিং ছিল গ্রেনেড চার্জ করতে সবুজ রঙের তার ব্যবহার করতে হবে। যাতে সবুজ ধানের সাথে সেটা মিশে যায়। তাছাড়া এসব কাজে কলাগাছের ঝোপ ব্যবহার করতাম। তখন একই সাথে ছবি তুলেছি আবার রাইফেল হাতে যুদ্ধও করেছি।
রবীন সেনগুপ্ত বলেন, পাকিস্তানিরা বেশিরভাগই মেয়েদের উপর অত্যাচার-নির্যাতন করতো। ৩ ডিসেম্বর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়ার কাছে ধরখারে মেয়েদের গোপনাঙ্গে বেয়নেট চার্জ করে বিভৎস্যভাবে হত্যা করা হয়েছে। বুকের বুটাগুলো কেটে ফেলা হয়েছিল। রক্তে চারিদিক লালে লাল হয়ে গেছে। কিন্তু আমি এই বিভৎস্য ছবি তুলতে পারিনি। কারণ এরাওতো আমার বোন।
তিনি বলেন, ১৬ ডিসেম্বর যখন পাকহানাদার বাহিনীরা আত্মসমর্পণের ঘোষণা দিল তখন আমিসহ বিদেশি সব সাংবাদিকরা আগরতলা সার্কিট হাউজে মিলিত হই। এরপর ঢাকার উদ্দেশ্যে আমরা কুমিল্লার বিবিরবাজার যাই। কিন্তু তখন খবর আসে ময়নামতি দিয়ে যাওয়া বিপদজনক হবে কারণ ওই এলাকায় পাক বাহিনীরা আত্মসমর্পণ করেনি। এর ফলে কনকনে শীতে আমরা ১৫ ডিসেম্বর রাত ১টার দিকে লঞ্চে করে চাঁদপুর গিয়ে পৌঁছালাম। এরপর আবার লঞ্চে করে আমরা ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। কিন্তু কিছুদূর যাওয়ার পরই লঞ্চের পাখা নষ্ট হয়ে গেল। তাই আমরা বললাম আলো জ্বেলে পাখা ঠিক করার জন্য। কিন্তু আলো জ্বালাতেই চারদিক থেকে আমাদের লঞ্চে গুলি বর্ষণ শুরু হলো। তখন ওই লঞ্চে বিদেশি সাংবাদিকসহ আমরা ২০-২৫ জন সাংবাদিক ছিলাম। আমাদের সঙ্গে অস্ত্র হাতে শার্ট ও লুঙ্গি পড়া বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাও ছিলেন। কিছুক্ষণ পর গুলি বন্ধ হলে আমরা জয় বাংলা পতাকা এবং ভারতীয় পতাকা উড়িয়ে মাইকে ঘোষণা দিয়ে বললাম যে আমরা পাক সৈন্য নই, আমরা সাংবাদিক। ঢাকায় যাচ্ছি পাক বাহিনীর আত্মসমর্পণ কাভার করতে। এরপর একটা জেলে নৌকায় করে আমাদের কয়েকজন সহযোগী আবার চাঁদপুর চলে গেল। পরে চাঁদপুর থেকে আরেকটি লঞ্চ এসে আমাদেরকে নিয়ে ঢাকায় পৌঁছাল। তবে ঢাকা পৌঁছাতে আমাদের ১৬ ডিসেম্বর সন্ধ্যা হয়ে গেল। তাই আমরা পাক বাহিনীর আত্মসমর্পণের ছবি তুলতে পারলাম না। পরদিন ১৭ ডিসেম্বর ভোরবেলা আমরা যখন হোটেলে বসে আছি তখন ইন্ডিয়ান আর্মির এক বিগ্রেডিয়ার এসে বললেন, we re setting here & gossiping go to the Rayarbazar, what happing, to see তখন আমাদের সেখানে নিয়ে গিয়েছিল হলিডে কাগজের সম্পাদক এনায়েতউল্লাহ খান (রাশেদ খান মেননের ভাই)। সেখানে গিয়ে দেখলাম চর্তুদিকে বিক্ষিপ্তভাবে লাশ পড়ে আছে। তখন আমি নিচে নেমে দেখি কারো হাত, পা আবার কারো চোখ বাঁধা। আমি লাশগুলো উল্টিয়ে উল্টিয়ে ছবি তুলি। আমরা সেখানে ঘণ্টা-চারেক অবস্থান করেছিলাম।
এরপর যখন বেগম মজিবের রিলিজের খবর পেলোম তখন সঙ্গে সঙ্গে আমরা ছুটে গিয়ে বেগম মুজিবের সঙ্গে কথা বলি। তখন বেগম মুজিবের কাছ জানতে চাইলাম ২৬ মার্চ রাতে আসলে কি ঘটেছিল ? তখন তিনি (বেগম মুজিব) ফরিদপুরী ভাষায় বললেন, তখন রাইত ১২টা। হঠাৎ আমি যেন শুনলাম জওয়ান পজিশন লও। আমি শেখ সাহেবরে কইলাম, বোজজ আমাগো বাড়ি দেহি মেলিটারিরা ঘিরা রাখছে। শেখ সাহেব কইল আরি আমি বঙ্গবন্ধু.........কি কউ। যাওয়ার সময় শেখ সাহেব কইল আমারে নিয়ে যায় যাক তোমরা এখানেই থাকবা না হয় ফরিদপুরের বাড়ি গিয়া থাকবা। আমি বেগম মুজিবকে আবারও প্রশ্ন করলাম, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের প্রতি আপনার কোনো ম্যাসেজ আছে কিনা ? তিনি বললেন, সেটা আর বলার কথা না। আজকে যদি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারত সহযোগিতা না করতো বাংলাদেশ কিছুতেই স্বাধীন হতো না। আর ভারতের মহান নেত্রী ইন্দিরা গান্ধি তাকে যে আমি কমু, সে আর বলার কথা না। ভারতের ঋণ বাংলাদেশ কোনোদিন শোধ করতে পারবে না। এপর ২৪ ডিসেম্বর তাজউদ্দিন এলো তেজগাঁ এয়ারপোর্টে, আমি এসব ছবি তুললাম। আর বাংলাদেশ রেডিওর সঙ্গে ছিল আমার আত্বিক সম্পর্ক। যুদ্ধের সময় জব্বার, আপেল এরা সব আমার আগরতলার বাড়িতে ছিল। তখন আমাদের টিনের ঘর ছিল। আমার বড় একটা টেপ রেকর্ডার ছিল। সেটাতে প্রথমে কুরআন পাঠ, ত্রিপিটক পাঠ, আমাদের গীতা থেকে পাঠ, জয় বাংলা গান রেকর্ড করে রাখতাম। ভোর চারটার সময় বিএসএফ এসে আমার কাছ থেকে টেপ রেকর্ডারটা নিয়ে যেত। শালবাগান কিলো হার্জের একটা রের্কার নিয়ে ছিল বেতার কেন্দ্রটি। আর বাংলাদেশ থেকে আসার সময় তারা (আপেলরা) বালিসের মধ্যে কিছু টেপ নিয়ে আসছিল।
তিনি বলেন, আমরা চাইছিলাম বাঙালি যে একটা জাত, সে পৃথিবীর কারো থেকে বীরত্বে কোনো অংশে কম না এটা প্রতিষ্ঠা করার জন্যই আপ্রাণ চেষ্টা করেছি। ইচ্ছা করলে বাঙালিরা অনেক কিছুই করতে পারে। তবে এটাও ঠিক যে, রাশিয়ার সাপোর্ট ছাড়া কোনো কিছুই সম্ভব ছিল না।
এমএএস/পিআর