ভিডিও EN
  1. Home/
  2. বিশেষ প্রতিবেদন

তোমার যুদ্ধে যাওয়ার বয়স হয়নি

প্রকাশিত: ০৯:০৭ এএম, ০৩ ডিসেম্বর ২০১৫

পেশায় পরিবহন শ্রমিক। সহায় সম্পদ বলতে তেমন কিছুই নেই। নিজের ঘাম ঝড়ানো শ্রম দিয়েই সংসার চালিয়েছেন। তবুও থেমে থাকেননি অদম্য পরিশ্রমী বীর। ৭১`এ তরুণ বয়সে পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে যেমনি জয়ী হয়েছেন, তেমনি পরবর্তীতে জীবনযুদ্ধেও সফলতার শীর্ষে পৌঁছেছেন। সফল এই যোদ্ধার নাম মো. আনোয়ার হোসেন।

লুতু মিয়া নামেই তাকে মানুষ চেনে। বাড়ি হবিগঞ্জ জেলার চুনারুঘাট উপজেলার জারুলিয়া গ্রামে। ভারত সীমান্তবর্তী এ গ্রামেই কেটেছে শৈশব ও কৈশোর। জাগো নিউজের কাছে তুলে ধরেন নিজের অনেক স্মৃতি ও জীবন সংগ্রামের কথা।

তিনি জানান, ৭১`এ ছিলেন তিনি এসএসসি পরীক্ষার্থী ছিলেন। তখন তার বয়স ছিল ১৭ বছর। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণ শুনে শরীরের রক্তের প্রতিটি শিরায় যুদ্ধে যাবার অনুপ্রেরণা পান। যুদ্ধ শুরুর মাত্র কয়েক দিনের মাথায়ই এপ্রিলের শুরুর দিকে বাড়ির কাউকে কিছু না বলেই চলে যান দেশ রক্ষার যুদ্ধে অংশ নিতে।

Habigonj

তিনি বলেন, প্রথমে যাই রেমা চা বাগানে। সেখানে ছিল মুক্তিযোদ্ধা ডিফেন্স টিম। নেতৃত্বে ছিলেন সুবেদার সামছুল হুদা। আর ক্যাম্প ছিল ভারতের বাঘাই এলাকায়। আমি যখন বাগানের ভেতর গিয়ে ঢুকলাম তখন মুক্তিযোদ্ধারা ঝোঁপ-ঝাড়ে ছিলেন। কেউ বলছিলেন গুলি করতে, আবার কেউ বললেন রাখ ছেলেটি কেন আসছে দেখি।

ঢোকার পরেই তারা (মুক্তিযোদ্ধারা) আমাকে সুবেদার সামছুল হুদার কাছে নিয়ে যান। তিনি আমাকে অনেক কথা বলেন। আমার কথা শোনেন। শেষে বললেন, তুমি বাড়ি চলে যাও। তোমার যুদ্ধে যাওয়ার বয়স হয়নি। যুদ্ধ অনেকদিন চলবে। পরে যুদ্ধ করতে পারবে। কোনো অবস্থাতেই আমি বুঝতে চাইলাম না। আমার একটাই বক্তব্য, যুদ্ধ আমি করবোই। এক পর্যায়ে একটি বাঁশে বাঁধা জাতীয় পতাকা দিয়ে তারা আমাকে বললেন এটি খোয়াই নদীর ওপারে পার্শ্ববর্তী চেগানগর স্কুলের ছাদে বেঁধে দিতে। অমনি আমি পতাকা নিয়ে দৌড়ে নদী পাড় হতে থাকি। মাঝ নদীতে যাওয়ার পর আমাকে আবার ডেকে ফিরিয়ে নিয়ে আসেন। ৮/১০ দিন এখানে থাকার পর আমি ট্রেনিং করার জন্য একটি সার্টিফিকেট চাই। কিন্তু কমান্ডার কোনো অবস্থাতেই আমাকে তা দেননি। পাশেই আলাদা তাঁবুতে থাকতেন স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা ইউপি চেয়ারম্যান মোতাব্বির হোসেন। তার কাছে গেলে তিনিও সার্টিফিকেট দেননি।

তিনি বলেন, পরে আমি বাল্লা এলাকায় এনামুল হক মোস্তফা শহীদের অফিসে যাই। তার কাছে সার্টিফিকেট চাইলে তিনি তা দেন। সেটি নিয়ে আমি কমলপুর ইয়ুথ ক্যাম্পের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হই। সঙ্গে আমার এক বন্ধু ছিল। আমরা বাসযোগে যাই। কিন্তু ভারতের সেভরি এলাকায় পুলিশ বাস থামিয়ে আমাদের ধরে থানায় নিয়ে যায়। পুলিশকে অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে ছাড়া পেয়ে আমরা কমলপুর ক্যাম্পে পৌঁছি। সেখানে গিয়ে দফায় দফায় আমাকে মুক্তিযোদ্ধাদের জেরার মুখে পড়তে হয়েছে। শেষ পর্যন্ত তরা আমাকে নিয়ে যান ক্যাম্প কমান্ডার ইউনুছ চৌধুরীর কাছে। তিনিও অনেকক্ষণ আমাকে জেরা করেন। এসময় ওই ক্যাম্পের যোদ্ধা আমার খালাতো ভাই এসে আমার পরিচয় দিলে জেরা থেকে মুক্তি পাই।

তিনি জানান, মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং সেন্টার ছিল ভারতের লোহারবন। সেখানে ২১ দিন ট্রেনিং দেয়া হয়। এরপর তিনি আরও ২১ দিন জুনিয়র লিডার উইং (জিএলডাব্লিউ) ট্রেনিং দেন। ট্রেনিং শেষে ৪নং সেক্টরের শ্রীমঙ্গলের কমলপুরে যুদ্ধ ক্যাম্পে যান। সেখানে ভারত সীমান্তবর্তী বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ধলাই বাগানে তুমুল যুদ্ধ হয়। এতে তিনি সরাসরি অংশ নেন। এটি তার প্রথম যুদ্ধ। পরে সেখান থেকে চলে যান ৩নং সেক্টরের ভারতের গমিশিং বাড়িতে। সেখানেও তিনিসহ মোট ১২ জনের একটি দল সরাসরি যুদ্ধে অংশ নেন।

Habigonj

পরে যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে তারা চুনারুঘাট উপজেলার নালমুখ এলাকায় এলে যুদ্ধের মুখে পড়েন। তখনই তিনি জমিতে ঘুমিয়ে পড়েন। এক পর্যায়ে এখান থেকে সটকে পড়েন তারা। চলে যান নবীগঞ্জে। সেখানে থানায় আক্রমণ করে তা দখলে নেন। ২৫ দিন ঘুমহীন অবস্থায় কাটিয়েছেন। রাত জেগে পাহারা দিয়েছেন। কয়েকদিন পর সেখান থেকে ১২ জন হবিগঞ্জ শহরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। ফজরের সময় রাস্তায় এক বাড়িতে আশ্রয় নিয়ে খবর পান পাক বাহিনী চলে গেছে। সকালে শহরে এসে হাজির হন।

বীর এ যোদ্ধা জানান, যুদ্ধ পরবর্তী তার জীবন যুদ্ধের কথা। তিনি বলেন, পাঁচ ছেলে ও এক মেয়ের জনক তিনি। সংসার চালাতেন পরিবহন শ্রমিকের কাজ করে। পৌঁছেছেন সফলতার শীর্ষে। প্রত্যেক সন্তানকেই করেছেন উপযুক্ত মানুষ গড়ে তুলেছেন।

বড় ছেলে কামাল হোসেন বিএসসি ইঞ্জিনিয়ার। বর্তমানে মৌলভীবাজারে গণপূর্ত বিভাগে কর্মরত আছেন। দ্বিতীয় ছেলে তোফাজ্জল হোসেন লিটন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজকর্ম বিভাগে এমএ ডিগ্রি অর্জন করে প্রথমে কিছুদিন সাংবাদিকতা করেছেন। বর্তমানে তিনি আমেরিকা প্রবাসী। তৃতীয় ছেলে দেলোয়ার হোসেনও একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নৃবিজ্ঞান বিভাগে এমএ ডিগ্রি অর্জন করেছেন। চতুর্থ ছেলে আফজাল হোসেন শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাবলিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন বিভাগে এমএ ডিগ্রি অর্জন করে সোনালী ব্যাংকে কর্মকর্তা হিসেবে যোগদান করেছেন। পঞ্চম ছেলে ইমতিয়াজ হোসেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে এলএলবি বিষয়ে অনার্স পড়ছেন। আর একমাত্র মেয়ে ফাতেমা বেগমকে বিয়ে দিয়েছেন প্রায় ১৫ বছর আগে।

৪২ বছর তিনি শ্রমিক হিসেবে কাজ করেছেন। বর্তমানে প্রায় আট বছর ধরে অবসর জীবন কাটাচ্ছেন। আর লিখছেন বই।
ইতোমধ্যে তিনি ঝড় ও ঝলকানি মেঘের গর্জন নামে দুটি কবিতার বই লিখেছেন। যেগুলোর মাঝে তুলে ধরা হয়েছে শুধু মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস। রয়েছে ২৫ মার্চের ভয়াল রাত ও ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ নিয়ে অসংখ্য কবিতা। এখন লিখছেন শিশুদের নিয়ে একটি বই। আগামী বই মেলায় যা প্রকাশের ইচ্ছা পোষণ করেছেন তিনি।

সর্বোপরি স্বাধীনতার ৪৫ বছর পর কেমন আছেন জানতে চাইলে তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ভালো নেই। কারণ যারা স্বাধীনতা যুদ্ধে বিরোধী ছিলেন তারা আজও সোচ্চার রয়েছেন। দেশ অস্থিতিশীল করছেন। যারা ক্ষমতায় আসে তারাই মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে রাজনীতি করে। আসল মুক্তিযোদ্ধা কতজন ছিল তা কেউ বলতে পারেন না। ২১ বছর বিরোধীরা ক্ষমতায় ছিলেন। অফিস আদালতে তাদের লোক বসিয়ে রেখেছেন। যে ক্ষমতায় আসে সেই মুক্তিযোদ্ধা বানায়। তারা ভাতা নেন। রাজাকার মুক্তিযোদ্ধা হয়েছে। যুদ্ধের পর জন্ম হয়েছে এমন মুক্তিযোদ্ধাও আছে। অধিকাংশ ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাই জামায়াত-বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত রয়েছেন। তারা ভাতাও নিচ্ছেন। ভুয়া মুক্তিযোদ্ধারাই নেতা। এমনকি যাচাই বাছাই কমিটি থেকে আসল মুক্তিযোদ্ধাদের বাদ দেয়া হয়েছে।

যারা ভুয়াদের বিরুদ্ধে কথা বলে তাদের কমিটিতে রাখা হয় না। কারণ তারা ভুয়াদের বাঁচাতে চান। অথচ এখন আমরা ভালো থাকবো এটাই প্রত্যাশা ছিল। এদেশ স্বাধীন করেছেন কৃষক, শ্রমিক, মেহনতী মানুষরা। তারাই প্রকৃত যুদ্ধ করেছেন। অথচ তারা সে অনুযায়ী মূল্যায়ন পাচ্ছেন না।

এমজেড/এমএস