সংসার চালাতে তাওহিদাকেও নামতে হলো কাজে
‘মা, মাছ কি তিন টুকরা নাকি চার টুকরা করুম।’ ‘এইভাবে কাডে না (কাটে না), বঁটি বরাবর ধইরা সোজা কইরা কাট।’ এ কথোপকথন ছোট্ট একটি মেয়ে শিশু ও তার মায়ের। বুধবার (১২ মে) সকাল সাড়ে ৮টার দিকে রাজধানীর কারওয়ান বাজার মাছের আড়তের পেছনে রেললাইনের পাশে তাদের এ কথোপকথন।
কথোপকথন দূর করে শুনলে মনে হতে পারে আনুমানিক পাঁচ-ছয় বছরের ছোট্ট শিশুটি হয়তো মায়ের পাশে বসে খেলনা-জাতীয় বঁটি হাতে মাছকাটা-মাছকাটা খেলা করছে। কিন্তু সামনে এগোতেই দেখা যায়, ছোট এ শিশুটি বেশ বড় একটি ধারাল বঁটিতে মাছ কাটছে। প্রতিটি মাছের কানসা কাটছে, পেট কেটে নাড়িভুঁড়ি বের করছে। তারপর তার মায়ের নির্দেশনা অনুযায়ী মাছের টুকরা করে রাখছে।
পাশেই দাঁড়িয়েছিল শিশুটির বড় ভাই নয় বছরের ওমর সানি। ছোট্ট বোন তাওহিদার মাছকাটায় সামান্য ভুল দেখে এগিয়ে আসে। পাশেই একটি বঁটি নিয়ে বসে কীভাবে আরও ভালো করে মাছ কাটতে হয় তা দেখিয়ে দেয়।
ধনাঢ্য ঘরের এই বয়সী শিশুদের ধারাল বঁটি হাতে মাছ কাটা তো অনেক দূরের কথা, সামনে গেলে বেখেয়ালে হাত কেটে যেতে পারে, এ আশঙ্কায় কাছেই ঘেঁষতে দেন না অভিভাবকরা।
মায়ের নির্দেশনায় মাছ কাটছে ছোট্ট শিশু তাওহিদা
অথচ ছয় ও নয় বছর বয়সী দুই ভাইবোন আগাম সতকর্তাস্বরূপ কোনো প্রতিরোধ (সাধারণত ধারাল দা-বঁটি দিয়ে কিছু কাটার সময় হাতের আঙুলে কাপড় জড়িয়ে নেয়া হয় যাতে বেখেয়ালে বটিতে আঙুল লাগলে যেন না কাটে) ছাড়াই কেটে চলছিল মাছ। যে বয়সে সাতসকালে ওদের গভীর ঘুমে থাকার কথা, বই-খাতা হাতে স্কুলে যাওয়ার কথা, সমবয়সীদের সঙ্গে খেলাধুলা করে সময় কাটানোর কথা, সে বয়সেই তারা নাম লিখিয়েছে শ্রমিকের খাতায়।
শুধু তাওহিদা ও সানিই নয়, তাদের মতো আরও অনেক অল্পবয়সী শিশুকে কারওয়ান বাজার মাছের আড়তের পেছনে রেললাইনের পাশে মাছ কাটতে দেখা যায়। এ মাছের আড়তে প্রতিদিন কাকডাকা ভোর থেকে গভীর রাত অবধি টনে টনে পাইকারি ও খুচরা মাছ বিক্রি হয়। নগরের বাসিন্দাদের অনেকে পরিমাণে একটু বেশি মাছ অপেক্ষাকৃত সস্তায় কিনতে পারায় এ বাজারে আসেন। তারা যে মাছ কেনেন তাদের অধিকাংশই বাজার থেকেই মাছ কাটিয়ে নিয়ে যান। ওজন হিসেবে প্রতি কেজি মাছপ্রতি ১০ টাকা ও ছোট বা কাঁটাযুক্ত মাছ হলে দরদাম সাপেক্ষে ১৫/২০ টাকা কেজি দরে মাছ কাটা যায় এখানে।
আড়তের পেছনে কারওয়ান বাজার ও তেজগাঁও এলাকার হতদরিদ্র নিম্নআয়ের মানুষ মাছকাটাকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছে। তবে গত বছর পর্যন্ত এ পেশায় নিম্নআয়ের হতদরিদ্র নারী ও পুরুষরা জড়িত থাকলেও সম্প্রতি ছোট ছোট শিশুও এ পেশায় যুক্ত হচ্ছে। অধিকাংশ শিশু করোনাপূর্ব সময়ে স্কুলে যেত। স্কুল বন্ধ থাকা ও পারিবারিক অসচ্ছলতার কারণে তারা মাছকাটাসহ বিভিন্ন কাজে যুক্ত হচ্ছে।
নেপথ্য কারণ অনুসন্ধানে জানা গেছে, এ পেশার সঙ্গে জড়িত অধিকাংশই কারওয়ান বাজার ও তেজগাঁও বস্তি এলাকার বাসিন্দা। তাদের প্রত্যেকের ঘরেই বাবা-মাসহ সর্বনিম্ন চারজন থেকে সর্বোচ্চ সাত-আটজন সদস্য রয়েছেন। বস্তির বাসিন্দাদের অধিকাংশ পুরুষ এ এলাকা ও আশেপাশের এলাকায় চা-সিগারেটের কিংবা মুদি দোকান কিংবা ফল-ফলাদি বেচাকেনা করতেন, আর নারীরা বাসাবাড়ি ও গার্মেন্টসে কাজ করতেন। কিন্তু মহামারি করোনার থাবায় পুরুষদের ব্যবসা আগের মতো নেই। নারীদের অনেকেই কাজ হারিয়েছেন কিংবা বেতন কমিয়ে দেয়ায় কাজ ছেড়ে দিয়েছেন। ফলে সংসারের চাকা সচল রাখতে তারা শিশুদেরও এ পেশায় নামিয়ে দিয়েছেন। জীবনসংগ্রাম করে যাচ্ছেন সবাই মিলে।
বোন তাওহিদাকে দেখিয়ে দিতে মাছ কাটছে বড়ভাই ওমর সানি
শিশু তাওহিদা ও ওমর সানির মা সালমা বেগম জানান, তার স্বামী কারওয়ান বাজারে একটি ছোট্ট চা-সিগারেটের দোকান চালান। করোনার আগে দিনরাত মানুষের উপস্থিতির কারণে বেচাকেনা বেশ ভালো ছিল। তার একার আয়ে সংসার চলত। কিন্তু করোনা শুরু হওয়ার পর থেকে আয় রোজগার কমতে থাকে। স্বামীর একার পক্ষে সংসার চালানো দায় হয়ে পড়ে।
সালমা জানান, তার ছেলে তেজগাঁও বিজি প্রেস স্কুলে চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র ছিল। গত এক বছরেরও বেশি সময় ধরে স্কুল বন্ধ রয়েছে। স্কুল বন্ধ থাকায় এবং সংসার সুন্দরভাবে চালাতে প্রথমে নয় বছর বয়সী ছেলে ওমর সানি ও পরে ছয় বছর বয়সী মেয়ে তাওহিদাকে এ পেশায় নিয়ে আসতে বাধ্য হন। তবে করোনা শেষ হলে ছেলেকে আবার স্কুলে পাঠাবেন বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন সালমা।
শিশু তাওহিদা ও ওমর সানিদের পাশে বসেই দুই মেয়েকে নিয়ে মাছ কাটছিলেন মধ্যবয়সী তোহরা বেগম। স্বামী, চার ছেলে ও চার মেয়েসহ মোট ১০ সদস্যের পরিবার। স্বামী পঙ্গু হয়ে ঘরে পড়ে আছেন। সংসার চালাতে ১০ ও ১৩ বছর বয়সী দুই মেয়েকে তার সঙ্গে মাছকাটার কাজে লাগিয়ে দিয়েছেন। জাগো নিউজকে তোহরা বেগম বলেন, নিজেরা অশিক্ষিত বলে মেয়ে দুটিকে স্কুলে ভর্তি করিয়েছিলাম। করোনার কারণে স্কুল না থাকায় ঘরে বসেই থাকে। এ কারণে কাজে লাগিয়ে দিয়েছি।
এত বড় সংসার চালাতে সবাই মিলে কাজ করেও হিমশিম খেতে হয় বলে জানান তোহরা।
গত এক বছরেরও বেশি সময় ধরে মহামারি করোনার সংক্রমণ ও লকডাউনে শিক্ষাব্যবস্থা বিশেষ করে হতদরিদ্র পরিবারের শিশুরা লেখাপড়া ছেড়ে বিভিন্ন পেশায় যুক্ত হচ্ছে। ফলে করোনাপরবর্তী সময় প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থী ড্রপআউট বা ঝরে পড়া বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন শিক্ষা বিশেষজ্ঞরা।
বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা ব্যাহত হওয়ার বিষয়টি ইউনিসেফের বাংলাদেশ প্রতিনিধি তমো হজুমির বক্তব্যেও এসেছে। সংস্থাটির ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক বার্তায় তিনি বলেন, যত বেশি শিশু স্কুল থেকে দূরে থাকবে, তাদের সংস্কারের সুযোগ তত কমে আসে। বাংলাদেশে কোভিড-১৯ পরিস্থিতি মোকাবিলায় শিশুদের বিকল্প শিক্ষার পথ তৈরি করা অবশ্যই কঠিন একটি কাজ হবে।
যদিও চলমান সংকটে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা অব্যাহত রাখতে সংসদ টেলিভিশন চ্যানেলের পাশাপাশি বাংলাদেশ বেতার থেকেও শিক্ষার্থীদের জন্য দূরশিক্ষণ ক্লাস পরিচালিত হচ্ছে। গত এক বছরেরও বেশি সময় ধরে শহরের শিশুরা অনলাইনে পড়াশোনার সুযোগ পেলেও করোনা সংক্রমণের ভয়ে ঘরবন্দি রয়েছে। আর গ্রামের শিশুরা মোবাইল ও ইন্টারনেট কানেকশন না থাকায় অনলাইনে পড়াশোনার সুযোগ থেকে বঞ্চিত।
কারওয়ান বাজার মাছের আড়তের পেছনে রেললাইনের পাশে মাছ কাটার কাজ করেন ওই এলাকার দরিদ্র মানুষজন
রাজধানীর ভিকারুননিসা নূন স্কুল আজিমপুর শাখার পঞ্চম শ্রেণির এক শিক্ষার্থীর মা জানান, ঘরবন্দি থাকতে থাকতে তার মেয়ের আচার-আচরণ কেমন যেন মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে যাচ্ছে। কথায় কথায় রেগে যায়, বাইরে নিয়ে না যাওয়ায় বাবা-মা ভালো না বলে মন্তব্য করে। তার মেয়ে আগে খুব হাসিখুশি ও প্রাণবন্ত ছিল, কিন্তু বর্তমানে তিনি মেয়েকে নিয়ে চিন্তিত।
ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিআইজিডি) ‘বাংলাদেশ: ফ্রম লার্নিং ক্রাইসিস টু আ প্যানডেমিক’ শীর্ষক পৃথক জরিপে এসেছে, শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্যেও বর্তমান পরিস্থিতি প্রভাব ফেলেছে। জরিপে বলা হয়, করোনাভাইরাসের সংক্রমণের আগে শিক্ষার্থীদের ৮৭ শতাংশ সুখি ছিল। এখন তা কমে ৭২ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। আগে ৭৩ শতাংশ জীবনযাপন নিয়ে দুশ্চিন্তামুক্ত ছিল। এখন সে হার কমে ৫৯ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।
এ গবেষণায় মোবাইল ফোনের মাধ্যমে অংশ নেয় গ্রাম ও শহরের বস্তি এলাকার সরকারি-বেসরকারি স্কুল ও মাদরাসার পাঁচ হাজার ১৯৩ জন শিক্ষার্থী। শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৭৫ শতাংশ গ্রামের। আর ২৫ শতাংশ শহরের বস্তি এলাকার।
জরিপের ফলাফলে বলা হয়, সরকার টেলিভিশনের মাধ্যমে ‘ঘরে বসে শিখি’ ও ‘আমার ঘরে আমার স্কুল’ নামে প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের পাঠ কার্যক্রম চালু করলেও তা দেখছে কমসংখ্যক। জরিপে অংশগ্রহণকারী পাঁচ হাজার ১৯৩ শিক্ষার্থীর মধ্যে গ্রামের শিক্ষার্থীদের ৬২ শতাংশের বাসায় টেলিভিশন সুবিধা রয়েছে। তবে টেলিভিশনে ক্লাস দেখছে মাত্র ২৫ শতাংশ। ৩০ শতাংশের বাসায় ইন্টারনেটের সুবিধা আছে। তবে ইন্টারনেটে ক্লাস করছে মাত্র ২ শতাংশ।
এমইউ/বিএ/এইচএ/জিকেএস