এবার বোরো সংগ্রহের চ্যালেঞ্জ
বাজারে দামের ঊর্ধ্বগতির কারণে গত বোরো ও আমন মৌসুমে ধান-চাল সংগ্রহে ব্যর্থ হয় সরকারের খাদ্য বিভাগ। সরকারি ও বেসরকারিভাবে পর্যাপ্ত পরিমাণ চাল আমদানিও করা যায়নি, তাই তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে সরকারি খাদ্যশস্যের মজুত। এই পরিস্থিতিতে মজুত সন্তোষজনক পর্যায়ে উন্নীত করতে বোরো সংগ্রহ শুরু করেছে খাদ্য বিভাগ।
তবে কোভিড-১৯ মহামারি, লকডাউন, বাজারে ধান-চালের অস্বাভাবিক দামসহ সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় বোরো ধান ও চাল সংগ্রহের ক্ষেত্রে লক্ষ্যমাত্রা অর্জনকে চ্যালেঞ্জ মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
অভ্যন্তরীণ বাজার থেকে ধান ও চাল সংগ্রহের মাধ্যমে সরকার আপদকালীন খাদ্যশস্যের মজুত গড়ে তোলে। একইসঙ্গে বাজারে প্রভাব ফেলার চেষ্টা করা হয়, যেন দাম সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে থাকে। বোরো দেশের সবচেয়ে বড় ফসল। বোরো থেকেই সরকার সবচেয়ে বেশি ধান-চাল কিনে থাকে।
গত বছর বোরোতে এবং এবার আমনে সরকারের ধান-চাল সংগ্রহ কর্মসূচি ব্যর্থ হয়। খাদ্য মন্ত্রণালয় ও খাদ্য অধিদফতরের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, আগের অভিজ্ঞতার আলোকে এবার বোরো সংগ্রহ কর্মসূচি সফল করতে সর্বাত্মক পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, এবার বোরোর ফলন ভালো হয়েছে। বোরো ধান কাটা অনেকটা এগিয়েও গেছে। বোরোতে দুই কোটি পাঁচ লাখ চাল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
খাদ্য পরিকল্পনা ও পরিধারণ কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, চলতি বোরো মৌসুমে অভ্যন্তরীণ বাজার থেকে মোট ১৮ লাখ টন ধান ও চাল কিনবে সরকার। এর মধ্যে মিলারদের কাছ থেকে ৪০ টাকা কেজি দরে ১০ লাখ টন সিদ্ধ চাল, ৩৯ টাকা কেজি দরে দেড় লাখ টন আতপ চাল এবং কৃষকদের কাছ থেকে ২৭ টাকা কেজি দরে সাড়ে ছয় লাখ টন ধান কেনা হবে।
বুধবার (২৮ এপ্রিল) থেকে ধান কেনা শুরু হয়েছে। ৭ মে থেকে শুরু হবে চাল সংগ্রহ। বোরো ধান ও চাল সংগ্রহ কার্যক্রম চলবে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত।
খাদ্য সচিব মোছাম্মৎ নাজমানারা খানুম জাগো নিউজকে বলেন, ‘বোরো সংগ্রহ নিয়ে আগামী ৩ মে থেকে ধারাবাহিক বিভাগওয়ারী মিটিং করব। আটটি বিভাগের সঙ্গেই মিটিং হবে। আমরা মিটিংয়ের শিডিউল দিয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের অনুমোদন চেয়েছি। মিটিংগুলোতে বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসক ও মাঠ পর্যায়ে খাদ্য বিভাগের কর্মকর্তারা থাকবেন।’
তিনি বলেন, ‘বিগত দু-মৌসুমের অভিজ্ঞতা রয়েছে আমাদের, লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা যায়নি। বাজারমূল্যটা বেশি ছিল, আমরা কম ঘোষণা দিয়ে ধান চাল কিনতে পারিনি। আমরা আশা করি, এবার ভালো দাম দিতে পারছি, ইনশাআল্লাহ আমরা সর্বাত্মকভাবে চেষ্টা করব।’
নাজমানারা খানুম বলেন, ‘মাঠ পর্যায়ের প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি সবারই আমরা সহযোগিতা চাইছি, আমরা মিটিং করে যাচ্ছি। আশা করি, আমরা লক্ষ্য অর্জন করতে পারব। আমাদের মজুতটা বাড়াতে পারব।’
চাহিদার সঙ্গে উৎপাদনের কোথাও একটা অসামঞ্জস্য আছে জানিয়ে খাদ্য সচিব বলেন, ‘আমরা ভালো উৎপাদন করছি, আমদানি করছি, এরপরও কিন্তু দাম কমছে না। আমাদের উৎপাদন ও জোগানের সঠিক তথ্যটি দরকার। মুক্তবাজার অর্থনীতির কারণে আমরা দামও বেঁধে দিতে পারছি না। কোনটি যৌক্তিক মূল্য সেটা আমরা জানতে পারছি না। সেই সিস্টেমটি এখনো দাঁড়ায়নি।’
নাজমানারা খানুম আরও বলেন, ‘মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও পরিসংখ্যান সচিবের সঙ্গেও কথা হয়েছে। ইতোমধ্যে মিটিংও হয়েছে যে, আমাদের হাউজ হোল্ড এক্সপেন্ডিচার সার্ভে যেটা, খানাভিত্তিক ব্যয়ের যে সার্ভে—সেটা আপডেট করা দরকার। এটা করা হলে আমরা জানতে পারতাম আমাদের চালে কত টাকা, অন্যটায় কত টাকা লাগছে, কতটুকু চাল খাচ্ছে মানুষ। এটা আপডেট না হলে চাহিদার বিষয়ে আমরা অন্ধকারেই থাকছি।’
বাংলাদেশ অটো মেজর অ্যান্ড হাসকিং মিল মালিক সমিতির সভাপতি মো. আব্দুর রশিদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘আশা করি আমরা চাল দিতে পারব। সরকারের লক্ষ্যমাত্রা সফল হবে। তবে বর্তমান বাজার অনুযায়ী কোনো মিলার যদি কেজিতে দুই টাকা বা পাঁচ টাকা লাভ করতে চায় সে সেটা পারবে না। এটা দেশের জন্য মঙ্গলও নয়। চার আনা লাভ থাকলে কিংবা সমান সমান থাকলেও আমরা এই দুর্দিনে সরকারের পাশে আছি।’
তবে সমিতির সাধারণ সম্পাদক কে এম লায়েক আলী বলেন, ‘পরিস্থিতি এখনো বোঝা যাচ্ছে না। এখন বাজারের যা অবস্থা। প্রতি কেজি ধানের দাম ২৭ টাকা হলে কি এক কেজি চালের দাম ৪০ টাকা হয়? বলেন। সরকারের হিসাবেই তো এক কেজি চালের দাম ৪২ টাকার বেশি হয়। বাজার যদি ফেভার করে তবে আমরা সরকারকে চাল দিতে পারব। না হয় সম্ভব নয়।’
তিনি বলেন, ‘এখনই কাঁচা ধানের মণ বিক্রি হচ্ছে ৯০০ থেকে সোয়া ৯০০ টাকা। এক মণ ধান শুকালে ওজন কমে হবে ৩০ কেজি। তাহলে শুকনো এক কেজি ধানের দাম এক হাজার ২০০ থেকে এক হাজার ৩০০ টাকা হচ্ছে। পরিস্থিতি এই হলে আমরা কীভাবে চাল দেব?’
‘আমাদের কথা একটা—লস দিয়ে আমরা চাল দিতে পারব না। তবে লাভ না হলেও আমরা সরকারকে চাল দেব। আমরা সরকারকে সহযোগিতার চেষ্টা করব’—বলেন লায়েক আলী।
গত আমন মৌসুমে দুই লাখ টন ধান, ছয় লাখ টন সিদ্ধ চাল ও ৫০ হাজার টন আতপ চাল কেনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। সংগ্রহ মূল্য নির্ধারণ করা হয় প্রতিকেজি আমন ধান ২৬ টাকা, চাল ৩৭ টাকা ও আতপ চাল ৩৬ টাকা।
গত বছরের ৭ নভেম্বর থেকে সংগ্রহ শুরু হয়। ধান-চাল কেনার তারিখ নির্ধারিত ছিল চলতি বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। পরে তা বাড়িয়ে ১৫ মার্চ পর্যন্ত করা হয়।
আমনে দুই লাখ টন ধানের বিপরীতে মাত্রা ১২ হাজার ৩৪২ টন সংগ্রহ করা হয়। ছয় লাখ টন সিদ্ধ চালের বিপরীতে ৭০ হাজার ১৩৬ টন এবং ৫০ হাজার টন আতপ চালের বিপরীতে চার হাজার ৮৬৩ টন সংগ্রহ করা সম্ভব হয়।
গত বোরোতে ১০ লাখ টন ধান, ১০ লাখ টন সিদ্ধ চাল ও দেড় লাখ টন আতপ চাল কেনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। ২৬ টাকা কেজি দরে ধান, ৩৬ টাকা কেজি দরে সিদ্ধ চাল এবং ৩৫ টাকা কেজি দরে আতপ চাল কেনার সিদ্ধান্ত হয়।
গত বছরের ২৬ এপ্রিল থেকে ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বোরো সংগ্রহ কার্যক্রম চলে। ওই সময়ে লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে দুই লাখ ১৯ হাজার টন ধান, ছয় লাখ ৬৭ হাজার ৮৯০ টন সিদ্ধ চাল এবং ৯৯ হাজার ১২৩ টন আতপ চাল কিনতে সক্ষম হয় খাদ্য অধিদফতর।
গত বোরো ও আমন মৌসুমে ধান-চাল সংগ্রহে এ ব্যর্থতার কারণে সরকারি খাদ্য শস্যের মজুত আশঙ্কাজনকভাবে কমে গেছে। সর্বশেষ গত ২৬ এপ্রিলের খাদ্যশস্যের মোট মজুতের পরিমাণ পাঁচ লাখ টনের মতো। এর মধ্যে চাল তিন লাখ টন এবং গম দুই লাখ টন।
গত ২২ এপ্রিল খাদ্য পরিকল্পনা ও পরিধারণ কমিটির সভায় স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেক বর্তমান খাদ্য মজুতকে আশঙ্কাজনকভাবে কম বলেছেন। তিনি দ্রুত মজুদ বাড়ানোর তাগিদ দেন। এছাড়া সভায় অর্থ বিভাগের সিনিয়র সচিব আব্দুর রউফ তালুকদার বলেন, খাদ্যশস্যের মজুত কমপক্ষে ১০ লাখ টন থাকা উচিত।
আরএমএম/এমআরআর/এইচএ/এএসএম