হিটশকে আক্রান্ত ৬৮ হাজার হেক্টর জমি, উৎপাদন কমবে লাখ টন
হিটশকে বোরো ধানের মোট আক্রান্ত জমির পরিমাণ ৬৮ হাজার ১২৩ হেক্টর। যার মধ্যে ১০ হাজার ২৯৮ হেক্টর জমির ধান পুরোপুরি নষ্ট হয়েছে। বাকিটুকুতে আংশিক ক্ষতি হয়েছে। ফলে এ বছর উৎপাদন ১ লাখ টন কমে যাবে।
কৃষি মন্ত্রণালয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। হিটশকের ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে মন্ত্রণালয়ের করা চূড়ান্ত প্রতিবেদনে আরো দেখা গেছে, ৩৬টি জেলার ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া এই হিটশকে ধানের পাশাপাশি ভুট্টা, সবজি, চীনাবাদাম, সূর্যমুখী ও কলার ফলন নষ্ট হয়েছে।
প্রসঙ্গত, অতিরিক্ত গরমে মানুষ যেমন হিটস্ট্রোক করে, তীব্র দাবদাহে ধানগাছও এমনভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, যেটাকে হিটশক বা হিট ইনজুরি বলে। গত ৪ এপ্রিল দেশের বিভিন্ন জেলায় বোরো ধানের ক্ষতি হয়েছে এ হিটশকে। এটিকে কৃষিতে জলবায়ু পরিবর্তনের নতুন চ্যালেঞ্জ বলে দেখছেন ধান গবেষকরা।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্য আরও বলছে, ধানের পাশাপাশি ভুট্টা, সবজি, চীনাবাদাম, সূর্যমুখী ও কলার ফলন নষ্ট হয়েছে। সব মিলে টাকার অংকে মোট ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩৩৪ কোটি টাকার বেশি। এরমধ্যে বোরো ধানের ক্ষতি হয়েছে ৩২৮ কোটি টাকার। এরপর প্রায় ৪ কোটি টাকার ভুট্টা নষ্ট হয়েছে। এতে ৩ লাখ ১০ হাজার কৃষক সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের কর্মকর্তারা বলছেন, সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে বোরো ধানের। এরপরই ভুট্টা। আর সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা নেত্রকোনা ও কিশোরগঞ্জের হাওর এলাকা এবং গোপালগঞ্জ, কুষ্টিয়া, রাজশাহী ও ময়মনসিংহ।
এর আগে হিটশকের পরপরই কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর বলছে, পুরোপুরি ক্ষতির হিসাব নিরূপণ করা না গেলেও হিটশকে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলোতে ৪৮ হাজার হেক্টর জমি বোরো ধান আক্রান্ত হয়েছে। এরমধ্যে ২০ থেকে ২৫ শতাংশ আবাদের ক্ষতি হয়েছে। সে হিসাবে ১০ থেকে ১২ হাজার হেক্টর জমির ধান সম্পূর্ণ নষ্ট হতে পারে বলে প্রাথমিক আশঙ্কা করা হচ্ছে।
জানা গেছে, ৪ এপ্রিল সন্ধ্যার পর সারাদেশের মতো কালবৈশাখীর ঝড়ো বাতাস শুরু হয় বেশি ক্ষতিগ্রস্ত জেলাগুলোতেও। তবে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলোতে বাতাস ছিল অতিরিক্ত গরম। দেশের অধিকাংশ এলাকায় এরপর গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি নামে। তবে ক্ষতিগ্রস্ত সেসব এলাকায় বৃষ্টি হয়নি। পরদিন ৫ এপ্রিল সকালে ক্ষেতে গিয়ে মাথায় হাত পড়ে কৃষকের। সূর্যের প্রখরতা যত বেড়েছে, ততই বোরো ধানের শীষ মরতে শুরু করেছে। ক্ষতিগ্রস্ত সব এলাকায় একই ঘটনা ঘটেছে। বিষয়টি কী ঘটেছে তা পরিষ্কার ছিলেন না কৃষকরা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে এ ধরনের ঘটনা নতুন না হলেও সাধারণ মানুষের কাছে বেশি পরিচিত নয়। কৃষিতে জলবায়ু পরিবর্তনের এটি একটি নতুন চ্যালেঞ্জ।
গাজীপুর ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট থেকে বিজ্ঞানীরা সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত নেত্রকোনার তিনটি উপজেলা পরিদর্শন করেছেন ৬ এপ্রিল। এই দলে রয়েছেন ইনস্টিটিউটের কীটতত্ত্ব বিভাগের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. নজমুল বারী, উদ্ভিদ রোগতত্ত্ব বিভাগের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মোহাম্মদ আশিক ইকবাল খান এবং উদ্ভিদ শরীরতত্ত্ব বিভাগের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. সাজ্জাদুর রহমান।
নাজমুল বারী জাগো নিউজকে বলেন, ‘অতিরিক্ত তাপমাত্রা বাড়া অথবা কমা—দুই কারণে হিটশক বা হিট ইনজুরি হয়ে থাকে। ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসকে হিটশকের মাত্রা ধরা হয়। আক্রান্ত এলাকাগুলোতে মার্চের শেষ দিক থেকে তাপমাত্রা ক্রমাগত বাড়ছে।’
তিনি বলেন, ধানের ফ্লাওয়ারিং স্টেজে (ফলনের প্রাথমিক পর্যায়) এটা ক্ষতি খুব বেশি করে। এ সময়কে সবচেয়ে ভার্নারেবল অবস্থা ধরি আমরা। আর এ দফায় গরম বাতাস এমন সময় হয়েছে, যখন ওইসব এলাকায় ফ্লাওয়ারিং স্টেজ চলছিল। তাই ওইসব ধানের শীষ থেকে পানি বেরিয়ে গেছে। শুকিয়ে নষ্ট হয়ে গেছে।
নাজমুল বারী বলেন, কৃষিতে জলবায়ু পরিবর্তনের এটি একটি নতুন চ্যালেঞ্জ। এ ঘটনা আগেও হয়েছে। তবে এতো বিস্তর এলাকায় ক্ষতি হয়নি।
হিটশক দেশে নতুন নয় উল্লেখ করে গাজীপুর ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের উদ্ভিদ শরীরতত্ত্ব বিভাগের সাজ্জাদুর রহমান বলেন, ‘২০১২ সাল থেকে আমরা হিটশকের তথ্য রেখেছি। এ পর্যন্ত যশোর সদর, সিরাজগঞ্জের তাড়াশ, গাজীপুরের কালিয়াকৈর এবং ময়মনসিংহের শম্ভুগঞ্জে এর আগে হিটশক হয়েছে। তবে কখনো গ্রামের এক-দুইটি মাঠে বা কোনো একটি এলাকার ক্ষেতে হয়েছে। এতো বড় হিটশক এটাই প্রথম।’
তিনি বলেন, ‘এ বছর কালবৈশাখীর সঙ্গে বৃষ্টি না থাকায় ক্ষতি হয়েছে বেশি। সাধারণত কালবৈশাখীর পরে বৃষ্টি হয়। তাই তাপমাত্রা কমে যায়, এমন হয় না। ৪ এপ্রিল যেখানে যেখানে বৃষ্টি হয়েছে, সেখানে ক্ষতি হয়নি।’
এনএইচ/এসএইচএস/এমএস