রাষ্ট্র নয়, উন্নয়ন করছে সাধারণ মানুষ
ড. হোসেন জিল্লুর রহমান। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ, শিক্ষাবিদ। নির্বাহী সভাপতি-পিপিআরসি (পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার)। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা। রাজনীতি ও অর্থনীতির চলমান বিষয় নিয়ে সম্প্রতি জাগো নিউজ এর মুখোমুখী হন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক সায়েম সাবু।
জাগো নিউজ : মানুষ নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা প্রকাশ করছে। বিষয়টা কীভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন?
হোসেন জিল্লুর রহমান : দেখুন, প্রথমত দৃশ্যমান ঘটনাগুলোর কারণে মানুষ উদ্বেগ প্রকাশ করছে। বিদেশি নাগরিক হত্যা, পুলিশ হত্যা, ব্লগার হত্যা বা তাজিয়া মিছিলে বোমা হামলার মতো ঘটনায় মানুষ নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত। এই হত্যাকাণ্ডগুলো বিশেষ ইঙ্গিত বহন করছে। দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে, মানুষের নিরাপত্তা সামাল দিতে সরকারের যে অবস্থান, তা নিয়ে জনমনে উদ্বেগ কাজ করছে। নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই সমাধানের চেষ্টা করা হচ্ছে। এটিই হচ্ছে উদ্বেগের কারণ।
জাগো নিউজ : খুনের এমন ইতিহাস পুরনো। এখন এত উদ্বেগ কেন?
হোসেন জিল্লুর রহমান : একজনের বিপদে আরেকজনের এগিয়ে আসা বাঙালির ঐতিহ্য। এই ঘটনাগুলোতে মানুষ এগিয়ে আসছে না। এটিই হচ্ছে ঘটনার নতুনত্ব। একেবারে ব্যস্ততম জায়গায় ব্লগার অভিজিৎকে প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা করা হল। মানুষ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে। মোবাইলে ছবি তুলেছে। অথচ এগিয়ে আসছে না। সম্প্রতি প্রকাশক হত্যাকাণ্ডের প্রেক্ষিতে শাহবাগে প্রতিবাদ সমাবেশ হল, অথচ সেই অর্থে মানুষের অংশগ্রহণ নেই। এটি বাঙালির সংস্কৃতি নয়, ভয় এখানেই।
জাগো নিউজ : মানুষ এগিয়ে আসছে না বলছিলেন, আপনার কাছে এর ব্যাখ্যা কি?
হোসেন জিল্লুর রহমান : আমরা আমাদের সহযোগিতার ঐতিহ্য ভুলে গেছি বা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে গেছি, আমি এমনটি মনে করি না। বলতে পারেন, মানুষ স্বেচ্ছায় নিষ্ক্রিয় হয়ে গেছে।
জাগো নিউজ : এই নিষ্ক্রিয়তার জন্য কোন বিষয়টিকে দায়ী করা যায়?
হোসেন জিল্লুর রহমান : রাষ্ট্র, সরকার এবং রাজনীতি যে অর্থে ব্যবহৃত হচ্ছে, তারই পরিণতি হচ্ছে স্বেচ্ছায় নিষ্ক্রিয়তা। রাজনীতিতে মানুষের স্বেচ্ছায় নিষ্ক্রিয়তা রাষ্ট্রের প্রতি বিশেষ বার্তা। সাম্প্রতিক হত্যাকাণ্ডগুলো মানুষ বৃহত্তর রাজনীতিক মোড়কে দেখতে চাইছে আর রাজনৈতিক মোড়কে দেখতে চাইছে বলেই এসব হত্যাকাণ্ড রোধে মানুষ এগিয়ে আসছে না।
জাগো নিউজ : তাহলে কি মানুষ রাজনীতিবিমুখ হয়ে পড়ছে?
হোসেন জিল্লুর রহমান : আমি তা মনে করি না। মূলত যে পথগুলো দিয়ে মানুষ রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করবে, সেই পথগুলো সংকীর্ণ করে দেয়া হচ্ছে। দিনকে দিন কঠিন হয়ে যাচ্ছে।
জাগো নিউজ : ১৯৭১-এ মানুষ দাঁড়িয়ে গেল। এমনকি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের শাসনামলেও মানুষ মাঠে নামল। রাস্তা তো তখনও সংকীর্ণ ছিল?
হোসেন জিল্লুর রহমান : ক্ষমতাসীন দল তো জনগণের ভোটকে আর মূল্যায়ন করছে না। জনগণের ভোটকে মূল্যায়ন করলে গাইবান্ধার সাংসদ লিটন মাতলামি করে শিশুর পায়ে গুলি করত না। দলের সর্বোচ্চ নেতার অনুগ্রহ পেলেই সাংসদ হওয়া যায়। জনগণের ভোটের আর কোনো দরকার হয় না।
জাগো নিউজ : কথা তো বলছেন অনেকেই। রাজনৈতিক দলগুলোও এ নিয়ে ব্যাখ্যা দিচ্ছে...
হোসেন জিল্লুর রহমান : মানুষ সবই রাজনীতির ইস্যু হিসেবে মূল্যায়ন করে এবং এর যথেষ্ট কারণও আছে। মানুষ আর রাজনৈতিক দলগুলোর ব্যাখ্যা বিশ্বাস করতে চায় না। উন্নয়ন নাকি নির্বাচন, ধর্ম নাকি ধর্ম না -এসব কথায় আর মানুষ আস্থা রাখছে না। মানুষ সবই চায়। উন্নয়ন চায় আবার গণতন্ত্রও চায়। ধর্ম চায় আবার ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়িও চায় না। মানুষের চাওয়া পাওয়ার মধ্যে কোনো সমস্যা নেই। সকল সমস্যাই রাজনীতির মধ্যে।
জাগো নিউজ : স্বেচ্ছায় নিষ্ক্রিয়তার পেছনে শুধুই কী রাজনীতি। অন্য কোনো কারণ কাজ করছে কি না?
হোসেন জিল্লুর রহমান : সব কিছুর মূলেই রাজনীতি। আপনি সমাজের কোনো কিছুই রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন করতে পারবেন না। যারা ক্ষমতায় আছেন এবং যারা ক্ষমতায় যেতে চান উভয়ের ব্যবহারিক কর্মকাণ্ড দেখে মানুষ অসন্তোষ প্রকাশ করে আসছে।
জাগো নিউজ : মানুষ তো থেমে নেই, এগিয়ে যাচ্ছেই...
হোসেন জিল্লুর রহমান : মানুষের এগিয়ে যাওয়ার বাসনাই হচ্ছে সমাজের রক্ষাকবচ। স্বাধীনতার পর মানুষ যখন দেখছে, তার সমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় গিয়ে তাকেই অবমূল্যায়ন করা হচ্ছে, তখন মানুষ আর রাষ্ট্র, সরকারের ওপর ভরসা রাখছে না। নিজেই নিজের ভাগ্য গড়তে বদ্ধপরিকর। সে নিজের ভাগ্য উন্নয়নে বিন্দুমাত্র ছাড় দিতে রাজি নয়। এ কারণেই সমাজ এগিয়ে যাচ্ছে। রাষ্ট্র নয়, উন্নয়ন করছে সাধারণ মানুষ।
জাগো নিউজ : মানুষ নিজেই এগিয়ে যাচ্ছে বটে, কিন্তু রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে পরিবেশ তৈরি করার প্রসঙ্গ থেকে যায়?
হোসেন জিল্লুর রহমান : রাষ্ট্র এমন পরিবেশ তৈরি করলে মানুষের দেশের বাইরে যাওয়ার প্রবণতা এভাবে বেড়ে যেত না। আপনি দেখেন শ্রমিকরা যাচ্ছে, ছাত্ররা যাচ্ছে এবং মুক্তমনা মানুষও দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে। এটি একটি দেশের উন্নয়ন, নিরাপত্তা নিয়ে বিশেষ ইঙ্গিত বহন করে।
জাগো নিউজ : সামনে স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী, রাষ্ট্র কোথায় যাচ্ছে?
হোসেন জিল্লুর রহমান : কোথায় যাচ্ছি, তা এক বাক্যে বলা মুশকিল। ’৯০-এর পর আমরা একটি ভঙ্গুর গণতান্ত্রিক পথে যাত্রা শুরু করেছিলাম। এর আগে তো গণতন্ত্র ছিলই না। দুই দশক আমরা এক প্রকার গণতান্ত্রিক আবহের মধ্যেই ছিলাম। কিন্তু এখন আমরা সম্পূর্ণ নতুন এক পরিস্থিতিতে প্রবেশ করেছি।
জাগো নিউজ : আদৌ কি গণতান্ত্রিক আবহ ছিল?
হোসেন জিল্লুর রহমান : গণতান্ত্রিক ধারার কিছু একটা তো ছিল। নির্বাচন, ভোট নিয়ে মানুষের মধ্যে কিছুটা উৎসাহ তো ছিলই বটে। ৫ জানুয়ারির নির্বাচন গণতান্ত্রিক ধারণা পাল্টে দিয়েছে।
জাগো নিউজ : বিরোধীদল নির্বাচনে না এলে কী করার আছে?
হোসেন জিল্লুর রহমান : ধরলাম, ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে বিরোধী দল আসেনি বলে একতরফা হয়েছে। কিন্তু ওই নির্বাচনের পরপরই উপজেলা নির্বাচনে যা দেখলাম তাকে আপনি কী বলবেন? বাংলাদেশের ইতিহাসে কোনো স্থানীয় নির্বাচন এমন হয়েছে? এসব ঘটনা প্রবাহই প্রমাণ করে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন এসব থেকে বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়।
জাগো নিউজ : একই মানসিকতা নিয়ে তো বিরোধী পক্ষও ক্ষমতায় যেতে চাইছে?
হোসেন জিল্লুর রহমান : হ্যাঁ, বিরোধীজোটও একইভাবে ক্ষমতায় যেতে মরিয়া হয়ে ওঠছে। তাদের আন্দোলনের সঙ্গে জনসম্পৃক্ততা ঘটাতে ব্যর্থ হয়েছে। তাদের ওপর সরকারের খড়গহস্ত সবারই জানা। এমন খড়গহস্ত এরশাদের সময়ও ছিল। কিন্তু মানুষ আন্দোলনে সম্পৃক্ত হয়েছে।
এএসএস/এআরএস/আরএস/আরআইপি