সড়কে মৃত্যুর মিছিল : কম দায়ী নয় জনগণের অসচেতনতাও
গন্তব্যের মাঝপথে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কাঁচপুর বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়ায় যাত্রীবাহী বাসটি। তখন রাস্তার দুপাশে অপেক্ষমাণ পথচারীরা রাস্তা পার হতে শুরু করেন। যাত্রীদের কেউ কেউ আবার নেমে পরবর্তী গন্তব্যের জন্য ছোট যানবাহনে ওঠার চেষ্টা করছিলেন। তখনই হঠাৎ ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা হোমনা সুপার সার্ভিসের (ঢাকা-মেট্রো-জ-১৪-০৯৩৭) একটি বাস নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা বাসটিকে ধাক্কা দেয়। এ ঘটনায় গুরুতর আহত হন তিন পথচারী। পরে তাদের সবাই মারা যান। গত ৫ ফেব্রুয়ারি ঘটে এ দুর্ঘটনা।
প্রতিদিনই সড়কে এমন দুর্ঘটনায় মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়। ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ এর একটি হিসাব মতে, গত বছর চার হাজার ৯২টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে, এতে চার হাজার ৯৬৯ জন প্রাণ হারিয়েছেন। অর্থাৎ প্রতিদিন গড়ে অন্তত ১৩ জনের প্রাণ ঝরেছে সড়কে।
দুর্ঘটনার পর মাঝে মাঝেই দেখা যায় আন্দোলন, সড়ক অবরোধ, মানববন্ধন ইত্যাদি কর্মসূচি। ২০১৮ সালের ২৯ জুলাই রাজধানীর বিমানবন্দর সড়কের কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের সামনে জাবালে নূর পরিবহনের দুই বাসের রেষারেষিতে নিহত হন শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র আবদুল করিম রাজীব ও একাদশ শ্রেণির ছাত্রী দিয়া খানম মিম। ২০১৯ সালের ১৯ মার্চ রাজধানীর যমুনা ফিউচার পার্কের সামনে সুপ্রভাত পরিবহনের বাসের চাপায় নিহত হন বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসের (বিইউপি) শিক্ষার্থী আবরার আহমেদ। এ দুটি ঘটনার পরই দেশজুড়ে নিরাপদ সড়কের দাবিতে তুমুল আন্দোলন হয়েছিল। তখন কর্তৃপক্ষ সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে নানা পরিকল্পনার ঘোষণা দেয়। তবে শেষ পর্যন্ত সড়কে মৃত্যুর মিছিল থামেনি।
সংশ্লিষ্টদের ভাষ্য, সড়কের অবস্থা এতোই বিশৃঙ্খল যে, পথচারীরাও নিরাপদে রাস্তায় চলতে পারে না। এমনকি রাস্তার পাশের বাড়ি, দোকানে থাকা অবস্থায়ও মানুষ মারা যাচ্ছে, বেপরোয়া বাস নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ঢুকে পড়ার কারণে। কারও কারও মতে, সড়ক দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে কেবল চালকরাই নন, যত্রতত্র রাস্তা পারাপারসহ যাত্রীর অসচেতনতাও দায়ী।
রাজু নামে রাজধানীর এক বেসরকারি চাকরিজীবী বলেন, ‘প্রতিদিনই বাসে যাতায়াত করতে হয়। বাসে ওঠা-নামার সময় ভয় হয়, এই বুঝি কোনো গাড়ি এসে ধাক্কা দিয়ে দিলো। সড়কে তো কোনো শৃঙ্খলা নেই, যে যার মতো চালিয়ে যাচ্ছে। অনেকে তো ট্রাফিক আইনেরও ভ্রুক্ষেপ করে না। এর মাঝে পথচারীরা অসচেতন হয়ে রাস্তায় চলাচল করে কিংবা ফুটপাত, ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহার করেন না।’
সম্প্রতি নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২০ সালে চার হাজার ৯২টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে। যাতে প্রাণ হারান চার হাজার ৯৬৯ জন। আহত হন পাঁচ হাজার ৮৫ জন, যাদের অনেকে পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন।
গত ১ ফেব্রুয়ারি যাত্রী কল্যাণ সমিতি এক প্রতিবেদনে জানায়, ২০১৯ সালের ১ নভেম্বর ‘সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮’ কার্যকর হওয়ার পর চলতি বছরের ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত (১৫ মাস) সড়কে আট হাজার ২১০ জন প্রাণ হারিয়েছেন। আহত হয়েছেন ১২ হাজার ৯১ জন।
রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের এক সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে ৪২৭টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। এসব দুর্ঘটনায় ৪৮৪ জন নিহত ও ৬৭৩ জন আহত হয়েছেন। নতুন বছরের প্রথম মাসে দেশজুড়ে ১৫৯টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ১৬৮ জন মারা যান, যা সড়কে মোট মৃত্যুর ৩৪ শতাংশ। গত বছরের জানুয়ারির তুলনায় এবার মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা বেড়েছে ৭৮ শতাংশ। এসব দুর্ঘটনায় ৬৩ শতাংশ ক্ষেত্রে প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে।
সড়ক দুর্ঘটনায় আহত একাধিক ব্যক্তি জাগো নিউজকে বলেন, বেশিরভাগ যানবাহনের চালকই অদক্ষ এবং অশিক্ষিত। তাদের জন্য দক্ষ ও ট্রাফিক আইন জানা মানুষকেও বিপত্তিতে পড়তে হয়। দক্ষ চালকরা সতর্ক থাকলেও অনেক সময় ঘটে যায় অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনা।
তাই তারা মনে করেন, শিক্ষিত ও দক্ষ ব্যক্তিদেরকেই ড্রাইভিং লাইসেন্স দেয়া উচিত। অন্যথায় সড়কে এই মৃত্যুর মিছিল থামানো অসম্ভব।
তারা বলেন, ‘শুধু যে চালকই দায়ী সেটাও বলবো না, যারা সড়কে চলাচল করে তারাও অসচেতন। নিয়ম মেনে তারা রাস্তায় চলাচল করেন না। বেশিরভাগ পথচারী হুটহাট করে রাস্তা পার হন। তাই এ ধরনের দুর্ঘটনা বেশি হয়।’
মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় আহত আলম বলেন, ‘মহাসড়কের গতিরোধকগুলো কোথাও কোথাও বোঝা যায় না। আবার ছোট-বড় খানাখন্দে ভরা সড়কে চলাচল করাও বিপদজনক। কিন্তু তারপরও চলতে হয়।’
২০১৯ সালের ১৯ মার্চ রাজধানীর যমুনা ফিউচার পার্কের সামনে সুপ্রভাত পরিবহনের বাসের চাপায় নিহত হন বিশ্ববিদ্যালশিক্ষার্থী আবরার আহমেদ
বিশেষ করে একই রাস্তায় ছোট-বড় সব ধরনের যানবাহন যথেচ্ছভাবে চলাচলের কারণে দুর্ঘটনার ঝুঁকি বেশি থাকে বলে মনে করেন তিনি।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী জাগো নিউজকে বলেন, ‘আসলে সড়কে দুর্ঘটনা কিংবা মৃত্যুর পেছনে আমাদের সবার দায় রয়েছে। সড়কের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষেরই এখানে আন্তরিকতার ঘাটতি আছে। এজন্য মালিক, শ্রমিকসহ যাত্রী সাধারণকে সড়কে চলাচলের ক্ষেত্রে সচেতন হতে হবে। একইসঙ্গে বিআরটিএ, ট্রাফিক পুলিশ ও হাইওয়ে পুলিশকে সততার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করা প্রয়োজন।’
আইন থাকলেও সঠিকভাবে বাস্তবায়ন না হওয়ার কারণে সড়কে মৃত্যুর মিছিল বন্ধ হচ্ছে না মন্তব্য করে তিনি আরও বলেন, ‘আমরা তো দেখছি আইন থাকলেও তার সঠিক প্রয়োগ নেই। আর সড়কের শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে সংশ্লিষ্ট আইনের শতভাগ বাস্তবায়ন হলে আশা করা যায় সড়ক-মহাসড়ক নিরাপদ হয়ে উঠবে।’
প্রায় তিন দশক ধরে নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলন করছেন চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন
দীর্ঘ ২৭ বছর ধরে নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলন করে আসছেন অভিনেতা ইলিয়াস কাঞ্চন। পাশাপাশি নিসচার প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান তিনি।
সড়ক দুর্ঘটনার বিষয়ে জাগো নিউজকে তিনি বলেন, ‘যে সড়ক আইন রয়েছে সেটি বাস্তবায়নের কথা আমরা তো বলেই আসছি। এছাড়া সড়কে শৃঙ্খলার জন্য আমাদের ১১১টা পরামর্শ রয়েছে। সরকার এগুলো বাস্তবায়ন করলেই সড়ক দুর্ঘটনা কমবে বলে আশা করছি।’
ইলিয়াস কাঞ্চন আরও বলেন, ‘সড়ক দুর্ঘটনা রোধে আমাদের প্রচার-প্রচারণা নেই। এ নিয়ে মানুষকে সচেতন করে তুলতে হলে তো প্রচার-প্রচারণা প্রয়োজন, কিন্তু কেন হচ্ছে না? সড়ক আইন নিয়ে প্রচার-প্রচারণা না হলে সবাই সচেতন হবে কীভাবে? কোভিড-১৯ ভাইরাস নিয়ে যে প্রচার-প্রচারণা হচ্ছে ঠিক সেভাবে তো সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে দেখছি না।’
এওয়াইএইচ/এসএস/এইচএ/জেআইএম