ভিডিও EN
  1. Home/
  2. বিশেষ প্রতিবেদন

সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠনে কী মতামত আইনজীবীদের?

মুহাম্মদ ফজলুল হক | প্রকাশিত: ০১:৪৩ পিএম, ০২ মার্চ ২০২১

বর্তমান নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপতির কাছে ‘গুরুতর অসদাচরণের’ অভিযোগ করেছেন দেশের ৪২ জন বিশিষ্ট নাগরিক। এরপর ১০ আইনজীবী কমিশনের বিরুদ্ধে তদন্ত চেয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) আবেদন করেন। তাদের সঙ্গে একই অভিযোগ আনেন সুপ্রিম কোর্টের বিএনপিপন্থী ১০১ জন আইনজীবী। শুধু অসদাচরণই নয়, অনিয়ম, দুর্নীতি এবং নিয়োগ বাণিজ্যেরও অভিযোগ এনেছেন বিশিষ্ট নাগরিক ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবীরা।

চিঠিতে নির্বাচন কমিশনের এসব অনিয়ম ও দুর্নীতি তদন্তে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠনের অনুরোধ করা হয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে সামনে এসেছে, সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল বর্তমানে বিদ্যমান আছে কি-না। আর সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল থাকা না থাকা এবং এর বিধান কাদের ওপর প্রয়োগ হবে, সেটি নিয়ে আইনজীবীদের মধ্যে ভিন্নমত রয়েছে।

এ বিষয়ে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন জাগো নিউজকে বলেন, ‘সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন সংক্রান্ত বিষয়ে ষোড়শ সংশোধনীর রায় সুপ্রিম কোর্টে নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে। যেহেতু এর রিভিউ (পূর্ণ বিবেচনা) আপিল বিভাগে শুনানির জন্য রয়েছে, এখন এটি সাবজুডিস ম্যাটার। তাই সাবজুডিস ম্যাটারে কথা বলতে চাই না।’

সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘সংবিধানে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠনের বিধান আছে। কারো বিষয়ে অভিযোগ পেলে সেটি গঠন করতে হবে। অভিযোগটি আইন মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতির কাছে যাবে, রাষ্ট্রপতি এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেবেন।’

jagonews24

তবে সাবেক এই মন্ত্রী এটিও বলেছেন, ‘যে কেউ খেয়াল খুশিমতো একটি অভিযোগ দিল, আর সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন করল, বিষয়টি এতো সহজ না। কারণ যে কেউ তার ইচ্ছা মতো খেয়াল খুশি মতো একটা অভিযোগ করবে। আর সেটি করলে, দেশের সংবিধান ও আইনের শাসন বাধাগ্রস্ত হবে।’

মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের (এইচআরপিবি) চেয়ারম্যান ও আইনজীবী মনজিল মোরসেদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘বিচারপতি ও অন্যান্য আরও কিছু আইনে দেয়া রয়েছে, কিছু প্রতিষ্ঠানের সাংবিধানিক পদধারী পোস্ট যেগুলো আছে তাদের অপসারণ করতে হলে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের যেভাবে অপসারণ করা হয় তাদের অপসারণও একই পদ্ধতি করতে হয়। যেমন ইলেকশন কমিশনার।’

সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল আছে কি-না, এমন প্রশ্নে মনজিল মোরসেদ বলেন, ‘আইন অনুযায়ী যদি কথা বলেন তা হলে বলতে হবে নেই। আর আইনের বাইরে যদি হয়, তাহলে তো বলতেই পারি যে আছে বা নেই। যেটা খুশি সেটাই বলতে পারি। হ্যাঁ, আইন অনুযায়ী নেই।’

তিনি বলেন, ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে বিচারপতিদের মতো অপসারণ করার নিয়ম। যদি তাকে অপসারণ করতে হয় তাহলে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল ছাড়া করার সুযোগ নেই। তবে এখানে যে অভিযোগটি আনা হয়েছে সেটি দুর্নীতির অভিযোগ। দুর্নীতির অভিযোগ আনলে তদন্ত করতে হবে। দোষী সাব্যস্ত করলে তাকে অপসারণ করতে হবে। এখানে একটা স্টেজ, পদক্ষেপের। যদি দেখা যায় যে তদন্তে দোষ পাওয়া গেছে, অপসারণ করতে হবে।’

মনজিল মোরসেদ আরও বলেন, ‘এখানে বলা যায় যে, যদি তার (নির্বাচন কমিশনার) বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ আসে সেটি আগে তদন্ত করতে হবে। তদন্ত করে যদি দেখে যে অভিযোগ পাওয়া গেছে তা প্রমাণিত, তখন তার অপসারণের প্রয়োজনে রাষ্ট্রপতির হস্তক্ষেপের দরকার হবে। সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল ছাড়া তাকে অপসারণ করা যায় না।’

দুর্নীতি তদন্তে দুটো পদ্ধতি রয়েছে উল্লেখ করে এ আইনজীবী বলেন, সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের জন্যে অভিযোগ এলে পরে সেই অভিযোগ রাষ্ট্রপতি সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের মাধ্যমে তদন্ত করেন। এখানে যেহেতু (নির্বাচন কমিশনার) তার যে সেক্রেটারিয়েট সেটা কিন্তু সরকারের অধীনে, প্রধানমন্ত্রীর ক্যাবিনেটের অধীনে। সেক্ষেত্রে কিন্তু সেটা দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদকও) তদন্ত করতে পারে। দুদক তদন্ত করে রিপোর্ট দিতে পারে। অথবা যদি সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন করে তদন্ত করতে চায়, তা হলে সেটাও করতে পারে।’

jagonews24

‘আমি মনে করি, এখানে কোনো বাধ্যবাধকতা নেই যে দুদক তদন্ত করতে পারবে না। কিন্তু অপসারণের সঙ্গে সম্পৃক্ত হলে সেখানে রাষ্ট্রপতির সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলে ছাড়া অপসারণের সুযোগ নেই’—বলেন মনজিল মোরসেদ।

রাষ্ট্রপতি চাইলে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেন কি-না, এমন প্রশ্নে এই আইনজীবী বলেন, ‘রাষ্ট্রপতির ক্ষমতাবলে আইনের বাইরে নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়ার সুযোগ নেই। আইনে যেটুকু আছে রাষ্ট্রপতির ওইটুকুই ক্ষমতা। সংবিধান হলো সর্বোচ্চ আইন। সংবিধানে যেটুকু আছে ওইটুকুই’

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া জাগো নিউজকে বলেন, ‘ঝাপসা ব্যাপারটা তৈরি হয়েছে সেটাতো ষোড়শ সংশোধনীর কারণে। ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যমে যেটা সংসদ সদস্যের হাতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সেটাকে আবার যখন বাতিল করা হলো, অর্থাৎ হাইকোর্ট ও আপিল বিভাগ যখন সেটাকে বাতিল করে দিল। তাহলে কিছু সংখ্যক সিনিয়র আইনজীবী বা অন্য যারা ব্যাখ্যা করেন এই সংবিধানের বিধান নিয়ে, তারা বলার চেষ্টা করছেন যে, বিধানটা বাতিল হলে আরলি তো সুপ্রিম জুডিশিয়ালে ফিরে গেল। কিন্তু রাষ্ট্রপক্ষ থেকে বলা হয়ে থাকে যেহেতু সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের রায়ের বিষয়ে রিভিউ (পূর্ণ বিবেচনার) আবেদন পেন্ডিং, তার মানে এটি সাবজুডিস ম্যাটার। সে হিসেবে এখন ‘সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল’ বলে কিছু নেই। এই জায়গাটাই তখন প্রশ্ন আসে যে, এই অ্যাপ্লিকেশনটা রিভিউ (পূর্ণ বিবেচনার) আবেদন যদি বছরের পর বছরে ফেলে দিয়ে থাকে। একদম চেক অ্যান্ড ব্যালেন্সের প্রশ্নওতো আছে। যেমন আমরা দীর্ঘদিন ধরে ন্যায়পাল নিয়োগ দেয়ার জন্য কথা বলছি যে, এটি সংবিধানে আছে। সেটাও (ন্যায়পালও) নেই, সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলও নেই।’

তিনি বলেন, ‘এখন সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল কিন্তু শুধু জুডিশিয়ারির সঙ্গে রিলেটেড তা কিন্তু নয়, সেটা বুঝতে হবে অন্যভাবে। যেমন ধরুন কনস্টিটিউশনের মাধ্যমে যে সমস্ত পোস্টগুলো ক্রিয়েট করা হয়েছে, যেমন নির্বাচন কমিশনার।’

এই আইনজীবী আরও বলেন, ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনারের যোগ্যতা-অযোগ্যতার পাশাপাশি, তাকে অপসারণের ক্ষেত্রে কী পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে। সেখানে বলা আছে যে, বিচারপতিকে যেভাবে অপসারণ করতে হবে সুপ্রিম জুডিশিয়ালের মাধ্যমে, একই রকমভাবে তাকেও (সিইসি) অপসারণ করতে হবে। এখন সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল থাকা না থাকা শুধু জুডিশিয়ারির ব্যাপার না। এরকম আরও কনস্টিটিউশনাল যতগুলো পোস্ট আছে প্রত্যেকটা জায়গাতে অপসারণের ক্ষেত্রে এ ধরনের বিধি-বিধান রাখা হয়েছে। ফলে সেখানেও যদি কেউ অন্যায়-অনিয়ম কিছু করে থাকে, তাকে কিন্তু আইনের আওতায় আনার কোনো রকমে সুযোগ থাকে না। এই আর্গুমেন্টগুলোর পাশাপাশি আরও একটা আর্গুমেন্ট আছে। যেগুলো স্যাটেল না হলে, আছে বা না উত্তর দেয়াটা খুবই মুশকিল। কারণ হলো আমি ডিসিশন দিয়ে দিচ্ছি বা সিদ্ধান্ত দিয়ে দিচ্ছি সে রকম হয়ে যাবে।’

তিনি বলেন, ‘ইন্টারপিটিশন চাইলে ইন্টারপিটিশন করতে পারব আমরা। ইন্টারপিটিশনটাই বলছি, তাইলে একটা ধারার ইন্টারপিটিশন বললাম। সেটি হলো জেনারেল ক্লজেজ অ্যাক্টের সেকশন আর্টিকেল সিক্স অনুযায়ী যদি কোনো আইন বাতিল করা হয়ে থাকে, সে বাতিল করা আইনটি রিভাইভ করার জন্য আরেকটা যদি গেজেট নোটিফিকেশন করা না হয়ে থাকে তাহলে সেটি অটোমিটিক্যালি রিভাইভ করে না, পুনর্জীবন লাভ করে না। মৃত আইন নতুন করে যদি বাতিল করা হলো, কথার কথা ষোড়শ সংশোধনী দিয়ে, তাহলে ষোড়শ সংশোধনীটাই বাতিল হয়ে গেল। সেক্ষেত্রে সরকার যদি একটা গেজেট নোটিফিকেশন করে না বলে যে, ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের কারণে এই বিষয়টা আবার পুনর্জীবিত হলো, একপাতার একটি গেজেট দিয়ে হলেও যদি না বলে, তা হলে ল’টা অটোম্যাটিক্যালি রিভাইভ করে না। এটা হচ্ছে জেনারেল ক্লজেজ অ্যাক্ট আর্টিক্যাল সিক্স-এর বক্তব্য।’

‘তবে এখানে একটি কিন্তু আছে। সেটা হলো, এই পাওয়ারটা দেয়া হচ্ছে অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ পাওয়ার অ্যাডমিনিস্ট্রেশনকে, কোনো একটা আইন জাতীয় সংসদ যদি বাতিল করে, একই সংসদ আবার সেটি রিভাইভ করতে পারবে’—বলেন জ্যোতির্ময় বড়ুয়া।

jagonews24

এই আইনজীবী আরও বলেন, ‘এখন ল’টা বাতিল সংসদ করেনি, করেছে কোর্ট। এ পর্যায়ে প্রশ্ন আসতে পারে যে, কোর্টের আসলে ল’র স্ক্রুটিনি করার কোনো সুযোগ আছে কি-না, ল’ বাতিল করেতে পারে কি-না? এটা আমাদের দেশের সুপ্রিম কোর্টের ডিসাইডেড কেইস আছে, একটা না একাধিক কেইস রয়েছে। সেখানে সুপ্রিম কোর্ট বলছে যে, সুপ্রিম কোর্ট চাইলে ল’ বাতিল করতে পারবে। হাইকোর্ট এবং আপিল বিভাগ দুটো বিভাগেরই এই এখতিয়ার আছে। এটা অলরেডি ডিসাইটেড ম্যাটার, অনেকগুলো জাজমেন্ট আছে। আইনটা যেহেতু বাতিল করেছে সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ এবং আপিল বিভাগ, সুতরাং এটা ওই অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ অথরিটিকেই আবার গেজেট নোটিফিকেশন করতে হবে এই বাধ্যবাধকতা থাকে না, কারণ হচ্ছে তখন এই ক্ষমতাটা অ্যাডমিনিস্ট্রেশন থেকে বা পার্লামেন্ট থেকে চলে আসল কোর্টের হাতে। কোর্ট যদি বাতিল করে দিয়ে থাকে তা হলে, আগের ল’টাই রিভাইভ করে যাবে এই আর্গুমেন্টটা অনেক স্ট্রং, অনেক প্রবল। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে বলা যায়, সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল আছে। যতই রিভিউ (পূর্ণ বিবেচনার) আবেদন পেন্ডিং থাকুক না কেন।’

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির জাগো নিউজকে বলেন, ‘ষোড়শ সংশোধনীর মামলায় আপিল বিভাগের রায় অনুযায়ী সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল পুনর্প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বর্তমানে এই বিধান কার্যকর আছে। কারণ, রাষ্ট্রপক্ষ রিভিউ আবেদন দায়ের করলেও আদালত কোনো প্রকার স্থগিতাদেশ দেয়নি। ফলে এই বিধান কার্যকর রয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিবৃন্দ বা নির্বাচন কমিশনারবৃন্দ সাংবিধানিক পদ ধারণ করেন। তাদের বিষয়ে কোনো অভিযোগ আসলে সেক্ষেত্রে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের মাধ্যমেই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।’

প্রসঙ্গত, গত ১৪ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপতির কাছে ৪২ বিশিষ্ট নাগরিকের পাঠানো চিঠিতে বলা হয়, ‘কে এম নুরুল হুদার নেতৃত্বে বর্তমান নির্বাচন কমিশনের সদস্যরা ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই বিভিন্নভাবে গুরুতর অসদাচরণে লিপ্ত হয়েছেন। কমিশনের সদস্যরা একদিকে গুরুতর আর্থিক দুর্নীতি ও অনিয়মের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন, যা অভিশংসনযোগ্য অপরাধ।’

পরে গত ৭ জানুয়ারি সুপ্রিম কোর্টের ১০ আইনজীবী ইসির বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ এনে দুদকের কাছে তদন্তের দাবি জানান। এরপর সুপ্রিম কোর্টের আরও ১০১ জন আইনজীবী একই ধরনের অভিযোগ করে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠনের আর্জি জানান।

এফএইচ/জেডএইচ/এইচএ/জিকেএস