চিড়িয়াখানার উন্নয়নে ১৫ বছরের মহাপরিকল্পনা : যুক্ত হচ্ছে ডলফিন শো
টেলিভিশন কিংবা বইয়ের পাতায় স্থান পাওয়া জীবজন্তুদের খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ মেলে ঘনজঙ্গল বেষ্টিত চিড়িয়াখানায়। ঢাকার মিরপুরে অবস্থিত জাতীয় চিড়িয়াখানার ১৮৬ দশমিক ৬৩ একর জমিতে বাঘ, ভাল্লুক, হরিণ, অজগরসহ প্রায় তিন হাজার প্রাণীর বাস। দীর্ঘদিন চিড়িয়াখানায় কোনো নতুনত্ব না থাকায় দর্শক হারাচ্ছে বিনোদন কেন্দ্রটি। আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সিঙ্গাপুরের চিড়িয়াখানার আদলে জাতীয় চিড়িয়াখানাকে ঢেলে সাজানোর পরিকল্পনা করছে প্রাণিসম্পদ অধিদফতর।
ইতিহাস ঘেটে জানা যায়, ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে ঢাকার শাহবাগে তৎকালীন নবাবরা একটি ব্যক্তিগত চিড়িয়াখানার গোড়াপত্তন করেছিলেন। পঞ্চাশের দশকের শেষে সুপ্রিম কোর্টের সামনে বর্তমান জাতীয় ঈদগাহ এলাকায় চার থেকে পাঁচ একর জায়গাজুড়ে ছোট আকারের একটি চিড়িয়াখানা স্থাপন করা হয়। পরবর্তীতে স্বাধীনতার পরে ১৯৭৪ সালে বর্তমান অবস্থানে চিড়িয়াখানাটি স্থানান্তরিত হয়। ওই বছরের ২৩ জুন চিড়িয়াখানাটি উদ্বোধন ও সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করা হয়।
চিড়িয়াখানা ও প্রাণিসম্পদ অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, প্রায় ৪৭ বছর পর চিড়িয়াখানার উন্নয়নে ১৫ বছর মেয়াদি মহাপরিকল্পনা হাতে নেয়া হয়েছে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের চলমান জন্মশত বার্ষিকীতে শুরু হতে পারে চিড়িয়াখানার আধুনিকায়নের কাজ। এ বছরের জুনেই মহাপরিকল্পনাটি চূড়ান্ত করবে চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ। সিঙ্গাপুরের বিখ্যাত চিড়িয়াখানা নির্মাতা প্রতিষ্ঠান বারনার্ড হ্যারিসন অ্যান্ড ফ্রেন্ডস লিমিটেড চিড়িয়ানার আধুনিকায়নের কাজ করতে আগ্রহী।
জানা গেছে, আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ঢাকা ও রংপুরের চিড়িয়াখানার আধুনিকায়ন করতে চায় অধিদফতর। কয়েক বছর আগে প্রায় ৩৫ কোটি টাকা ব্যয়ে দুই চিড়িয়াখানার উন্নয়নের পরিকল্পনা ছিল। তবে অনিয়ম, আধুনিকায়নের রূপরেখা তৈরির জন্য যে পরামর্শক প্রতিষ্ঠানকে নিয়োগ দেয়া হয়েছিল তাদের যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন থাকায় সেখান থেকে সরে আসে অধিদফতর। তবে পুনরায় চিড়িয়াখানা দুটির আধুনিকায়ন প্রকল্পে নজর দিয়েছে অধিদফতর।
চিড়িয়াখানা সূত্রে জানা গেছে, মহাপরিকল্পনা অনুযায়ী চিড়িয়াখানার ডিজিটাল ম্যাপ ও লে আউট প্ল্যান করা হয়েছে। ইনসেপশন ও ইন্টারিং রিপোর্ট করা হয়েছে। ডেভেলপমেন্ট প্ল্যান ডকুমেন্টস তৈরিসহ বাকী কাজ আগামী জুনের মধ্যেই করা হবে।
এ প্রসঙ্গে চিড়িয়াখানার কিউরেটর আবদুল লতিফ জাগো নিউজকে বলেন, ‘একটা মাস্টারপ্ল্যান হচ্ছে। এ বছরের জুনের মধ্যে এই প্ল্যান শেষ হবে। প্ল্যান অনুযায়ী ঢাকা ও রংপুর চিড়িয়াখানার আধুনিকায়ন করা হবে।’
তিনি বলেন, ‘বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশও এগিয়ে যাচ্ছে। আমাদের জাতীয় চিড়িয়াখানাকেও আধুনিকায়ন করতে চাই। কোনো ডেভেলপমেন্ট যদি আমরা করতে চাই তখন মাস্টারপ্ল্যানের প্রয়োজন। মাস্টারপ্ল্যানের চারটি ধাপ। এখন আমরা মাত্র দুটি ধাপ সম্পন্ন করছি। আমরা ইনসেপশন ও ইন্টারিং রিপোর্ট করেছি। এখন ড্রাফট ও ডিপিডি তৈরি বাকী। এর মধ্যে আমরা ডিজিটাল ম্যাপ পেয়েছি, লে আউট প্ল্যান পেয়েছি। বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত এখানে উঠে এসেছে। এটা ফাইনাল হলে ডিজিটাল ড্রাফট করা হবে।’
পাঁচটি জোনে বিভক্ত হচ্ছে চিড়িয়াখানা
আফ্রিকা অঞ্চলের প্রাণী, বাংলাদেশি প্রাণী, গৃহপালিত প্রাণী, অন্যান্য প্রাণী ও নাইট সাফারি এই পাঁচ জোনে বিভক্ত হচ্ছে চিড়িয়াখানা। সিঙ্গাপুরের চিড়িয়াখানার আদলে হবে নাইট সাফারি। যেখানে পড়ন্ত বিকেলে কিংবা রাতের রঙিন আলোয় বিভিন্ন অ্যাক্রোবেট দেখবেন দর্শকরা। এ ছাড়া রাতেও প্রাণীদের দেখতে পারবেন তারা। এর ফলে চিড়িয়াখানা শুধুমাত্র দিনের বিনোদন কেন্দ্র হবে না। দিন ও রাত দুই বেলায়ই চিড়িয়াখানায় বিনোদন নিতে পারবেন দর্শনার্থীরা। এ ছাড়া নতুন নতুন আরো প্রজাতির প্রাণী আনা হবে। সামুদ্রিক প্রাণীর জন্য অ্যাকুরিয়াম স্থাপন করা হবে।
কিউরেটর আবদুল লতিফ বলেন, ‘পুরো চিড়িয়াখানাকে মাস্টারপ্ল্যানে পাঁচ জোনে ভাগ করা হয়েছে। জোনগুলো হয়তো একবারে বাস্তবায়ন হবে না। আমরা সুপারিশ করেছি তিন বছরে একটা জোন যেন করতে পারি। অন্তত ১৫ বছরে হলেও এটা বাস্তবায়ন হয়। প্রথম ধাপে আমরা বাংলাদেশি বা সুন্দরবন ভিত্তিক প্রাণী ও আফ্রিকা অঞ্চলের প্রাণী নিয়ে কাজ করবো। আমাদের অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ ভবন নির্মাণ প্রথম ধাপে করার পরিকল্পনা আছে।’
চিড়িয়াখানার লেকে বার্ড শো, ডলফিন শো
প্রায় এক বছর ধরে বন্ধ আছে জাতীয় চিড়িয়াখানার পশ্চিমপার্শ্বের লেকে অবস্থিত পিকনিক স্পট- উৎসব দ্বীপ ও নিঝুম দ্বীপ। কারণ হিসেবে চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ বলছে, পিকনিক স্পট ব্যবহারে গুচ্ছ দর্শনার্থী কিংবা শুটিং গ্রুপগুলো নিয়ম মানে না। ফলে গত বছরের শুরু থেকেই বন্ধ এই দুটি স্পট। তবে এবার সেই লেক আধুনিকায়নের চিন্তা করছে চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ। চিড়িয়াখানার দক্ষিণে আরেকটি লেক ব্যবহারের চিন্তা আছে নতুন মহাপরিকল্পনায়। লেকগুলো ব্যবহার করে সেখানে রোকওয়ে, বার্ড শো ও ডলফিন শো করার কথা পরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। লেকে প্যাডেল সিস্টেম নৌকার ব্যবস্থাও রাখার প্রস্তাব পরিকল্পনায় আছে বলে জানা গেছে।
ভ্রমণপিপাসুদের জন্য ভাসমান রেস্তোরাঁ, ট্রাভেলকার
নতুন দিনের দর্শকদের চাহিদার কথা মাথায় রেখে মুভ অ্যাবল বা ভাসমান রেস্তোরাঁর প্রস্তাব দেয়া হয়েছে নতুন পরিকল্পনায়। এ ছাড়া শিশুদের জন্য মিনি পার্কের ব্যবস্থা থাকবে। শিশুপার্কে ইলেকট্রিক ট্রেন, মেরি গো রাউন্ড, ম্যাজিকশোসহ আরো কয়েকটি আইটেম থাকবে। আর মুজিববর্ষ শেষ হওয়ার আগেই প্রতিবন্ধী, বৃদ্ধ বা পাঁচ থেকে ছয় সদস্যের পরিবার যেন পুরো চিড়িয়াখানা ঘুরে দেখতে পারে- সেজন্য ট্রাভেলকার সংযুক্ত হচ্ছে।
কিউরেটর আবদুল লতিফ বলেন, ‘এগুলো অবাস্তব বা উচ্চা বিলাসী মনে হতে পারে। তবে সময়ের প্রয়োজনে নতুন প্রজন্মের জন্য এসবের দরকার হবে। আমরা প্রতিবন্ধী, বৃদ্ধ বা ছোট পরিবারের লোকদের পুরো চিড়িয়াখানা ঘুরিয়ে আনতে ট্রাভেলকারের চিন্তা করছি। ছয় বা ১০ আসনের ট্রাভেলকার হবে। লেকে নৌকা চালানোর কথা ভাবছি। সবকিছুই আমাদের মাস্টারপ্ল্যানে আছে।’
তিনি বলেন, ‘সিঙ্গাপুরের চিড়িয়াখানা নির্মাতা প্রতিষ্ঠান বারনার্ড হ্যারিসন অ্যান্ড ফ্রেন্ডস লিমিটেড আমাদের সঙ্গে কাজ করতে চাইছে। বিশ্বের অনেক নামীদামি চিড়িয়াখানা তাদের হাতে করা। তাদের আমরা এই কাজটি দিয়েছি। আমরা আশা করছি কাজটা খুব ভালো হবে। নাইট সাফারিটাও খুব আকর্ষণীয় হবে। আগামী জুনে মাস্টার প্ল্যানের কাজ শেষ হবে। এরপরে আমরা ফেজ বাই ফেজ কাজ করবো।’
এসএম/ইএ/এমএস