দাউদপুর জুড়ে শুধুই ইটভাটা
যেদিকে চোখ যায় শুধুই ইটের ভাটা। এ যেন ইটভাটার ঘরবসতি। ফসলি জমি, নদীর তীরে সারি সারি ইটভাটা। বলা হচ্ছে রূপগঞ্জের দাউদপুর ইউনিয়নের কথা। এ ইউনিয়নের শুরু থেকে শেষ অবধি কেবলই ইটভাটা।
দাউদপুরের অধিকাংশ মানুষই কৃষিকাজের উপর নির্ভরশীল। ইটভাটার কারণে এ এলাকার কৃষি আজ বিপর্যয়ের মুখে। ইটভাটার বিষাক্ত ধোয়া আর ধুলাবালিতে দাউদপুর ইউনিয়নের কৃষি ও পরিবেশ বিভীষিকাময় হয়ে উঠেছে। ইটখোলার মাটি বহনকারী ইছারমাথা ( ট্রাক্টর) চলাচলের কারণে এ এলাকার রাস্তাগুলো ভেঙে-চুরে একাকার হয়ে গেছে। এক কথায় বাসযোগ্যহীন হয়ে পড়েছে দাউদপুর।
স্থানীয়রা জানান, দাউদপুরে প্রায় দেড় শতাধিক ইটভাটা রয়েছে। এ সকল ইটভাটা এলাকার ভেতরে ফসলি জমিতে গড়ে উঠেছে। এমনকি বাড়িঘরের পাশে। তাছাড়া শীতলক্ষ্যা নদীর তীর ঘেঁষে সারি সারিভাবে গড়ে উঠেছে ইটের ভাটা। দেখলে মনেই হবে না এটা একটা ইউনিয়ন। সরকারি অনুমোদন ছাড়াই এ সকল ইটভাটা গড়ে উঠেছে। পরিবেশ আইন লঙ্ঘন করে প্রশাসনের নাকের ডগায় একের পর এক ইটখোলা গড়ে উঠলেও প্রশাসন কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না বলে স্থানীয়দের অভিযোগ।
স্থানীয় এলাকাবাসী জানায়, দাউদপুরের রাস্তাগুলো দিয়ে প্রতিদিন প্রায় ২শ’ ইছারমাথা চলাচল করে। ফলে রাস্তাগুলো ভেঙে চৌচির হয়ে যায়। বছরে এ সকল রাস্তা মেরামত বাবদ খরচ হয় প্রায় কয়েক কোটি টাকা। রাস্তায় গাড়ি কিংবা হেঁটে গেলে রুমাল চেপে যেতে হয়।
দাউদপুরের দুয়ারা এলাকার হাতেম আলী জাগো নিউজকে বলেন, বাজান, ইডের খোলার লেইগ্যা আমরা শান্তিত নাই। রাস্তাগুলাইন ভাইঙ্গা ফালাইছে। হের পরে ধূলার লেইগ্যা আডন ( হাঁটা) যায় না।
আগলা গ্রামের কয়েকজন কৃষক বলেন, স্যার এই গেরামো হগল ধরনের ফসল অইতো। অহন ইটখোলার ধুলা আর ধুয়ার লেইগ্যা ফসলই অয় না। গেরামডা জুইরা ইটখোলা। এগুলাইন বদ্ধকরন স্যার, আমরা দোয়া করমু।
অভিযোগ রয়েছে, স্থানীয় প্রশাসন, থানা পুলিশ, মস্তান আর কতিপয় কার্ডধারী সাংবাদিকদের ম্যানেজ করেই অবৈধ ইটখোলার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। থানা পুলিশ ও প্রশাসনকে প্রতি মাসে মোটা অংকের মাসোয়ারা দেয়ারও অভিযোগ রয়েছে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, দাউদপুরের দিগন্তজোড়া ফসলের মাঠ নষ্ট করে গড়ে তোলা হয়েছে ইটখোলা। রূপগঞ্জ থানা থেকে প্রায় ৭ কিলোমিটার পরেই দাউদপুর ইউনিয়নের শুরু। এখান থেকেই শুরু ইটখোলারও। গ্রামের আঁকাবাঁকা মেঠোপথ পেরিয়ে রূপগঞ্জ থানার শেষ সীমানা পর্যন্ত চোখে পড়বে ইটখোলা আর ইটখোলা। দেখে মনে হবে এ যেন ইটখোলার ঘরবসতি। ফসলি জমি, স্কুল-কলেজ, মসজিদ-মাদরাসা, বাড়ির সীমানায়, নদীর তীর ঘেঁষেই এ সকল ইটখোলাগুলো গড়ে উঠেছে। লোকালয় ও নদী থেকে ৩ কিলোমিটার দূরে ইটখোলা করার নিয়ম থাকলেও কেউ তা মানছে না। কৃষি জমিতে ইটখোলা তৈরির আইনগত নিষেধ থাকলেও নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করেই দাউদপুরে ইটখোলা গড়ে উঠেছে।
সরেজমিনে আরও দেখা গেছে, এ সকল ইটখোলার সামনে কাঠ আর টায়ারের স্তুপ। এগুলো পোড়ানোর নিয়ম না থাকলেও এ এলাকার ইটখোলাগুলো তা মানছে না। বিষাক্ত টায়ার পোড়ানোর কারণে এলাকার বাতাসও দূষিত হয়ে পড়েছে। ফলে মানুষ শ্বাসকষ্ট, চর্ম, হাপানিসহ নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। শুধু তাই নয়, এলাকার গাছপালাও মরে যাচ্ছে। ফসলি জমির উর্বর মাটি জোর করে কেটে নিচ্ছে খোলা মালিকরা। অনেক ইটখোলা নদী ও খাল দখল করে গড়ে উঠেছে।
দুয়ারা এলাকার রমজান আলী বলেন, কি কমু বাপ? আমাগো কষ্টের কতা কেউ লিহে না। গাছপালা সব মইরা যাইতাছে।
স্থানীয় গৃহবধূ রায়হানা সুলতানা জাগো নিউজকে বলেন, ইটখোলার ধুলার কারণে টেকাই দায়। ধুলাবালি পরিষ্কার করতে করতে জীবন যায়। ইটভাটার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার কেউ নেই?
কুলসুম বেগম বলেন, ধুলার লেইগ্যা অনেক মাইনষের অসুখ অইতাছে। অনেক মানুষ বাড়িঘর ছাইড়া যাইতাছে গা।
এলাকাবাসীর অভিযোগ, উপজেলা প্রশাসন, থানা পুলিশ, স্থানীয় পরিবেশবাদী সংগঠন, স্থানীয় মস্তান, রাজনৈতিক দলের নেতা, কার্ডধারী কতিপয় সাংবাদিকদের সঙ্গে ইটখোলা মালিকদের রয়েছে সুসম্পর্ক। এদের প্রতিমাসে মাসোহারা দেয়া হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। এ
লাকাবাসী বলেন, ইটখোলার বেশিরভাগ মালিকই প্রভাবশালী। ফলে ভয়ে তারা এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারছেন না। স্থানীয় ইউনিয়ন চেয়ারম্যানও রহস্যজনক কারণে নীরব ভূমিকা পালন করছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, রূপগঞ্জ উপজেলার দাউদপুর ইউনিয়নে প্রায় দেড় শতাধিক ইটখোলা রয়েছে। সরকারি হিসেবে এর সংখ্যা ৩০। এদের অধিকাংশের সরকারি অনুমোদন নেই। নামমাত্র ইউনিয়ন পরিষদের ট্রেডলাইসেন্স নিয়ে ইটখোলাগুলো চলছে। ইটখোলা মালিকদের নিয়ে গড়ে উঠেছে শক্তিশালী সংগঠন ইটখোলা মালিক সমিতি। প্রশাসন আর পরিবেশ অধিদফতরের চাপ এড়াতেই এ সংগঠন।
অনুসন্ধানে আরো জানা যায়, এ সকল ইটখোলাগুলোতে প্রায় শ্রমিক নির্যাতনের ঘটনা ঘটে। সম্প্রতি র্যাব-১১ এর একটি দল দুয়ারা এলাকার একটি ইটখোলায় অভিযান চালিয়ে নারী-পুরুষ ও শিশুসহ ১২ জনকে বন্দিদশা থেকে উদ্ধার করেছে। তবে স্থানীয় ইটখোলার মালিকরা বলছেন ভিন্ন কথা। তাদের বক্তব্য, ইটখোলাগুলো হওয়ায় প্রায় ৫০ হাজার লোকের কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়েছে।
দুয়ারা এলাকার হেলালউদ্দিন ব্রিকসের মালিক হেলালউদ্দিনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, আমরা তো ক্ষতি করছি না। ইটখোলা হওয়ার কারণে মানুষ কাম কইরা খাইতে পারতাছে।
ইটখোলা মালিক সমিতির সভাপতি মজিবুর রহমান বলেন, ইটখোলার কারণে তো কোনো ক্ষতি হচ্ছে না। পরিবেশ দূষিত হচ্ছে শিকার করে তিনি বলেন, উপকারের পাশাপাশি কিছুটা ক্ষতি হওয়াটাই স্বাভাবিক।
দাউদপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান শরীফ আহম্মেদ টুটুল জাগো নিউজকে বলেন, সরকারি অনুমতি ছাড়া ইটভাটা গড়ে তোলাটা অন্যায়। তবে ইটভাটার কারণে মানুষের কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হচ্ছে।
রূপগঞ্জ থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মজিবর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, এ সকল ব্যাপারে আমি কিছু জানি না। আমার কোনো কর্মকর্তা যদি জড়িত থাকে ব্যবস্থা নিবো।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. লোকমান হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, অনুমোদিত নয় এমন ইটভাটার বিরুদ্ধে শিগগিরই ব্যবস্থা নেয়া হবে।
এসএস/এমএস