‘আমাক বলে, পাঁচ লাখ ট্যাকা নিয়ে মাফ কইরি দিতি’
পাবনার আটঘরিয়া উপজেলায় গত বছরের ১১ জানুয়ারি এক প্রতিবন্ধী মেয়ে (১৭) ধর্ষণের শিকার হয়। এরপর কয়েক মাসের চিকিৎসা শেষে কিছুটা সুস্থ হয়ে উঠেছে। তবে সে আর রাতে ঘুমাতে পারে না। সারারাত মাটির ঘরের মেঝেতেই বসে থাকে। বিছানায় ঘুমাতে চায় না। মাটিতে বসে থাকতে থাকতে তার ঠান্ডা লেগে গেছে। ঘুমের ওষুধ খাইয়ে তাকে ঘুম পাড়ানো হয়। আবার ঘুম ভেঙে গেলেই ছটফট করে। এভাবেই চাপা কণ্ঠে ধর্ষণের শিকার মেয়েটিকে নিয়ে কষ্টের কথা বলছিলেন তার মা।
সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, টিনের চারচালা একটি ঘরে প্রতিবন্ধী মেয়েকে নিয়ে মায়ের বসবাস। স্বামী নেই, একমাত্র মেয়েই তার বেঁচে থাকার ভরসা। বাড়ির ছোট্ট উঠানে বিছানো পাটিতে মেয়েকে নিয়ে বসে আছেন তিনি। কাছে যেতেই প্রতিবন্ধী মেয়েটি চেচামেচি করতে থাকে। পরে তার মা বলেন, ‘আপনাকে আমার মেয়ে বসতে বলছেন’।
এর মাঝে মেয়েটি বারবার মায়ের হাত থেকে ছুটে পাশে বসে থাকা মামার কাছে চলে যেতে চাচ্ছিল। মা তাকে ধরে রাখার চেষ্টা করছেন। কারণ, মেয়েটি ঠিকভাবে হাঁটতেও পারে না। তার মা কানের কাছে মুখ নিয়ে ‘লোকজন আসছে, এমন করলে বকা দেবে’ বলতেই মেয়েটি গুটিসুটি মেরে মায়ের কাছে বসে থাকল। কিছুক্ষণ পর আবার বাড়ির উঠানে হেঁটে বেড়াতে থাকে।
কথায় কথায় মেয়েটির মা বলেন, ‘মাইয়া আমার খুব আঘাত পাইছে। সারারাত না ঘুমাইয়া চোখের সামনে ছটফট করে। এতা আমি দেখমো কী কইরে? বাজান, আপনারা আমার মাইয়ার জন্য কিছু একডা করেন। আমার এই প্রতিবন্ধী মাইয়া ছাড়া আর কেহ নাই।’
মেয়েটি ঠিকভাবে হাঁটতেও পারে না
তিনি আরও বলেন, ‘আমার মাইয়ার সঙ্গে অন্যায় করছে তারা! করিমের বউ আইসা কয়, আমার স্বামীরে মাফ কইরা দাও, বাঁচাই দাও। আমাক বলে, লোকগো বলে যে, দশ কাঠা ভুঁই (জমি) লেইখা দিবো যাতে মাফ কইরা দিই। আবার বলে যে নাহলি পাঁচ লাখ ট্যাকা নিয়ে মাফ কইরি দিতি। আমি তো এই প্রতিবন্ধী মাইয়ার ইজ্জত বেইচ্চা চারআনাও খামু না। আমি শুধু বিচার চাই।’
প্রতিবেশীরা বলেন, ‘প্রতিবন্ধী মেয়েটি এমনিই অসুস্থ। কথা বলতে পারে না। মুখ দিয়ে লালা ঝরে। ওর মা সবসময় দেখে রাখে। ঘটনার দিন ওর মা পাশের এলাকায় ভাইয়ের বাড়িতে গেলে আব্দুল করিম আর বিল্লাল মেয়েটির সঙ্গে খারাপ কাজ করে। ওর মা বাড়িতে আসার সঙ্গে সঙ্গে টের পেলে করিম ও বিল্লাল পালিয়ে যায়। পরে মেয়েটিকে রক্তাক্ত অবস্থায় দেখে ওর মা দিশেহারা হয়ে পড়েন। পরে মেয়েটিকে আটঘরিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়।’
তারা আরও বলেন, ‘খুব অসহায় পরিবার, মেয়েটির মা ছাড়া কেউ নেই। কী যে কষ্ট করে মেয়েটিকে নিয়ে ওর মা! আমরা এই অন্যায় কাজের ন্যায্য বিচার চাই। আপনারা একটু লেখেন আর পুলিশকে বলেন। ওর মা তো এসবের কোনো কিছুই বোঝে না। আর কার কাছেই বা যাবে মেয়েটির জন্য।’
মেয়েটির মামা জাগো নিউজকে বলেন, ‘ঘটনার দিন আমার বোন আমার বাড়িতে আসছিল। আমার দুই সন্তানকে টিকা খাইয়ে নিয়ে আসার পর বাড়িতে গেলে দেখে প্রতিবন্ধী ভাগনি রক্তাক্ত অবস্থায় মেঝেতে পড়ে আছে। আমরা নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলাও করেছিলাম। দুজনকে পুলিশ গ্রেফতারও করছিল। দুজনের মধ্যে বিল্লাল নাকি এখন জামিনে বাইরে আছে শুনি।’
টিনের ঘরে প্রতিবন্ধী মেয়েকে নিয়ে মায়ের বসবাস
তিনি আরও বলেন, ‘এখন করিমের পরিবার টাকা দিতে চায়, ভুঁই (জমি) দিতে চায়। আমরা তো এসব খাব না। প্রতিবন্ধী মেয়েটা কতো কষ্ট করছে। আপনারা যা পারেন করেন, যাতে একটা সুষ্ঠু বিচার হয়।’
করিম ও বিল্লালের বিষয়ে খোঁজ নিতে কথা হয় স্থানীয়দের সঙ্গে। তারা জানান, করিম নির্দিষ্ট কোনো কাজ করেন না। বিল্লাল তার সঙ্গেই ঘোরাফেরা করেন। তাদের বিরুদ্ধে গ্রামে চুরির অভিযোগও আছে। মামলা না হওয়ার কারণেই নাকি বারবার পার পেয়ে যান তারা।
এদিকে মেয়েটির মা বুধবার (১৩ জানুয়ারি) রাতে এই প্রতিবেদককে ফোন করে বলেন, ‘আমি আর আমার ভাই মিলে মামলা করছিলাম বলে করিমের বউ এখন আমাদের ক্ষতি করার চেষ্টা করছে। আমার ভাইয়ের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ করে মামলা করার চেষ্টা করছে। তারা এখন দেখছে, করিম তো অপরাধী তাই ওর বউ আমার ভাইকে ফাঁসাতে চাচ্ছে। আমার ভয় লাগছে!’
ধর্ষণের ঘটনায় মামলার পর দুজনকে গ্রেফতার করেছিল পুলিশ
মামলার তদন্ত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ডিএনএ পরীক্ষার জন্য টাকা নেয়ার অভিযোগও তোলে ভুক্তভোগী পরিবারটি। তবে তদন্ত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ওঠা টাকা নেয়ার অভিযোগ অস্বীকার করেন আটঘরিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আসিফ মোহাম্মদ সিদ্দিকুল।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘করোনা পরিস্থিতির কারণে ডিএনএ টেস্টের রিপোর্ট হাতে পেতে দেরি হয়েছিল। আমরা রিপোর্ট হাতে পেয়েছি। সেখানে করিমের ডিএনএ ম্যাচ করেছে। গত মাসেই করিম ও বিল্লালকে আসামি করে আদালতে অভিযোগপত্র দেয়া হয়েছে। আমি শুনেছি, বিল্লাল জামিনে আছে। কারণ জামিন হলে তো আমাদের কাছে কোনো তথ্য থাকে না।’
টাকা নেয়ার অভিযোগের বিষয়ে ওসি আসিফ মোহাম্মদ বলেন, ‘টাকা নেয়ার বিষয়টি আমার জানা নেই। আর টাকা নেয়ার তো কোনো প্রশ্নই আসে না। কারণ মামলা তদন্ত হলে সরকারিভাবে তদন্ত ব্যয় দেয়ার ব্যবস্থা আছে।’
এওয়াইএইচ/এমএসএইচ/জেআইএম