শাস্তি বাড়লেও কমছে না ধর্ষণ-নির্যাতন
গত বছরের শুরুতেই রাজধানীর কুর্মিটোলা এলাকায় ধর্ষণের শিকার হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রী। এ ঘটনার পর সারাদেশে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। রাস্তায় নেমে আসে ছাত্র-শিক্ষকসহ সচেতন মহল। মাস দুয়েকের মাথায় দেশে করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) সংক্রমণ শুরু হয়। এতে স্থবির হয়ে পড়ে পুরো দেশ। কিন্তু তারপরও নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা কমেনি, বরং মাসের পর মাস ধর্ষণ, সংঘবদ্ধ ধর্ষণ, শিশু নির্যাতন ও নিপীড়নের সংখ্যা বেড়েছে।
এরই ধারাবাহিকতায় গত ২৫ সেপ্টেম্বর রাতে সিলেটের এমসি কলেজ ছাত্রাবাসে তুলে নিয়ে এক গৃহবধূকে স্বামীর সামনে পালাক্রমে ধর্ষণ করেন সাইফুর রহমানের নেতৃত্বে কয়েকজন ছাত্রলীগকর্মী। ওই ঘটনার কদিন পর ৪ অক্টোবর নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ উপজেলায় এক গৃহবধূকে বিবস্ত্র করে একদল যুবকের পাশবিক কায়দায় নির্যাতনের ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে। এ নিয়ে দেশজুড়ে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে।
গত ৯ অক্টোবর বিকেলে রাজধানীর শাহবাগে ‘ধর্ষণ ও বিচারহীনতার বিরুদ্ধে বাংলাদেশ’ ব্যানারে ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনবিরোধী মহাসমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে নারী নির্যাতন বিশেষ করে ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড করার দাবি জানানো হয়। শাহবাগ থেকে সেই আন্দোলন সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। এই গণআন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে সরকার নারী ও শিশু নির্যাতন আইন, ২০০০ এর কয়েকটি ধারা সংশোধন করে। এর মধ্যে অন্যতম হলো— ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড অথবা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। আগের আইনে ধর্ষণের শাস্তি ছিল যাবজ্জীবন কারাদণ্ড।
গত ১৪ অক্টোবর এ সংশোধিত আইন অধ্যাদেশ আকারে জারি হয়। কিন্তু শাস্তি বাড়িয়ে অধ্যাদেশ জারির পরও ধর্ষণ-নির্যাতন কমছে না।
মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের মতে, ২০২০ সালে ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৬২৬ শিশু
নারী ও শিশু অধিকার নিয়ে কাজ করা কয়েকটি বেসরকারি সংগঠনের সাম্প্রতিক তথ্যে দেখা যায়, আইনের প্রয়োগ এবং শাস্তি বাড়ানো সত্ত্বেও থামেনি এসব পাশবিকতা। বরং করোনা মহামারির মধ্যে আগের চেয়ে বেড়েছে ধর্ষণ-নিপীড়নের ঘটনা।
মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন-এমজেএফ সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে জানায়, ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত মোট ৬২৬ শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে ১৩ থেকে ১৮ বছর বয়সী শিশুরাই ধর্ষণের শিকার হয়েছে বেশি। এরপর ৭ থেকে ১২ বছর বয়সী শিশু রয়েছে।
৩১ ডিসেম্বর মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) এক সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, ২০২০ সালে এক হাজার ৬২৭ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। দুই বছর আগের তুলনায় এ সংখ্যা দ্বিগুণ। ২০১৮ সালে ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন ৭৩২ জন নারী, ২০১৯ সালে এ সংখ্যা ছিল এক হাজার ৪১৩।
সরকার সংশ্লিষ্টরা আশা করছিলেন, ধর্ষণের সাজা মৃত্যুদণ্ড করায় এ ধরনের অপরাধ কমে আসবে। কিন্তু আসকের ওই সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, ১৪ অক্টোবর অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের আইন কার্যকরের পর থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ১৬০টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটে।
ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড দাবিতে গত বছরের মাঝামাঝি সময় আন্দোলনে উত্তাল ছিল রাজপথ
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের (লিগ্যাল এইড উপ-পরিষদ, কেন্দ্রীয় কমিটি) এক প্রতিবেদন অনুসারে, অক্টোবর মাসে ৪৩৬ জন নারী ও শিশু নির্যাতনের শিকার হন। নভেম্বর মাসে নির্যাতনের শিকার হন ৩৫১ জন নারী ও কন্যাশিশু। সবমিলিয়ে নভেম্বর পর্যন্ত পুরো বছরে মোট তিন হাজার ৬২ জন নারী ও শিশু নির্যাতনের শিকার হন।
বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির প্রকাশিত তথ্য মতে, গত বছরের জানুয়ারি থেকে ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত সারাদেশে শুধু নারী ও শিশু সংক্রান্ত মামলার সংখ্যা ছিল ১৮ হাজার ২২১টি।
দেশের ১১টি জাতীয় পত্রিকার খবর বিশ্লেষণ করে নারী নিরাপত্তা জোট ও আমরাই পারি পারিবারিক নির্যাতন প্রতিরোধ জোট এক প্রতিবেদনে জানায়, গত বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রতি মাসে গড়ে প্রায় ১০৮ জন নারী ও শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। ওই ৯ মাসে মোট ৯৭৫ নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। অর্থাৎ করোনার মতো মহামারিও অপরাধের প্রবণতায় লাগাম টানতে পারেনি।
নারী-শিশু ও মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, ধর্ষণ-নির্যাতনের কারণ হিসেবে ক্ষমতা প্রদর্শনের নেতিবাচক মানসিকতা ও রাজনৈতিক প্রভাব দায়ী।
ধর্ষণের বিরুদ্ধে গত বছর পদযাত্রা করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল শিক্ষার্থী
ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড করার পরও এ নেতিবাচক চিত্র সম্পর্কে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শুধু বিধান করেই নয়, দ্রুততম সময়ে আইনি প্রক্রিয়া শেষ করে অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। একই সঙ্গে আমাদের নিজ নিজ অবস্থান থেকে সামাজিক প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ অব্যাহত রাখতে হবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে আমরাই পারি পারিবারিক নির্যাতন প্রতিরোধ জোটের নির্বাহী সমন্বয়কারী জিনাত আরা হক জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা দেখেছি নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনাকে তেমন গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হয় না। একরকম গাফেলতিও আমরা দেখতে পাই। আইন ঘোষণা করলেই তো বাস্তবায়ন হয় না। এজন্য তো পুরো বিচার প্রক্রিয়া আছে। সেই বিচারিক প্রক্রিয়াকে সহজ করতে হবে অর্থাৎ নারী ও শিশু নির্যাতনের মামলা গ্রহণ থেকে শুরু করে বিচারকাজ ১৮০ দিনের মধ্যে নিম্ন আদালতে নিষ্পত্তি করতে হবে।
এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সবাইকে এসব নিপীড়নের ঘটনাকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিয়ে কাজ করতে হবে। যদি এটা না করা যায় তাহলে মানবাধিকার পরিস্থিতি দিন দিন খারাপ হবেই। আমরা বলতে পারি, দ্রুততম সময়ে অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক বিচার হলেই এ ধরনের অপরাধ কমে আসবে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সালমা আক্তার জাগো নিউজকে বলেন, ‘নারী ও শিশুরা যে ধরনের অপরাধের শিকার হন তা তো মানবাধিকারের লঙ্ঘন। শাস্তির বিধান বাড়ার বিষয়টি জানিয়ে দিচ্ছে এ ধরনের অপরাধ কতটা গুরুতর। কাগজে-কলমে বিধান থাকলেই তো হবে না। এর সুষ্ঠু প্রয়োগ হতে হবে, তা না হলে কোনো লাভ হবে না। কেউ নির্যাতন, নিপীড়নের শিকার হলে দীর্ঘমেয়াদে বিচারের অপেক্ষায় থাকতে হয়। এটা তো ঠিক নয়। আমরা দেখি, এখন পাবলিক প্লেসেও নারী-শিশুরা নির্যাতন, নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন। এতে বোঝা যায় পরিস্থিতি কতটা খারাপ হয়েছে। সেক্ষেত্রে অপরাধীদের দ্রুত আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক বিচার নিশ্চিত করতে হবে। একই সঙ্গে এই নারী নিপীড়কদের বিরুদ্ধে নিজ নিজ অবস্থান থেকে আমাদের সামাজিক প্রতিরোধ ও প্রতিবাদ অব্যাহত রাখতে হবে।’
এওয়াইএইচ/ইএ/এইচএ/জেআইএম