করোনার বছরে আরও ভঙ্গুর বিএনপির রাজনীতি
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বয়কট করার কারণে পুরো পাঁচ বছর সংসদের বাইরে ছিল বিএনপি। একটি রাজনৈতিক দলের সংসদের বাইরে থাকা ওই দলকে কতটুকু কোণঠাসা ও গুরুত্বহীন করে, তা সেই পাঁচ বছর হাড়ে হাড়ে টের পায় দলটি। অনেক নাটকীয়তার পর ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিলেও ফলাফলে ভরাডুবি হয় দলটির। এ ভরাডুবির জন্য বিএনপি ‘নির্বাচনী জালিয়াতি’কে দুষলেও সরকারি দল আওয়ামী লীগ বলেছে তাদের সাংগঠনিক দুর্বলতার কথা।
নির্বাচনের পরের বছর অর্থাৎ ২০১৯ সাল বিএনপি কিছুটা আন্দোলন-সংগ্রামে রাজপথে থাকলেও বিদায়ী বছর অর্থাৎ ২০২০ সালে তারা কোমর সোজা করে দাঁড়াতেই পারেনি। দলীয় কোন্দল ও তার জেরে মারামারি, উপনির্বাচনকেন্দ্রিক দ্বন্দ্ব-সংঘাত বিএনপিকে যেমন বারবার হোঁচট খাইয়েছে, তেমনি করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) পরিস্থিতি তাদের করেছে আরও ঘরকুনো।
কেমন কেটেছে বিএনপির বিদায়ী বছর? জেনে নেয়া যাক এক নজরে।
সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অংশগ্রহণ
বিদায়ী বছর বিএনপিতে যেটুকু চাঙ্গাভাব ছিল, তা দেখা যায় ১ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন নির্বাচনকে ঘিরে। ভোটকে ঘিরে দুই সিটিতেই বেশ প্রচার-প্রচারণা চালিয়েছিল বিএনপি। মিছিল-গণসংযোগের ফলে দলটির নেতাকর্মীদের মধ্যে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা বিরাজ করে। যদিও দুই সিটিতেই আওয়ামী লীগের প্রার্থীর কাছে হেরে যান বিএনপির প্রার্থীরা। অবশ্য নির্বাচনে অনিয়মের অভিযোগ তুলে ২ ফেব্রুয়ারি রাজধানীতে হরতালও ডাকে দলটি, কিন্তু সেই হরতালে ঢাকাবাসীর জীবনযাত্রা ছিল অনেকটাই স্বাভাবিক।
করোনার শুরুর দিকে মানবিক দিক ও বয়স বিবেচনায় শর্তসাপেক্ষে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে মুক্তি দেয় সরকার
করোনাকালে সাংগঠনিক কার্যক্রম ও ত্রাণ কর্মসূচি
সিটি করপোরেশন নির্বাচনের পরের মাসেই দেশে প্রথম করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়। রাষ্ট্রীয় বিধি-নিষেধের কারণে বিএনপিকেও ভার্চুয়াল কর্মসূচি চর্চায় চলে যেতে হয়। এ কারণে প্রায় সাত মাস (২২ মার্চ থেকে ১৫ সেপ্টেম্বর) পর্যন্ত দলটির সাংগঠনিক কার্যক্রম ও কমিটি গঠন এবং পুনর্গঠন প্রক্রিয়া আনুষ্ঠানিকভাবে বন্ধ থাকে। যদিও এর মধ্যেই নিষেধাজ্ঞা এবং দলীয় গঠনতন্ত্র উপেক্ষা করে ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির সহ-সভাপতি আব্দুল আলীম নকিকে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হিসেবে নিযুক্ত করার অভিযোগ ওঠে দলীয় হাইকমান্ডের বিরুদ্ধে।
সভা-সমাবেশ ভার্চুয়ালি করলেও করোনায় স্বাস্থ্য সুরক্ষা সরঞ্জামসহ ত্রাণ বিতরণ কর্মসূচিতে বেশ তৎপর দেখা যায় বিএনপিকে। এজন্য দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকুকে প্রধান করে করোনা ও বন্যা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে কেন্দ্রীয় সেল গঠন করা হয় এবং সারাদেশে দলীয় নেতাকর্মীদের মাধ্যমে স্থানীয় পর্যায়েও এ সেল সক্রিয় করা হয়। করোনায় প্রাণ হারান বিএনপির প্রায় শ’খানেক নেতাকর্মী।
খালেদা জিয়ার মুক্তি
দুটি দুর্নীতি মামলায় ২০১৮ সালে ৮ ফেব্রুয়ারি থেকে কারাভোগ করছিলেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। তারপর বিএনপি খালেদার মুক্তির জন্য নিষ্ফল চেষ্টা চালায়। করোনার শুরুর দিকে মানবিক দিক ও বয়স বিবেচনায় শর্তসাপেক্ষে খালেদা জিয়াকে ছয় মাসের জন্য মুক্তি দেয় সরকার। পরে সেই মুক্তির মেয়াদ আরও ছয় মাস বাড়ানো হয়। মুক্তির পর থেকেই খালেদা জিয়া আছেন তার গুলশানের বাসা ‘ফিরোজা’য়। এখানে থেকে এখন পর্যন্ত খালেদা জিয়া জ্যেষ্ঠ কয়েকজ নেতা ও চিকিৎসক ছাড়া কাউকে সাক্ষাৎ দেননি।
উপনির্বাচনে মনোনয়ন নিয়ে হানাহানি-সংঘাত
৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনের ফল বর্জন করেও পরে সেই নির্বাচনে জয়ীদের সংসদে যোগদান নিয়ে আগে থেকেই বিএনপিতে অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা চলছিল। এই সংসদের কয়েকটি আসনে উপনির্বাচনে প্রার্থী দেয়া নিয়ে সেই অস্থিরতা আরও তুঙ্গে ওঠে। ঢাকা-৫ আসনের উপনির্বাচনে মনোনয়ন বাণিজ্যের অভিযোগ ওঠে বেশ জোরেশোরে। মনোনয়নবঞ্চিত হয়ে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপি নেতা নবী উল্লাহ নবী তার অনুসারীদের নির্বাচনী কার্যক্রম থেকে গুটিয়ে রাখায় ধানের শীষের প্রার্থী সালাহউদ্দিন আহমেদ বিজয়ী হতে পারেননি বলেও আলাচনা ওঠে। ঢাকা-১০ আসনের উপনির্বাচনে প্রার্থী মনোনয়ন নিয়ে উত্তেজনার জেরে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের উত্তরায় বাসার সামনে বিক্ষোভ এবং তার বাসায় ইটপাটকেল ও ডিমও ছোড়ার ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় দলের অন্তত একডজন নেতাকর্মীকে বহিষ্কার করা হয়। এছাড়া ঢাকা-১৮ আসনে মনোনয়নপ্রত্যাশীদের সাক্ষাৎকার চলাকালে গুলশান কার্যালয়ের বাইরে এসএম জাহাঙ্গীর হোসেন ও কফিল উদ্দিনের সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ বাধে। এতে বেশ কয়েকজন নেতাকর্মী আহত হন। একজন কর্মীর মাথা ফেটে যায়।
নির্বাচন বা উপ-নির্বাচন ঘিরে বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশীরা শোডাউন করলেও আন্দোলন কর্মসূচিতে নেতাকর্মীদের এমন উপস্থিতি দেখা যায় না
স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনে কমিটি
মহামারির কারণে কর্মসূচি সীমিত করলেও বিএনপি গত ২৬ নভেম্বর স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালনে স্টিয়ারিং কমিটি গঠন করে। এতে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেনকে প্রধান করা হয়। এই কমিটি আগামী ২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর উদযাপনকেন্দ্রিক বিএনপির কর্মসূচিগুলো পালনের অগ্রভাগে থাকবে।
মেয়াদোত্তীর্ণ কেন্দ্রীয় কমিটি
২০১৬ সালের ১৯ মার্চ দলের ষষ্ঠ জাতীয় কাউন্সিলের মাধ্যমে বিএনপির নতুন কমিটি গঠিত হয়। তিন বছরমেয়াদি এই কমিটির মেয়াদ ২০১৯ সালের মার্চে শেষ হলেও এখনো কোনো কাউন্সিলের প্রস্তুতি নেয়নি দলটি। দলের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী ছয় মাস পরপর দলের জাতীয় নির্বাহী কমিটির সভা ডাকার বিধান থাকলেও সেই নিয়মও মানছে না বিএনপি। সর্বশেষ কেন্দ্রীয় কমিটি গঠনের পর বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির বর্ধিত সভা হয় ২০১৮ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি। কারাগারে যাওয়ার আগে ওই বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। খালেদা কারাগারে গেলে সেদিনই সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন করা হয়। এখনো এই পদে দায়িত্ব পালন করছেন লন্ডনে বসবাসরত তারেক রহমান।
ভঙ্গুর জোট রাজনীতি
অন্যদিকে জোটের রাজনীতিতে বেশ নাজুক পরিস্থিতিতে রয়েছে বিএনপি। দীর্ঘদিনের জোট ২০ দলের সঙ্গে আগে থেকেই দলটির দূরত্ব প্রকাশ পাচ্ছিল। তাদের সঙ্গে থেকেও জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নামে আরেকটি জোট গঠন করে ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যায় বিএনপি। কিন্তু ড. কামাল হোসেন, আ স ম আবদুর রব, বঙ্গবীর আবদুল কাদের সিদ্দিকী, মাহমুদুর রহমান মান্নার মতো নেতাদের নিয়ে গড়া এই জোটও অকার্যকর প্রমাণ হওয়ায় এখন ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গেও অনেক বিষয়ে বনিবনা হচ্ছে না বিএনপির। আবার তারা ২০ দলকে একপাশে রেখে ঐক্যফ্রন্ট গঠন করায় ওই পুরোনো জোটের কিছু দল মিলে গড়ে ‘জাতীয় মুক্তিমঞ্চ’ নামে নতুন প্লাটফর্ম।
এমন নানা জটিলতায় পড়ে বিএনপি এখন যেন ‘একলা চলো নীতি’ নিয়েছে। বিভিন্ন সংসদীয় আসনের উপনির্বাচনে অংশ নেয়াসহ অনেক সিদ্ধান্তই তারা নিচ্ছে জোট শরিকদের সঙ্গে কোনো আলোচনা ছাড়াই, এককভাবে। বিএনপির এমন ‘একলা চলো নীতি’র পক্ষে সাফাই গেয়ে আবার দলটির নেতারাও বলছেন, জোট হয়েছে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের জন্য, নির্বাচনের জন্য নয়। এক্ষেত্রে জোট শরিকদের অবস্থা এখন- ‘জোটে আছে, ভোটে নেই’।
২০ দল ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট, দুই জোটের সঙ্গেই দূরত্ব তৈরি হয়েছে বিএনপির
দলীয় কোন্দল চরমে
করোনা সংকট মোকাবিলায় বিএনপির নেতৃত্ব জাতীয় ঐক্যের ডাক দিলেও দলটির মধ্যেই অনেক বিভক্তি স্পষ্ট হয়েছে এই মহামারিকালে। মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব-সংঘাতের ফলে দেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপির নেতৃত্বের জীর্ণদশা প্রকাশ পায় এ সময়ে। একটি অংশ প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করে তো আরেকটি অংশ কোণঠাসা হয়ে মেতে থাকে দলেরই সমালোচনায়। অবিশ্বাস এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে, কারও কারও কপালে ‘সরকারের দালাল’ তকমাও জুটে যায়। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন তারেক রহমানের অনুসারী পরিচয়ে দুটি অংশেরই এ দ্বন্দ্ব দলীয় মহলে প্রকাশ পায়।
সর্বশেষ গত ১৪ ডিসেম্বর রাজধানীর মুক্তাঙ্গনে সরকারবিরোধী বিক্ষোভকে ঘিরে ঝড় বয়ে যায় বিএনপির নেতৃত্বে। ওইদিন জাতীয় প্রেস ক্লাবে সম্মিলিত পেশাজীবী পরিষদের আলোচনা সভায় অংশ নেন দলটির দুই ভাইস চেয়ারম্যান হাফিজ উদ্দিন ও শওকত মাহমুদ। ওই অনুষ্ঠান শেষে কিছু নেতাকর্মী মুক্তাঙ্গন ঘেঁষে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করে। পরে লাঠিপেটা করে তাদের ছত্রভঙ্গ করে পুলিশ। দলের সিদ্ধান্ত ছাড়া হঠাৎ বিক্ষোভের পেছনে হাফিজ উদ্দিন ও শওকত মাহমুদের হাত রয়েছে বলে মনে করেন দলের অনেক সিনিয়র নেতা। সেদিন সন্ধ্যায় শওকত মাহমুদ ও হাফিজ উদ্দিন আহমদকে শোকজ করা হয়।
১৬ ডিসেম্বর শোকজের জবাব দেন শওকত মাহমুদ। তবে এতে তিনি কী লেখেন, তা জানা যায়নি। পরে ১৯ ডিসেম্বর সংবাদ সম্মেলন করে হাফিজ উদ্দিন বলেন, দলে মুক্তিযোদ্ধাদের কোণঠাসা করতে একটি মহল সক্রিয় হয়ে উঠেছে।
কেএইচ/এএএইচ/এইচএ/জেআইএম