ভিডিও EN
  1. Home/
  2. বিশেষ প্রতিবেদন

প্রকল্পের অর্থের পুরোটা ব্যয় বেতন-কেনাকাটা-মিটিংয়ে

প্রদীপ দাস | প্রকাশিত: ০৮:২১ এএম, ২২ ডিসেম্বর ২০২০

২০৪০ সালের মধ্যে দেশকে তামাকমুক্ত করতে কাজ করছে সরকার। সেই লক্ষ্যে বিদেশিদের অনুদান ও সরকারের অর্থায়নে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে বিভিন্ন প্রকল্প। তবে তামাক নিয়ন্ত্রণের এমন একটি বিদেশি অনুদানের প্রকল্প পরিকল্পনা কশিমনে অনুমোদনের জন্য এসেছে, যার পুরো অর্থই খরচ হবে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন, অফিসের জন্য বিভিন্ন জিনিসপত্র কেনাকাটা ও কমিটির সভায়। এ প্রকল্পে যেসব কাজ করার কথা বলা হয়েছে, সেসব কাজের জন্য অর্থ বরাদ্দ নেই।

প্রকল্পটির নাম ‘এস্টাবলিশমেন্ট অ্যান্ড স্ট্রেন্থেনিং অব ইফেক্টিভ টোব্যাকো কন্ট্রোল প্রোগ্রাম ইন বাংলাদেশ টু টেক টোব্যাকো ফ্রি বাংলাদেশ বাই ২০৪০ (থার্ড ফেজ)’। প্রকল্পটি স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ এবং স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে বাস্তবায়ন করবে সরকারের জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ সেল (এনটিসিসি)।

প্রকল্প প্রস্তাব অনুযায়ী, ২০২০ সালের মে থেকে ২০২২ সালের এপ্রিল মেয়াদে এটি বাস্তবায়ন করা হবে। এতে খরচ করা হবে মোট এক কোটি ৬১ লাখ ২৪ হাজার টাকা। এর পুরো অর্থই অনুদান হিসেবে দেবে বিদেশি দাতা সংস্থা দ্য ইউনিয়ন (ভাইটাল স্ট্রাটেজিস)।

সম্প্রতি পরিকল্পনা কমিশনে প্রকল্পটির ওপর প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভা অনুষ্ঠিত হয়। পিইসি সূত্র জানায়, মোট বরাদ্দের এক কোটি ৬১ লাখ টাকার মধ্যে কর্মকর্তাদের বেতন ২৪ লাখ ২২ হাজার টাকা, কর্মচারীদের বেতন ৮৩ লাখ ৪৪ হাজার, যাতায়াত এক লাখ ৫০ হাজার, ডাক ৮০ হাজার, টেলিফোন এক লাখ ১০ হাজার, ইন্টারনেট ৬০ হাজার, পানি ২০ হাজার, স্টেশনারি চার লাখ ৭০ হাজার, ব্যবস্থাপনা চার লাখ, কনসালট্যান্টদের বেতন তিন লাখ ২৩ হাজার, অডিট এক লাখ এক হাজার, কমিটি মিটিং ও কমিশন ৩৬ লাখ ১০ হাজার, ইন্টারনেট মডেমে চার হাজার, ভয়েস রেকর্ডারে সাত হাজার, এপসন কালার প্রিন্টারে ১৭ হাজার এবং পোর্টেবল হার্ডডিক্সে ২১ হাজার টাকা খরচ করা হবে।

পুরো অর্থই বেতন, অফিস সরঞ্জাম ও কমিটির সভায় খরচের বরাদ্দ দেয়া হলেও প্রকল্পের কার্যক্রমের জন্য সুনির্দিষ্ট কোনো বরাদ্দ নেই। প্রকল্পের প্রধান প্রধান কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছে তামাক নিয়ন্ত্রণের জন্য টেকসই দীর্ঘমেয়াদি অর্থ সংস্থানের ব্যবস্থা গ্রহণ, খসড়া জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি প্রণয়ন, তামাক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম স্থায়ী রূপ দিতে জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ সেলকে রাজস্ব খাতে অন্তর্ভুক্ত করার পদক্ষেপ গ্রহণ, বাংলাদেশ সরকারের বরাদ্দ করা রাজস্ব বাজেটের তামাক নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি বাস্তবায়নে সহায়তা প্রদান, তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধনের জন্য খসড়া তৈরির লক্ষ্যে অংশীজনের সঙ্গে পরামর্শকরণ, তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধনের খসড়া তৈরি এবং জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ নীতিমালা চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য সহায়তা করা।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে প্রকল্পের দাতা সংস্থা দ্য ইউনিয়নের কারিগরি পরামর্শক অ্যাডভোকেট সৈয়দ মাহবুবুল আলম জাগো নিউজকে বলেন, ‘সরকার চলতি অর্থবছরে তামাক নিয়ন্ত্রণে প্রায় ২১ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে এনটিসিসি সরকারের প্রতিষ্ঠান হলেও তাদের স্থায়ী মানবসম্পদ নেই। তারা প্রকল্পের মাধ্যমে চলে। এখন উন্নয়ন সহযোগীরা মানবসম্পদ দিচ্ছে, আর তামাক নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির পুরো টাকা দিচ্ছে সরকার।’

তিনি বলেন, ‘এনটিসিসির অর্গানোগ্রামের কাজ চলছে। যতক্ষণ অর্গানোগ্রাম না হবে, ততক্ষণ তো স্থায়ী জনবল সরকার দিতে পারবে না। সরকার দেবে কর্মসূচির টাকা আর দাতারা দেবে জনবলের টাকা। জনবলের জন্য আলাদা অনুমোদন লাগে, এ প্রকল্পের মাধ্যমে সেটাই করা হচ্ছে।’

যদিও প্রকল্পের কাজের মধ্যে এনটিসিসির জনবলকে অর্থায়ন করা হবে, এমন কোনো বিষয় উল্লেখ নেই।

প্রকল্পের প্রধান কাজের মধ্যে থাকা ‘বাংলাদেশ সরকারের বরাদ্দ করা রাজস্ব বাজেটের তামাক নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি বাস্তবায়নে সহায়তা প্রদান’ খাতের সঙ্গে বরাদ্দের সম্পৃক্ততা রয়েছে বলে দাবি করেন সৈয়দ মাহবুবুল আলম। তিনি বলেন, ‘এই স্টাফরা কী করবেন? রাজস্ব বাজেটে যে কর্মসূচি আছে, সেটাকে বাস্তবায়ন করবে।’

jagonews24

দ্য ইউনিয়নের এই কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘২০১১ সালের দিকে তামাক নিয়ন্ত্রণে কর্মসূচি ও জনবলের পুরো টাকাই দিতো উন্নয়ন সহযোগীরা। এখন ধীরে ধীরে সরকার কর্মসূচির খরচ নিয়ে নিচ্ছে। আগামী দুই বছর পরে পুরোটাই হয়তো সরকার নিয়ে নেবে। এজন্য এ প্রকল্পে জনবল দেখলেও কোনো কর্মসূচির খরচ এখানে দেখা যাচ্ছে না। কারণ কর্মসূচির জন্য সরকার যা দিচ্ছে, তা অনেক টাকা।’

দেশে তামাক নিয়ন্ত্রণ নিয়ে কাজ করা একজন নাম না প্রকাশ করার শর্তে বলেন, ‘এ প্রকল্পের মূল যে কার্যক্রম, সেটার জন্য কোনো বাজেট নেই। সব টাকা বেতন-ভাতা, জিনিসপত্র কিনতেই শেষ।’

জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ সেলের (এনটিসিসি) প্রোগ্রাম অফিসার আমিনুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘সরকারের রাজস্ব বাজেটের প্রোগ্রামগুলো সাপোর্ট দেয়া হয় এখান থেকে। চলতি অর্থবছরের বাজেটে তামাক নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকারের বরাদ্দ ২১ কোটি টাকা। সেখানে সরকারের লোকবল নেই। সরকারের কাজগুলোকে সাপোর্ট দেয়া এ প্রকল্পের বড় উদ্দেশ্য।’

প্রকল্পটির বিষয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের আনুষ্ঠানিক বক্তব্য হচ্ছে, ‘বিদেশি দাতা সংস্থা দ্য ইউনিয়ন ও বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে স্বাক্ষরিত চুক্তির শর্তানুযায়ী দুই বছর মেয়াদি এ প্রকল্পে মোট অনুদান এক কোটি ৬১ লাখ ১৯ হাজার ৭৬৮ টাকা। কিন্তু এনটিসিসি থেকে পাঠানো টিএপিপিতে মোট বরাদ্দ দেখানো হয়েছে এক কোটি ৬১ লাখ ২৪ হাজার টাকা, যা চুক্তিপত্র অনুযায়ী চার হাজার ২৩২ টাকা বেশি। চুক্তির অন্যান্য শর্ত সঠিকভাবে টিএপিপিতে প্রতিফলিত হয়েছে।’

এ বিষয়ে পরিকল্পনা কমিশনের বক্তব্য, ‘২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে ধূমপানমুক্ত করতে এ প্রকল্পটি ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারবে। তাই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হওয়া জরুরি।’

প্রকল্পের প্রেক্ষাপট তুলে ধরে এনটিসিসি বলছে, তামাকজনিত কারণে বিশ্বে বছরে ৮০ লাখের বেশি এবং বাংলাদেশে এক লাখ ৬১ হাজারের বেশি মানুষ মৃত্যুবরণ করে। তামাকের ভয়াবহতা মোকাবিলায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার উদ্যোগে ২০০৩ সালে আন্তর্জাতিক তামাক নিয়ন্ত্রণ চুক্তি ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন টোব্যাকো কন্ট্রোল (এফসিটিসি) গ্রহণ করা হয়। বাংলাদেশ এ চুক্তিতে সই করে এবং ২০০৪ সালে অনুসমর্থন করে। সরকার এফসিটিসির আলোকে ২০১৩ সালে ‘ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন ২০০৫’ এর সংশোধনী পাস ও ২০১৫ সালে বিধিমালা প্রণয়ন করে।

জাতিসংঘ টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এসডিজি) স্বাস্থ্য সুরক্ষা বিষয়ক ৩ নম্বর অভীলক্ষ্যে ৩.এ- এফসিটিসির বাস্তবায়ন ও ৩.৪-এ অসংক্রমক রোগজনিত অকালমৃত্যু এক-তৃতীয়াংশ কমানোর বিষয়কে যুক্ত করার মাধ্যমে তামাক নিয়ন্ত্রণকে গুরুত্ব দিয়ে অন্তর্ভুক্ত করেছে। সরকার এসডিজি অর্জনের পথপরিক্রমাকে অগ্রাধিকার দিয়ে সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় তামাক নিয়ন্ত্রণকে যুক্ত করেছে। ২০১৬ সালের ৩০ থেকে ৩১ জানুয়ারি সাউথ এশিয়ান স্পিকার্স সামিটের সমাপনী অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রী ২০৪০ সালের মধ্যে দেশকে তামাকমুক্ত করার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করে। সেই লক্ষ্য বাস্তবায়নেই এ প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে।

পিডি/এইচএ/জেআইএম