চালের বাজার সামলাতে আমদানিতে নেমেছে সরকার
চালের দাম বেড়েই চলছে। বেঁচে থাকার সবচেয়ে প্রয়োজনীয় এই নিত্যপণ্যের দামে সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস উঠেছে। বাজারে চালের দাম বেশি হওয়ায় সরকারের আমন সংগ্রহ কর্মসূচি ব্যর্থ হতে চলেছে। একই সঙ্গে কমছে সরকারি মজুত। এই পরিস্থিতিতে বাজার সামাল দিতে আমদানিতে নেমেছে সরকার।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, আমনের ভরা মৌসুম হলেও ধানের দাম বেশি, এর প্রভাব পড়ছে চালে। তারা মনে করছেন, আমন উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কম হয়েছে, তাই এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে।
সরকারি মজুত বাড়ানো এবং প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষকে সুবিধা দিতে খোলাবাজারে চাল বিক্রি (ওএমএস) অব্যাহত রাখা ও খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির জন্য আমদানিই একমাত্র সমাধান বলে মনে করেন খাদ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।
খাদ্য মন্ত্রণালয় ও অধিদফতরের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, দেড় লাখ টন চাল আমদানির প্রক্রিয়া চলছে। পরিস্থিতি বিবেচনায় দরপত্রের মাধ্যমে আরও চাল আমদানির উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। জি-টু-জি (সরকার থেকে সরকার) পদ্ধতিতেও চাল আনতে বাজার খোঁজা হচ্ছে।
রাজধানীর বিভিন্ন বাজার থেকে শনিবার (১২ ডিসেম্বর) পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, চালের দাম খুচরা পর্যায়ে গত এক সপ্তাহে কেজিতে ৪ টাকা এবং দুই সপ্তাহের ব্যবধানে কেজিতে ৮ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। মোটা চাল বিক্রি হচ্ছে ৪৬ থেকে ৫০ টাকা কেজি, যা দুই সপ্তাহ আগে ছিল ৪২ থেকে ৪৬ টাকার মধ্যে।
সরকারি প্রতিষ্ঠান ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) ঢাকা মহানগরীর নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের বাজারদরের শনিবারের (১২ ডিসেম্বর) প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এক মাসের ব্যবধানে মোটা চালের দাম বেড়েছে ৫ দশমিক ৭৫ টাকা, বছরের ব্যবধানে বেড়েছে ২৬ দশমিক ০৩ শতাংশ।
গত ৮ ডিসেম্বরের তথ্য অনুযায়ী, সরকারি খাদ্যশস্যের মোট মজুত ৭ লাখ ৮৭ হাজার ৫৪০ টন, এর মধ্যে চাল ৫ লাখ ৫৫ হাজার ৮ টন এবং গম ২ লাখ ৩২ হাজার ৪৬০ টন। এই মজুত গত বছরের চেয়ে অর্ধেক। গত বছর একই সময়ে মোট মজুতের পরিমাণ ছিল ১৩ লাখ ৮৭ হাজার ৭৫০ টন, এর মধ্যে চাল ছিল ১০ লাখ ৫৮ হাজার ৭ এবং গম ৩ লাখ ২৯ হাজার ৬৮০ টন।
এ বিষয়ে খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমি বিভিন্ন জেলায় খোঁজ রাখছি, বাজারে ধানের দাম বেশি। ধানের দাম বেশি হলে চালের দাম কীভাবে কমবে? আমি তো জোর করে দাম কমাতে পারব না। সাধারণ মানুষ ও কৃষক দুই পক্ষের স্বার্থই আমাদের দেখতে হয়।’
তিনি বলেন, ‘এখন প্রতি মণ ধানের দাম এক হাজার ২০০ টাকা। ৬১ কেজি ধানে ৪০ কেজি চাল হয়। প্রতি কেজি চালের দাম পড়ে প্রায় ৪৬ টাকা। এর সঙ্গে বহন খরচও আছে।’
লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে আমনের উৎপাদন কম হতে পারে জানিয়ে খাদ্যমন্ত্রী বলেন, ‘উৎপাদনের হিসাবটা আরও সঠিক হওয়া দরকার। উৎপাদন ঠিক থাকলে তো দাম বাড়ার কথা নয়।’
গত ২৮ অক্টোবর খাদ্য পরিকল্পনা ও পরিধারণ কমিটির সভায় চলতি আমন মৌসুমে সরাসরি কৃষকদের কাছ থেকে ২৬ টাকা কেজি দরে ২ লাখ মেট্রিক টন ধান কেনার সিদ্ধান্ত হয়। এছাড়া ৩৭ টাকা কেজি দরে ৬ লাখ টন সিদ্ধ চাল এবং ৩৬ টাকা কেজি দরে ৫০ হাজার টন আতপ চাল কেনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়।
কিন্তু বাজারে ধান চালের দাম অনেক বেশি হওয়ায় সংগ্রহ কার্যক্রমে কোনো অগ্রগতি নেই। সরকারি গুদামে ধান-চাল দিতে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না কৃষক ও মিল মালিকরা। খাদ্য অধিদফতরের ৮ ডিসেম্বরের তথ্য অনুযায়ী, ৬৪ টন ধান, ৪ হাজার ১৪১ টন সিদ্ধ ও ১৫ টন আতপ চাল সংগ্রহ করা হয়েছে।
বাজারে আমন চালের দাম বেশি থাকায় চাল দিতে মিলাররা চুক্তি করছেন না জানিয়ে খাদ্যমন্ত্রী বলেন, ‘বাজারে ধানের দাম বেশি হওয়ায় কৃষক আমাদের ধান দিচ্ছে না। একইভাবে মিলারটা চাল দিচ্ছেন না। সরকার যদি জোর করে আমন সংগ্রহ চালায় তবে তো বাজার আরও অস্থিতিশীল হয়ে যাবে। তাই এই মুহূর্তে আমদানি করা ছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই।’
‘ধান কেনার জন্য বিষয়টি আমরা কৃষকদের জন্য ওপেন করে দিয়েছি। যে কোনো কৃষক সরকারকে ধান দিতে পারবে। কিন্তু সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না।’
আমনের সংগ্রহ মূল্য বাড়ানোর কোনো চিন্তা-ভাবনা নেই জানিয়ে খাদ্যমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা যদি দাম বাড়িয়ে চাল কিনি তবে চালের সংকট আরও বাড়বে। দামে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। ভোক্তারা কষ্ট পাবে।’
মন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের ওএমএস কর্মসূচি চলছে। সামনে খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি শুরু হবে। কর্মসূচিগুলো চালু রাখতে আমরা চাল আমদানি করছি।’
চাল আমদানির কার্যক্রম তুলে ধরে খাদ্যমন্ত্রী বলেন, ‘চাল আনতে আমরা টেন্ডার দিয়েছি, ৩৫ টাকা ৩৭ পয়সা করে রেট পড়েছে প্রতি কেজি চালে। গত বুধবার ৫০ হাজার টন আমদানির প্রস্তাব অনুমোদন দিয়েছে ক্রয় কমিটি। সেটার দাম পড়েছে ৩৪ টাকা ৬৭ পয়সা। নতুন করে আবার টেন্ডার আহ্বান করা হয়েছে। ওএমএস যাতে আরও সম্প্রসারণ করতে পারি, সেজন্য আমরা এই চেষ্টা চালাচ্ছি।’
‘এছাড়া সরকার টু সরকার পদ্ধতিতে চাল আনারও চেষ্টা করছি আমরা। অনুসন্ধান করা হচ্ছে। আমরা দামের বিষয়টি তো ইতোমধ্যে বুঝেই গেছি।’
সরকার কী পরিমাণ চাল আমদানির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে জানতে চাইলে মন্ত্রী বলেন, ‘এটা বলা ঠিক হবে না। কারণ এই খবরে দাম হঠাৎ কমে যেতে পারে, এতে কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আবার অসাধু ব্যবসায়ী পরিমাণটা জেনে অন্য কোনো ফন্দিও আঁটতে পারে। তাই এটা বলছি না।’
তিনি বলেন, ‘কৃষকের স্বার্থের বিষয়ে আমরা সজাগ আছি। কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হবে, এমন কিছুই আমরা করব না। বাজারে ধানের দাম যদি কমেও যায়, কৃষকের কাছ থেকে লাখ লাখ টন ধান কেনার জন্যও আমরা প্রস্তুত আছি।’
এ বিষয়ে খাদ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক সারোয়ার মাহমুদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা চাল আমদানির মাধ্যমে আমাদের মজুত বাড়াব। প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষের যেন কষ্ট না হয় তা দেখছি, ওএমএস কার্যক্রম চলছে। পরিস্থিতি অনুযায়ী, আমরা চাল আমদানি করব।’
আমন সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন অনিশ্চিত জানিয়ে মহাপরিচালক বলেন, ‘ইতোমধ্যে দেড় লাখ টন চাল আমদানির প্রক্রিয়া চলছে। আরও ৫০ হাজার টনের জন্য দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে।’
বাংলাদেশ অটো মেজর অ্যান্ড হাসকিং মিল মালিক সমিতির সভাপতি আব্দুর রশিদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমন ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই ব্যবসায়ী ও মিলাররটা ধান স্টক করে ফেলছে। এতে দামটা বেড়ে গেছে। তবে শেষের দিকে বাজার এমন থাকবে বলে মনে হচ্ছে না। এতে চাষিরা লাভবান হচ্ছে, তবে মৌসুমে ভোক্তারা যে কম দামে চাল খাবে সেটা আর হচ্ছে না। সবাই মনে করছে ধান রাখলে লাভ হবে, তাই কিনে রাখছে।’
তিনি বলেন, ‘সরকার আমদানিতে যেতে পারে।দাম বাড়িয়ে সরকার দেশের মধ্য থেকে চাল কিনলে বাজার আরও অস্থিতিশীল হবে। সরকার যে চাল আমদানির চিন্তা-ভাবনা করছে সেটা খারাপ না।’
আমন উৎপাদন পরিস্থিতির বিষয়ে জানতে চাইলে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের মহাপরিচালক মো. আসাদুল্লাহ বলেন, ‘বন্যায় এক লাখ হেক্টর জমির আমন ধান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাই ফলন কিছুটা কমবে। আমাদের এবারের উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা এক কোটি ৫৬ লাখ টন। আমরা ধরছি দুই থেকে আড়াই লাখ টনের মতো উৎপাদন কম হতে পারে।’
তিনি বলেন, ‘ফলন কিছুটা কম হলেও খাদ্য সংকট হবে না। সতর্কতা হিসেবে সরকার চাল আমদানির দিকে যাচ্ছে। বোরোতে চার লাখ টন উৎপাদন বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছি।’
আমন উৎপাদন নিয়ে খাদ্য বিভাগের সন্দেহের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে আসাদুল্লাহ বলেন, ‘আমাদের জনবল সংকট রয়েছে। সবকিছু মিলিয়ে আমরা সঠিক হিসাব দেয়ার চেষ্টা করছি।’
আমন উৎপাদনের চূড়ান্ত হিসাব ডিসেম্বরের শেষের দিকে পাওয়া যাবে বলেও জানান কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের মহাপরিচালক।
চালের বাজার নিয়ে বাবুবাজারের পাইকারী চাল ব্যবসায়ী নিজাম উদ্দিন বলেন, ‘মিলে চালের দাম অনেক বেড়েছে, এ কারণে বাজারেও চালের দাম বাড়তি। মূলত ধানের দাম বাড়ার কারণে চালের এই দাম বেড়েছে বলে আমাদের ধারণা। ধানের দামও অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। আগে যে ধান ৬০০ টাকা মণ ছিল এখন তা ১২০০-১৩০০ টাকা মণ বিক্রি হচ্ছে। সরকার মিল মালিকদের সঙ্গে বসে চালের একটা রেট ধরে (দাম নির্ধারণ) দিলে সুবিধা হবে। পাশাপাশি চাল আমদানির উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে।’
আরএমএম/এইচএ/এমএস