ভিডিও EN
  1. Home/
  2. বিশেষ প্রতিবেদন

শহীদ নূর হোসেন এখন শুধুই ইতিহাস

প্রকাশিত: ০৬:২৩ পিএম, ০৯ নভেম্বর ২০১৫

`স্বৈরাচার নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক` স্লোগানটির সঙ্গে আমরা সবাই পরিচিত। এ স্লোগানটি যিনি বুকে ও পিঠে ধারণ করে তৎকালীন স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গিয়ে (১৯৮৭ সালের ১০ নভেম্বর) শহীদ হন তিনি নূর হোসেন। গণতন্ত্র ও শহীদ নূর হোসেন বাংলা মায়ের যমজ সন্তান। একই চেহারায় ভিন্ন দুটি নাম। গণতন্ত্র মানে নূর হোসেন, নূর হোসেন মানে গণতন্ত্র। সেই থেকে ১০ নভেম্বর শহীদ নূর হোসেন দিবস পালিত হয়ে আসছে। আর এ উপলক্ষে বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠন বিস্তারিত কর্মসূচি পালন করে।

শহীদ নূর হোসেনের পরিচিতি :
নূর হোসেনের পুরো পরিচয় আমরা অনেকেই জানি না। তার পৈতৃক নিবাস পিরোজপুর জেলার মঠবাড়িয়া উপজেলার সাপলেজা ইউনিয়নের ঝাটিবুনিয়া গ্রামে। তার বাবার নাম মজিবুর রহমান ওরফে কাঞ্চন মিয়া এবং মায়ের নাম মরিয়ম বেগম। পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে তিনি তৃতীয়। নূর হোসেনের জন্ম ১৯৬৪ সালের কোনো এক বিকেলে ঢাকার নারিন্দায়।

শহীদ নূর হোসেনের বংশের প্রাচীন পরিচিতি বিস্তারিত উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। তবে তার বড় ভাই আলী হোসেনের সঙ্গে কথা বলে যত দূর জানা যায় তা হলো, ঝাটিবুনিয়া গ্রামে হাওলাদার বংশে বাবর আলী হাওলাদার নামে এক অভিজাত কৃষকের বসতি ছিল। তার স্ত্রীর প্রথম ছেলের নাম কাদের হাওলাদার এবং দ্বিতীয় ছেলের নাম হাছেন আলী হাওলাদার। নূর হোসেনের পিতামহ হাছেন আলী হাওলাদারের ছিল পাঁচ ছেলে ও দুই মেয়ে।

তার ছোট ছেলে কাঞ্চন হাওলাদার ছিলেন একটু অভিমানী স্বভাবের। বড় ভাই ও বাবা হাসেন আলী হাওলাদারের সঙ্গে অভিমান করে কাঞ্চন পা বাড়ান ঢাকার উদ্দেশে। কাঞ্চন হাওলাদার যেদিন ঢাকার সদরঘাটে পৌঁছেন সেদিন ছিল ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারির ২১ তারিখ। বিকেল গড়িয়ে তখন সাঁঝের বাতি জ্বালানোর প্রস্তুতি চলছে। ঘাটে নামতেই লোকজন তাকে জিজ্ঞেস করলো, কি ভাই কোথায় যাচ্ছ? শহরের অবস্থা তো ভালো না।

কাঞ্চন হাওলাদারের কথায়, সে সময়কার ঢাকার মানুষজনের মনে অনেক সহানুভূতি, দরদ আর মায়া-মমতা ছিল যেমনটি বর্তমানে খুঁজে পাওয়া দায়। কাঞ্চন হাওলাদার পরে পুরান ঢাকার নারিন্দায় বসবাস শুরু করেন। ঢাকা শহর জীবনের শুরুতেই তিনি পেয়েছিলেন তৎকালীন ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ হোস্টেলে মসলা গুঁড়া করার কাজ। পরে একই জায়গায় করেছেন সিক বয় ডিউটির কাজ। একই হোস্টেলে বেশ কিছুদিন বাবুর্চির কাজও করেন তিনি।

তৎকালীন সংকটময় অবস্থার প্রত্যক্ষ সাক্ষী খেঁটে খাওয়া যুবক কাঞ্চন হাওলাদার বঙ্গবন্ধুর মহত্ত্বের কাছে মাথা নত করেন, পুরোপুরি ভক্ত হয়ে পড়েন জাতির পিতার। যার ফলে বাবা-মায়ের দেয়া নাম কাঞ্চন হাওলাদার পরিবর্তন করে বঙ্গবন্ধুর নামের সঙ্গে মিল রেখে নিজের নামকরণ করেন মজিবুর রহমান। চিরচেনা গ্রাম, বাবা-মা, ভাই-বোন, আত্মীয় স্বজন সবার স্মৃতি পেছনে ঠেলে নতুন নামে নতুন শহরে দিনাতিপাত করতে লাগলেন তিনি।

`১৯৫২ থেকে ’৫৪ সালের ঢাকার বুকে রাজনৈতিক ঘটনাবলির উত্থান-পতনকে যৌবনের বিস্ময় ভরা চোখে দেখেছেন মজিবুর রহমান। মুসলিম লীগ সরকারের সমস্ত অন্যায়, অত্যাচার আর নির্যাতন তাকে বিদ্রোহী করেছে। ৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনের সময় নবাবপুর রোডে শের-ই-বাংলা ফজলুল হক, শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে হাত মিলিয়ে বিরোধী দলীয় রাজনীতিতে বিশ্বাস স্থাপন করেছেন, আওয়ামী-লীগের প্রতি আস্থাশীল হয়েছেন।

পল্টন ময়দানে একুশে ফেব্রুয়ারির অনুষ্ঠানে আলতাফ মাহমুদের কণ্ঠে ‘ও বাঙালি’ ঢাকা শহর রক্তে ভাসাইলি’ গানটি শুনে চোখের পানি ঝর ঝর করে পড়েছে তার। কেঁদে আকুল হয়েছেন মজিবুর রহমান। এ সময়ের পর থেকে মজিবুর রহমান জাতীয় রাজনৈতিক আন্দোলনের এবং আওয়ামী লীগের সব কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছেন। এভাবে পুরো ষাটের দশকে তিনি রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় ছিলেন।


মজিবুর রহমান বাবুর্চির কাজ থেকে ছাঁটাই হওয়ার পর ঢাকার অলিতে-গলিতে রিকশা চালিয়েছেন প্রায় আট বছর। ষাটের দশকের প্রথম দিকে তিনি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন আশরাফ আলী শেখের মেয়ে মরিয়ম বিবির সঙ্গে। মৃত আশরাফ আলী শেখের গ্রামের বাড়ি ছিল মুন্সিগঞ্জের রামপাল। ১৯৬২ সালের দিকে মজিবুর রহমানের প্রথম সন্তান পৃথিবীর মুখ দেখেন। তার নাম রাখা হয় আলী হোসেন। দুই বছরের ব্যবধানে ১৯৬৪ সালে দ্বিতীয় সন্তান নূর হোসেনের জন্ম হয়। ১৯৭০ সালের দিকে তখন মজিবুর রহমান পরিবার নিয়ে গেন্ডারিয়ায় এক বাসায় ওঠেন।

১৯৭১ সাল। রাজনৈতিকভাবে দেশের নানা উত্থান-পতন দেখতে দেখতে খাঁটি দেশপ্রেমিক বনে যান নূর হোসেনের দরিদ্র বাবা মজিবুর রহমান। ৭ মার্চ মজিবুর রহমান ব্যক্তিগতভাবে খুব কষ্ট পেয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণ প্রত্যক্ষভাবে উপস্থিত থেকে না শুনতে পারার কারণে। কারণ সেদিন তিনি হাসপাতাল থেকে বেবিট্যাক্সিতে করে একজনের মরদেহ গাজীপুরের বর্মি বাজারে নিয়ে যান। ফিরতে ফিরতে রাত ৯টা বেজে গিয়েছিল। দেশের অবস্থা ক্রমে খারাপ হতে থাকে। কারফিউ জারি করা হয় সারা দেশে। জনমনে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।

শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। ২৭ মার্চ কারফিউ প্রত্যাহার করা হলে পরিবার নিয়ে মুন্সিগঞ্জের রামপালে পাড়ি জমান মজিবুর রহমান। দুই ছেলে আলী হোসেন আর নূর হোসেনের সুন্নাতে খাৎনা করানো হয়েছিল সে মাসেই। দেশের এ রকম বর্বর অবস্থায় খত নিয়েই ঢাকা শহর ছাড়তে হয়েছিল তাদের। কিছুদিন রামপালে থাকার পর পেটের তাড়নায় বাচ্চাদের মুখের দিকে চেয়ে আবার ঢাকায় আসতে হয় মুজিবুর রহমানকে।

নূর হোসেনের শৈশব, কৈশোর ও যৌবন :
নূর হোসেনের শৈশব শুরু হয় ঢাকার নারিন্দায়। তারপর কিছুদিন থাকেন ৭৮/১ বনগ্রামে ও গেন্ডারিয়ায়। আবার বেশ কিছুদিন থাকেন মুন্সিগঞ্জের রামপালে। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের দুই বছর পর তার পরিবার স্থান পরিবর্তন করে ঢাকার ৭৯/১ বনগ্রাম রোডে আসার সুবাদে তার পরবর্তী জীবন অতিবাহিত হয় বনগ্রামেই। ছোটবেলা থেকেই নূর হোসেন ছিলেন খুবই চঞ্চল প্রকৃতির। বয়স বাড়তে বাড়তে হয়ে ওঠেন এক চঞ্চলমতি কিশোর। দিন কাটতো তার ঘোরাফেরা করে।

বনগ্রামের এ-বাড়ি ও-বাড়ি সবখানেই ছিল তার অবাধ যাতায়াত। তিনি এতই মিশুক ছিলেন যখন যে বাড়িতে ইচ্ছে সে বাড়িতেই খেতে বসে পড়তেন। ভালোবাসতেন সবাইকে। দরিদ্র পরিবারে জন্ম হলেও নিজেকে মানিয়ে নিতেন যেকোনো পরিবেশে। তার চলার স্টাইলে দারিদ্রের ছাপ পড়েনি কখনো, ছোটবেলা থেকেই ছিলেন পরিবারের সবার থেকে আলাদা।

দরিদ্রতা ছিল যদিও নূর হোসেনের পরিবারের নিত্যদিনের সঙ্গী তবু তিনি চেয়েছিলেন লেখাপড়া শিখতে। যার ফলে তাকে ভর্তি করা হয় বাড়ির পাশের রাধা সুন্দরী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। জ্ঞান পিপাসু নূর হোসেন পঞ্চম শ্রেণি পাস করার পর ভর্তি হন গ্রাজুয়েট হাই স্কুলে। অভাবের তাড়নায় বেশি দূর পড়ালেখা করতে পারেননি। অষ্টম শ্রেণি পাসের পর পড়াশোনার পাঠ চুকিয়ে মােটর মেকানিকের কাজে যোগ দিতে হয়েছিল। পেশা হিসেবে নূর হোসেন মিনিবাস সমিতি চালিত বাসের সুপারভাইজার হিসেবেও দীর্ঘদিন কাজ করেছেন।


নূর হোসেন কাজের ফাঁকে নিজ উদ্যোগে সদরঘাটের কলেজিয়েট নৈশ বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন। নূর হোসেন উচ্চ শিক্ষিত না হতে পারলেও জ্ঞান অর্জনের জন্য তার যে পিপাসা ছিল তা দেখলেই বোঝা যেত। অন্য ভাই বোনদের থেকে পড়ালেখায় ভালো ছিলেন। হাতের লেখাও ছিল অনেক সুন্দর। অনেকভাবে লিখতে পারতেন তিনি। অন্যদের হাতের লেখা খুব সহজেই কপি করে ফেলতে পারতেন নূর হোসেন। সব সময় তার হাতে কোনো বই বা পত্রিকা থাকতই। বাড়ির পাশে আইয়ুব নামে একজনের বিরিয়ানির দোকান ছিল। সেখানে প্রতিদিন খবরের কাগজ রাখা হতো। প্রতিদিন সকালে সেই দোকানে গিয়ে পত্রিকা পড়তেন। দেশ-বিদেশের খবর জানতে অনেক আগ্রহ ছিল তার। খেলাধুলায়ও তার বেশ সুনাম ছিল এলাকায়। ভালো ফুটবল খেলতেন, ব্যাডমিন্টনও খেলতেন খুব ভালো। তিনি গান গাইতে পারতেন, পারতেন কবিতা বলতে ও লিখতে।

নূর হোসেন ভাই-বোনদের আদর করতেন খুব। বিশেষ করে একমাত্র বোন সাহানা ছিল খুবই আদরের। তারা আবার নূর হোসেনকে ভয়ও পেতো খুব। যেমন আদর করতেন তেমন শাসনও করতেন। তাই তারা এই ভাই থেকে একটু দূরে দূরে থাকতেন। শুধু পরিবার নয় তার ভাবনা ছিল দেশ নিয়েও। আস্তে আস্তে তিনি রাজনীতিতে ওতপ্রোতভাবে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েন।

পরবর্তীতে ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের বনগ্রাম শাখার পাব্লিসিটি সেক্রেটারির দায়িত্ব পালন করেন। তখন থেকেই বিভিন্ন মিটিং মিছিলে যোগদান করতেন। নেতৃত্ব দিতেন। পুরোপুরি সক্রিয় হয়ে পড়েন আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে। তখন থেকেই মায়ের মনে দুশ্চিন্তা ঢুকে পড়ে। কিন্তু তখন তিনি বাবা-মাকে বলতেন, তোমরা দেখ একদিন আমি এমন কিছু করবো যেন সবাই আমাকে মনে রাখে।

নূর হোসেনের বড় ভাই আলী হোসেন বলেন, তার-আর আমার বয়সের পার্থক্য তো বেশি ছিল না। সে সব কথাই আমাকে বলতো। অনেক সময় মজা করে বলতো, ভাই তুমি তাড়াতাড়ি বিয়ে করো, তোমার পরেই তো আমার পালা। তার স্বপ্ন স্বপ্নই রয়ে গেল। দুই হাতে মেহেদির ছোপ লাগার আগেই জীবন প্রদীপ নিভিয়ে চলে গেলেন না ফেরার দেশে।

গণতান্ত্রিক আন্দোলন ও শহীদ নূর হোসেন :
আশির দশক ছিল বাঙালি জাতির ইতিহাসে এক অশুভক্ষণ। ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ বুলেটের জোরে ক্ষমতা কেড়ে নেন তৎকালীন সামরিক শাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। ধীরে ধীরে তিনি রাষ্ট্রের সকল ক্ষমতা অধিকৃত করতে লাগলেন। ক্ষমতায় বসেই বিরোধী দলের ওপর প্রয়োগ করেন দমন নীতি। বাংলার মানুষ হারাতে বসে ভাত আর ভোটের অধিকার। স্বৈরাচারকে কেউ মেনে নিতে পারেনি। স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য রুখে দাঁড়ায় ছাত্র-সমাজ, সাধারণ মানুষ ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দল। সারাদেশে শুরু হয় আন্দোলন, সংগ্রাম, মিছিল, মিটিং ও ঘেরাও কর্মসূচি।

১৯৮৭ সালের ১০ নভেম্বর থেকে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ঢাকা মহানগরী অবরোধ ঘেরাও কর্মসূচি ঘোষণা করে। এর বিপরীতে সরকার পক্ষ ৯ নভেম্বর ১৯৮৭ সালের সকাল ৬টা থেকে ১৫ নভেম্বর ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত সাতদিনের জন্য পাঁচ বা ততোধিক ব্যক্তির সমাবেশ, মিছিল, বিক্ষোভ প্রদর্শন ও সকল প্রকার অস্ত্র-শস্ত্র, বিস্ফোরক দ্রব্য, লাঠিসোটা বহন নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। আর এ আদেশ বলবৎ করার জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী নিয়োগ করা হয়। এ কথা শোনার পর নূর হোসেনের মায়ের মনে দুশ্চিন্তা বাসা বাধে। কেন না নগরীর সকল মিটিং মিছিলে নূর হোসেনের অংশগ্রহণ ছিল সুনিশ্চিত। তাছাড়া দু’দিন ধরে নূর হোসেনের কোনো খবর নেই। বাসায় আসে না। বন্ধু-বান্ধবদের জিজ্ঞেস করলে বলে, ও মিছিল মিটিং নিয়ে ব্যস্ত।

১০ নভেম্বর (বাংলা ২৩ কার্তিক) ফজর নামাজ শেষে নূরের মা-বাবা ছেলের খোঁজে বের হলেন। পরিচিত একজনের কাজ থেকে জানতে পারলেন নূর হোসেন মতিঝিলের নির্মাণাধীন ডিআইটি মসজিদের (বর্তমানে রাজউক মসজিদ) দো-তলায় অবস্থান করছে। দু’জন সেখানে গিয়ে দেখেন নূর হোসেন খালি গায়ে শুয়ে আছে, সঙ্গে তার এক বন্ধু। মা-বাবাকে দেখেই নূর উঠে তড়িঘড়ি করে চাদর দিয়ে গা ঢেকে ফেলেন। কিন্তু মায়ের চোখকে ফাঁকি দিতে পারেননি। বুকে পিঠে লেখা দেখে মায়ের মনে দুশ্চিন্তা শুরু হয়। মা বলেন, চল বাসায় চলে যাই দেশের অবস্থা বেশি ভালো না। নূর হোসেন মানলেন না। বাবা-মাকে জড়িয়ে ধরে আদর করে বললেন, তোমরা যাও আমি বেশিক্ষণ থাকবো না। সেদিন প্রায় ত্রিশ মিনিটের মতো এক সঙ্গে ছিলেন বাবা-মা ও ছেলে। সেটাই শেষ দেখা।

যে স্লোগান বুকে পিঠে লিখে গণতন্ত্রের আন্দোলনে জীবন্ত পোস্টার হয়ে ইতিহাস হয়ে আছেন সেই স্লোগান নূরের গায়ে সাদা রঙ দিয়ে লিখে দিয়েছিলেন তারই বন্ধু মো. ইকরাম হোসেন। লেখার সময় নূর হোসেনকে বলেছিলেন, ‘এভাবে বুকে পিঠে লিখলে পুলিশ যদি তোকে গুলি করে? প্রতি উত্তরে নূর বলেছিলেন, `বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশের জন্য প্রায় সারা জীবন জেল খেটেছেন, অনেক কষ্ট সহ্য করেছেন। আমি কেন পারবো না। আমি গণতন্ত্রের জন্য শহীদ হতে প্রস্তুত।

ওইদিন সকাল ৯টা পর্যন্ত ঢাকা মহানগরীর সর্বত্র জীবন যাত্রা ছিল মোটামুটি স্বাভাবিক। সকাল ৯টার দিকে তোপখানা রোড পুলিশ বক্সের অদূরে সিপিপি অফিসের সামনে কিছু লোক জমায়েত হলে পুলিশ সেখান থেকে প্রায় ২০ জনকে আটক করে। সকাল সাড়ে ৯টার দিকে বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ের আওয়ামী লীগ অফিসের সামনে থেকে প্রায় দু’শ লোকের মিছিল শুরু হয়ে পুলিশ বক্সের দিকে এগুতে থাকে। এ সময় পুলিশ হাউজ বিল্ডিং ফিন্যান্স কর্পোরেশন ভবনের সামনে লাঠিচার্জ করে। এরপর থেকে মিছিলে লোক সংখ্যা বাড়তে থাকে। তোপখানা রোডের পুলিশ বক্স থেকে গোলাপ শাহ মাজার পর্যন্ত লোক জমায়েত হতে থাকে।

১০টা ৪০ মিনিটের দিকে আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনা পুলিশ বক্সের কাছে আসেন ও তার পাজেরো জিপে দাঁড়িয়ে হ্যান্ড মাইকে ঘোষণা দেন, `আমরা সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণভাবে আমাদের কর্মসূচি পালন করে যাচ্ছি। সরকারের পদত্যাগ না হওয়া পর্যন্ত এ আন্দোলন চলবে। তিনি সচিবালয় এবং ব্যাংক বীমা থেকে সকল কর্মচারীকে বের হয়ে আসারও আহ্বান জানান। মিছিলের স্লোগান আরো জোড়ালো হতে থাকলো।

এরশাদ পতনের জন্য সংগঠিত সুবিশাল মিছিলের প্রধান ফোকাস ছিলেন একজন সাধারণ বেবিট্যাক্সি চালক মজিবুর রহমান (কাঞ্চন হাওলাদার) এর দ্বিতীয় ছেলে বাংলার ইতিহাসের এক অদম্য সাহসী বীর কালো বর্ণের, লম্বা টগবগে যুবক নূর হোসেন। সেদিন তার চোখে মুখে ছিল যেন আগুনের ফুলকি। বুকে পিঠে লেখা ছিল স্বাধীন বাংলার জনগণের অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার দাবি। সেদিন মিছিলে গিয়েছিলেন নূর হোসেনের বড় ভাই আলী হোসেনও। মিছিলে সবার আগে ছোট ভাইকে দেখে, তাকে ডেকে বাসায় ফিরে যেতে বললেন। কিন্তু কার কথা কে শোনে। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে মরণবাণী ধারণ করে যেন মরতেই এসেছিলেন অকুতোভয় নূর হোসেন।

সেদিনের ঘটনা স্মৃতিচারণ করে বঙ্গবন্ধুর কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, `সেদিন আমরা যখন মিছিল শুরু করেছিলাম তখন নূর হোসেন আমার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। আমি তাকে কাছে ডাকলাম এবং বললাম তার গায়ের এই লেখাগুলোর কারণে তাকে পুলিশ গুলি করবে। তখন সে তার মাথা আমার গাড়ির কাছে এনে বললো, `আপা আপনি আমাকে দোয়া করুন, আমি গণতন্ত্র রক্ষায় আমার জীবন দিতে প্রস্তুত।`

পায়ে কেডস জুতা, পরনে জিন্সপ্যান্ট, কোমড়ে বাঁধা শার্ট, উদোম গতর, বুকে পিঠে লেখা অমর বাণী। সত্যিই জনতার মাঝে সেদিন এক অন্য রকম মুখ ছিলেন তিনি। যা সকলের চোখে লক্ষণীয়। যেটি ফাঁকি দিতে পারেননি এরশাদের লেলিয়ে দেয়া পুলিশ বাহিনীর চোখকেও। মিছিলটি যখন গুলিস্তান জিরো পয়েন্টের কাছাকাছি পৌঁছায় ঠিক তখনই শুরু হয় মিছিলের উপর পুলিশের গুলিবর্ষণ। যার একটি গুলি এসে ফুটো করে দেয় নূর হোসেনের বুক।

বায়তুল মোকাররমের মূল গেটের কাছে মুহূর্তের মধ্যে লুটিয়ে পড়েন নূর হোসেন। মরণ যন্ত্রণায় যখন নূর হোসেন ছটফট করছিলেন তখন সুমন নামে এক যুবক তাকে একটি রিকশায় করে হাসপাতালের দিকে যাচ্ছিলেন। নূর হোসেনকে বহনকারী রিকশাটি যখন গুলিস্তানের গোলাপ শাহ মাজারের কাছে পৌঁছায় ঠিক তখনই পথের কাঁটা হয়ে দাঁড়ায় স্বৈরাচারীর পুলিশ বাহিনী। পুলিশের কয়েকটি গাড়ি এসে রিকশাটিকে চারপাশ থেকে ঘিরে ফেলে। আরো নির্মমতার স্বীকার হন মৃত্যুর সময় গুণতে থাকা নূর হোসেন। গুলিবিদ্ধ নূর হোসেনকে টেনে হিঁচড়ে রিকশা থেকে নামিয়ে পুলিশ গাড়িতে তুলে নেয়। নূর যখন মৃত্যু যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছিল, তখন একজন নিষ্ঠুর পুলিশ সদস্য পায়ের বুট দিয়ে তার বুক চেপে ধরে।

এরপর নূর হোসেনকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। পরে হয়ত বিনা চিকিৎসায় মৃত্যু যন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতে এক সময় মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে নিতে বাধ্য হন বাংলার এই সাহসী বীর সন্তান। সেদিন নূর হোসেন ছাড়াও নিহত হন যুবলীগের আরেক নেতা নূরুল হুদা বাবুল ও কিশোরগঞ্জের বাজিতপুরের ক্ষেতমজুর নেতা আমিনুল হুদা (টিটো)। সেদিন স্বৈরাচার সরকার বেশ সফলভাবেই শহীদদের বেওয়ারিশ করে দিয়েছিলেন রাতের আঁধারে জুরাইন কবরস্থানে মাটি চাপা দিয়ে।


শহীদ হওয়ার পর নূর হোসেনের পরিবার :
১৯৮৭ সালের ১০ নভেম্বর বেলা ১১টার দিকে লোকমুখে গুঞ্জন ওঠে বুকে পিঠে লেখা যুবলীগ কর্মী পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছেন। এ সব উড়ন্ত খবর নূর হোসেনের পরিবারের সবাইকে অস্থির করে তোলে।

এ বিষয়ে নূর হোসেনের মামা কালা চাঁদ মিয়া বলেন, `চারদিকে যখন খবর ওঠে নূর হোসেনের গায়ে পুলিশের গুলি লাগছে তখনই নূরের বাপে, তার বড় ভাই আলী হোসেন আর আমি পাগলের মতো ছোটাছুটি করতে থাকি। খুঁজতে থাকি নূর হোসেনকে। কিন্তু কোথাও তার খোঁজ মেলেনি। সকলের চোখমুখে তখন ছিল শুধু আতঙ্কের ছায়া। একেকজনের মুখে একেক রকম কথা। চারদিকে রব উঠছে কাপ্তান বাজারের দিকে কেউ যেতে পারছে না। চারদিকে শুধু পুলিশ আর পুলিশ।

সন্ধ্যা ৭টার দিকে হঠাৎ আলী হোসেন আমারে বলে, মামা আমার মন বলছে নূর হোসেন আর নাই। সে সত্যি সত্যিই মারা গেছে। আমি তখন তার মুখের দিকে চেয়ে কোনো কথা বলতে পারিনি। সাড়ে ৭টার দিকে পাশের বাসার মোখলেস নামে একটি ছেলে রেডিওতে বিবিসির খবর শুনে দৌঁড়ে এসে বলে, কই আপনারা? রেডিওতে নূর হোসেনের খবর বলতেছে। কয়েকবার পড়া হয় সেই খবরটি। তখন আমরা নিজ কানে শুনি আসলেই নূর হোসেন আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন না ফেরার দেশে। তখনই কান্নার রোল পড়ে বনগ্রামের এ বাড়িতে।

তারপরও খুঁজতে লাগলাম নূর হোসেনের লাশ। রাত ১২টার দিকে কিনা ঠিক মনে নাই, খবর পেলাম পুলিশের গুলিতে নিহত তিনটি লাশ পরের দিন সকালে যার যার পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হবে। সকালে লাশের খোঁজে যায় শাহবাগ কন্ট্রোল রুমে। তখন সেখানকার একজন এসপির সঙ্গে নূর হোসেনের বাবার কথা হয়। এসপি বলেন, দেখেন আমাদের যদি ক্ষমতা থাকতো তাহলে আমরা দিয়ে দিতাম। এটা আমাদের আওতার বাইরে। ঘোরাঘুরি না করে বরং চলে যান। সেখান থেকে হতাশ হয়ে আমরা ফিরে এলাম।

পরে পত্রিকায় খবর পেলাম জুরাইনের কবরস্থানে তার কবর হয়েছে। এ খবর শুনে ১৩ নভেম্বর ছুটে যায় জুরাইনে। কিন্তু কবর শনাক্ত করতে পারিনি। তবে সেদিন কবর খোদকরা বলেন, তিনজনের মধ্যে একজন ছিল সুদর্শন, ফর্সা, মোটাসোটা। তার গলায়, হাতে ও আঙ্গুলে চেইন ঘড়ি ও আংটির দাগ ছিল। অপর ব্যক্তির মুখে দাঁড়ি, পায়ে কেডস জুতা, পরনে প্যান্ট, উদোম গতর, বুকে পিঠে কী যেন লেখা ছিল। তৃতীয় ব্যক্তির পরনে ছিল চেক লুঙ্গি। তখন আন্দাজ করতে পারি কোনটা নূর হোসেনের কবর।

তিনি আরো বলেন, সেদিন নূরের বাবা কবর খুঁড়তে চেয়েছিলেন কিন্তু পারেনি। পরিবারের সকলে কান্নাকাটি করেও কোনো লাভ হয়নি। পরে শনাক্ত করা হয় পূর্ব কোণের দেয়ালের পাশের কবরটিই শহীদ নূর হোসেনের।

নূর হোসেনের আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে তাঁর পাশাপাশি তার পরিবারও সংবাদের শিরোনাম হয়ে উঠেছিল। বিভিন্ন পত্রিকায় তাদের নিয়ে অসংখ্য খবর প্রকাশিত হয়। তার পরিবারের সদস্যদের সাক্ষাৎকারও নেয়া হয় অনেক। নানা সভা-সমাবেশে নূরের বাবা মজিবুর রহমানকে অতিথি করা হয়। এমনকি বুদ্ধিজীবীদের অংশগ্রহণে অনেক অনুষ্ঠানে তাকে প্রধান অতিথির আসন দিয়ে সম্মান দেয়া হয়। বড় বড় সম্মানিত লোকেরা তার পরিবারের খোঁজ খবর নিয়েছেন, তাদের সঙ্গে কথা বলেছেন। এক কথায় অনেক সম্মান পেয়েছেন নূর হোসেনের দরিদ্র পরিবার। এ সম্মানের মাঝেই তার বাবা-মা ছেলের শোকের সান্ত্বনা খুঁজতে চেষ্টা করেছেন।

পুত্র বিয়োগের শোক বুকে চেপে মজিবুর রহমান রোদ-বৃষ্টি, কুয়াশা উপেক্ষা করে ঢাকার রাস্তায় বেবিট্যাক্সি চালিয়ে কোনো রকম সংসারের খরচ যোগাড় করেন। তখনও তাকে দৈনিক জমা দিতে হতো ১৫০ টাকা। তেল, স্ট্যান্ড পার্কিং ও খাওয়া খরচ বাদে সারাদিন শেষে হাতে অবশিষ্ট থাকত ৬০ থেকে ৭০ টাকা। এই রোজগার বেশি হলে ১০০ টাকা হতো। অসুস্থ শরীর নিয়ে যেদিন বেবিট্যাক্সি চালাতে পারতেন না সেদিন চলতে হতো কষ্ট করে। কেননা নূর হোসেনের বাড়তি টাকা আর সংসার খরচে যোগ হচ্ছে না। বড় ছেলে আলী হোসেনও কখনো কাজ পাচ্ছেন আবার কখনো বেকার হয়ে পড়ছে। তাছাড়া অন্যরাও বেশ ছোট। তখন পুরো খরচ বহনের ভার পড়তো সেই বৃদ্ধ মজিবুর রহমানের ঘাড়েই। মজিবুর রহমান ব্যক্তি হিসেবে ছিলেন খুবই মহান, গরীব হলেও তার মন ছিল আকাশের মতো বিশাল।

নব্বই এর দশকে এসে মজিবুর রহমান শারীরিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েন। তিনি তখন আর আগের মতো পরিশ্রম করতে পারতেন না। শহীদের বাবা তার ছেলে-মেয়েদের ভবিষ্যত নিয়ে শঙ্কায় ভুগতেন। তখন তার বড় ছেলে আলী হোসেনের জন্য লেখক ও বর্তমান প্রথম আলো পত্রিকার সম্পাদক মতিউর রহমান একটি চাকরির ব্যবস্থা করেছিলেন। পরে তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনার নিজস্ব গাড়িচালক হিসেবে নিয়োগ পান। বর্তমানেও তিনি এ দায়িত্বে আছেন। তাছাড়া তিনি বর্তমানে বাংলাদেশ আওয়ামী মোটরচালক লীগের সভাপতি।

১৯৯৬ সালে এরশাদ জেল থেকে ছাড়া পেয়ে নূর হোসেনের পরিবারের সঙ্গে দেখা করে তাদের খরচের জন্য মাসিক পাঁচ হাজার টাকা দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেও মজিবুর রহমান এক সভায় এরশাদকে স্বৈরাচার বলায় টাকা দেয়া বন্ধ করে দেয়া হয়। বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনা (১৯৯৬-২০০১) প্রধানমন্ত্রী হলে নূর হোসেনের পরিবার ১৯৯৭ সালে সরকারের কাছ থেকে মিরপুর মাজার রোডে পাঁচ কাঠা পরিমাণ একটি জমি পায়। পরে ১৯৯৮ সালে কোন রকমে টিনশেড বাসা তৈরি করে নূর হোসেনের পরিবারের সবাই বনগ্রাম রোডের বাসা ছেড়ে এই বাসায় এসে ওঠেন।

বর্তমানে নূর হোসেনের পরিবারে কিছুটা স্বচ্ছলতা ফিরে এসেছে। তার বড় ভাই আলী হোসেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত গাড়িচালক, ছোট ভাই দেলোয়ার হোসেন ও আনোয়ার হোসেন ব্যবসা করেন, বোন সাহানার স্বামী মো. আজগর আলীও ছোট খাটো ব্যবসা করেন। অভাবের কারণে তারা বেশি পড়ালেখা না করতে পারলেও তাদের ছেলে-মেয়েরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছে।

মজিবুর রহমানের মৃত্যুর পর ২০০৭ সালে মিরপুর মাজার রোডের জায়গাটি দেয়া হয় ক্যাসেরো ডিজাইন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টস লি. নামে একটি আবাসন নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানকে। সেখানে ক্যাসেরো শহীদ নূর হোসেন টাওয়ার নামে ১৩তলা একটি ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে। কিন্তু তিন বছরের মধ্যে ভবনটির দায়িত্বভার দেয়ার কথা থাকলেও প্রায় দশ বছর পার হওয়ার পর মাত্র তিনতলার ছাদ ঢালাই করা হয়। এটি নিয়ে বেশ বিপাকে পড়েছেন তারা। সবাইকে এখন থাকতে হচ্ছে ভাড়া বাসায়।

তার স্মৃতিতে গড়ে ওঠা স্থাপনা ও সম্মাননা :
শহীদ নূর হোসেনের স্মৃতিকে স্মরণীয় করে রাখতে তার আত্মত্যাগকে শ্রদ্ধা জানিয়ে গণতান্ত্রিক সরকারের আমল থেকে নূর হোসেনের মৃত্যুর দিনটিকে সরকারিভাবে প্রথমে ঐতিহাসিক ১০ নভেম্বর দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়। পরে আওয়ামী লীগের সমর্থনে ১০ নভেম্বরকে শহীদ নূর হোসেন দিবস হিসেবে পালন করা হয়। ১৯৯৬ সালে এরশাদ নূর হোসেনের মৃত্যুর জন্য জাতীয় সংসদে অফিসিয়ালভাবে ক্ষমা প্রার্থনা করে এবং তার দল জাতীয় পার্টি ১০ নভেম্বরকে গণতন্ত্র দিবস হিসেবে পালন করে।

তার স্মৃতিতে গড়ে ওঠা স্মারক ও স্থাপনার বিবরণ এই-যে স্থানে পুলিশের গুলিতে নিহত হন, তার নামানুসারে সেই গুলিস্থানের জিরো পয়েন্টের নামকরণ করা হয় নূর হোসেন চত্বর। ১৯৯১ সালে তার চতুর্থ মৃত্যুবাষির্কী উপলক্ষে দুই টাকা মূল্যের স্মারক ডাকটিকিট প্রকাশিত হয়। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া তার কার্যালয়ে এক অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে তা অবমুক্ত করেন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে শহীদ নূর হোসেনের একটি মুরাল রয়েছে। `স্বাধীনতা সংগ্রাম ভাস্কর্য` চত্বরে বিভিন্ন শহীদ, জাতীয় বীর, জগৎ বিখ্যাত বুদ্ধিজীবী, কবি-সাহিত্যিকদের ভাস্কর্যের সঙ্গে স্থান পায় শহীদ নূর হোসেনের ভাস্কর্য। এর শিল্পী ভাস্কর শামীম সিকদার। ভাস্কর্যটির উচ্চতা ১০ ফুট, দৈর্ঘ্য ৫ ফুট এবং প্রস্থ ৫ ফুট।

এদিকে পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া উপজেলার ঝাটিবুনিয়া গ্রামে `শহীদ নূর হোসেন` এর নামে মঠবাড়িয়া থেকে সাপলেজা পর্যন্ত রাস্তাটি শহীদ নূর হোসেন সড়ক নামে নামকরণ, একটি মুরাল নির্মাণ করা, একটি আধুনিক পাঠাগার স্থাপন করে নামকরণের জন্য কর্তৃপক্ষের সুুদৃষ্টি কামনা করেছেন এলাকাবাসী। বাংলা ও বাংলাদেশের মুক্তির সংগ্রামে বৃহত্তর বরিশালের সকল কৃতি সন্তানদের অবদানের স্বীকৃতি প্রদানে জোর দাবিও জানিয়েছেন স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা বিধান চন্দ্র কৃতনিয়া, শিক্ষক নুর হোসেন মোল্লা, আব্দুল ছালাম, রুহুল আমিন হাওলাদার, শওকতউল­্লাহ ও নুরুল আমিন রাসেল।

শহীদ নূর হোসেনের আত্মত্যাগ বাংলাদেশের নেতাকর্মী, লেখক, কবি-সাহিত্যিক, সাংবাদিকসহ নানা শ্রেণির মানুষকে আলোড়িত করেছিল দারুণভাবে। তাকে নিয়ে লেখা হয় অনেক কবিতা, গল্প, গান আর নাটকও। বুকে ও পিঠে লেখা স্লোগানটি সারাদেশের জনতার স্লোগানে পরিণত হয়। ফলে সেই সংগ্রামের ধারায় ১৯৯০ সালের ৪ ডিসেম্বর স্বৈরাচারী শাসক পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। এর মধ্যে দিয়ে স্বৈরাচার সরকারের পতন ঘটে এবং গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয় । বাংলার মানুষ পায় ভাত ও ভোটের অধিকার। স্বাধীনতার পর বাঙালি জাতি যেন আবার নতুন করে পায় স্বাধীনতার স্বাদ।

এসএস/বিএ