৫০ কোটির নিচের প্রকল্পের ‘খাত ও খরচ’ থাকছে গোপন!
>> ৫০ কোটির উপরের প্রকল্পগুলোর খাত ও খরচ একনেকে জানানো হয়
>> ৫০ কোটির নিচের প্রকল্পগুলোর অনুমোদন দেন স্বয়ং পরিকল্পনামন্ত্রী
>> জবাবদিহিতা নিশ্চিতে সব প্রকল্পের খাতভিত্তিক খরচ উন্মুক্ত প্রয়োজন
২০১৯ সালের ১৬ জানুয়ারির প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) কাজ ছয়টি। এর মধ্যে দুই নম্বর কাজটি হলো ‘সরকারি খাতে ৫০ কোটি টাকার ঊর্ধ্বে মোট বিনিয়োগ ব্যয়সংবলিত প্রকল্পগুলোর প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভার সুপারিশ বিবেচনা ও অনুমোদন’। ৫০ কোটির নিচের সরকারি প্রকল্পগুলো বিবেচনা ও অনুমোদন দেবেন পরিকল্পনামন্ত্রী। মন্ত্রীর অনুমোদনের পর তা একনেকে অবহিত করা হয়। মূলত এ দুটি উপায়ে সরকারের উন্নয়ন প্রকল্পগুলো পাস হয়।
একনেক সভায় যেসব প্রকল্প বিবেচনা ও অনুমোদনের জন্য উত্থাপন করা হয়, সেসব প্রকল্পে কোন খাতে কত টাকা খরচ করা হবে, তা অবগত করা হয়। কিন্তু ৫০ কোটির নিচের প্রকল্পগুলোর খাত ও খরচ একনেক সভাকে অবগত করা হয় না। পরিকল্পনা কমিশনের সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলো একনেককে খাত ও খরচ অবগত করা থেকে বিরত থাকে।
৬ অক্টোবর, ২৯ সেপ্টেম্বর ও ২২ সেপ্টেম্বর – সর্বশেষ এই তিনটি একনেক সভায় অবগত করা প্রকল্পে খাত ও খরচের তথ্য গোপন রাখে পরিকল্পনা কমিশনের বিভাগগুলো। এই তিন একনেক সভায় মোট সাতটি প্রকল্প সম্পর্কে একনেক সভাকে অবগত করা হয়, যা ৫০ কোটির নিচে হওয়ায় পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান অনুমোদন দেন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, করোনা শুরুর আগে অবগত করা প্রকল্পগুলোর মধ্যে কোন কোন খাতে, কত বরাদ্দ— সেসব তথ্য উল্লেখ করা হতো। তবে করোনা সংক্রমণের পর তা অবগত করতে দেখা যাচ্ছে না। যেমন- করোনা শুরুর আগে ১১ ফেব্রুয়ারির একনেককে তিনটি প্রকল্প সম্পর্কে অবগত করা হয়। এর মধ্যে দুটি না করা হলেও একটি প্রকল্পের খাত ও ব্যয় সম্পর্কে অবগত করা হয় একনেক সভায়। পরিকল্পনা কমিশনের আর্থসামাজিক বিভাগের অবগত করা সেই প্রকল্পটি হলো ‘মনিটরিং দ্য সিচ্যুয়েশন অব ভাইটাল স্ট্যাটিসস্টিকস অব বাংলাদেশ (এমএসভিএসবি)’। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)। এতে খরচ করা হচ্ছে ৪৪ কোটি ১০ লাখ ৫২ হাজার টাকা।
অন্যদিকে পরিকল্পনা বিভাগ তাদের ওয়েবসাইটে খাত ও খরচ জিও আকারে প্রকাশ করে। সেখানেও খাত ও খরচের হিসাব জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করতে ঠাঁই হচ্ছে না পরিকল্পনামন্ত্রীর অনুমোদন দেয়া ৫০ কোটির নিচের প্রকল্পগুলো।
খোঁজ নিয়ে আরও জানা যায়, এসব প্রকল্পেও অস্বাভাবিক দাম ধরা হয় বিভিন্ন পণ্যের। এমন একটি প্রকল্প ‘প্রফুল্ল প্রতিভা প্রবীণ নিবাস, এতিমখানা ও বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ব্যক্তিদের সাহায্য কেন্দ্র, মাগুরা’। প্রকল্পটিতে কাঠের পাঁচটি চা খাওয়ার টেবিল কেনা হবে। ২৫ হাজার টাকা করে পাঁচটি টেবিলের দাম ধরা হয়েছে এক লাখ ২৫ হাজার টাকা! প্রকল্পে ১০টি চায়না টেবিল লাইট কেনা হবে। এখানে প্রতিটি লাইটের দাম ধরা হয়েছে পাঁচ হাজার টাকা করে। ফলে ১০টি টেবিল লাইট কিনতে প্রস্তাব করা হয়েছে ৫০ হাজার টাকা। প্রকল্পটিতে এমন ২৯টি খাত দেখানো হয়েছে, সবগুলোতেই বাজার মূল্যের চেয়ে বেশি দাম ধরা হয়েছে।
ফলে এমন ৫০ কোটির নিচের প্রকল্পগুলোর খাতভিত্তিক খরচ গোপন থাকায় সেখানে অনিয়ম হলেও তা প্রকাশ পাচ্ছে না।
গত ৬ অক্টোবর ‘নোয়াখালী জেলার সুবর্ণচর উপজেলায় ডাল ও তৈলবীজ বর্ধন খামার আধুনিকীকরণ এবং চুক্তিবদ্ধ চাষীদের মাধ্যমে বীজ উৎপাদন ও প্রক্রিয়াজাতকরণ’ নামে একটি প্রকল্প পরিকল্পনামন্ত্রীর অনুমোদন শেষে একনেক সভাকে অবহিত করা হয়। প্রকল্পটি যাচাই-বাছাই শেষে একনেকে অবগত করে পরিকল্পনা কমিশনের কৃষি, পানি সম্পদ ও পল্লী প্রতিষ্ঠান বিভাগ।
এ বিভাগের সদস্য (সচিব) মো. জাকির হোসেন আকন্দের সঙ্গে গত বৃহস্পতিবার (১৫ অক্টোবর) কথা হয় জাগো নিউজের। তার কাছে প্রশ্ন রাখা হয়, ‘গত তিনটি একনেক সভায় অবহিতকরণ প্রকল্পের ব্যয়ের খাতগুলো উল্লেখ করা হয়নি। সর্বশেষ একনেকে আপনার বিভাগের একটি প্রকল্পের বিষয়ে অবগত করা হয়। কিন্তু সেখানে ব্যয়ের খাত উল্লেখ ছিল না। অবগতির প্রকল্পে ব্যয়ের খাতগুলো উল্লেখ না করার কারণ কী?’
জবাবে জাকির হোসেন আকন্দ বলেন, ‘অবগতির প্রকল্পে কতটুকু অবগতি করবে, সেগুলো কি আপনাদের বলব? এটার একটা নির্দিষ্ট ইয়ে আছে, অবগতির জন্য। এ প্রকল্পের নাম, সামারি (সারসংক্ষেপ) আছে– সেগুলো যায়। এখন অবগতির খাত, ব্যয়ের খাত, অমুক খাত-তমুক খাত, এগুলো…।’
গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে একনেক সভা পরিচালনা করছেন প্রধানমন্ত্রী [ফাইল ছবি]
‘আপনারা (সাংবাদিকরা) কতগুলো প্রশ্ন করেন, যে প্রশ্নগুলো আপনাদের মানায় না। আপনাদের প্রশ্নের উত্তর দেই, কিন্তু আপনারা সামটাইমস বিয়ন্ড দ্য বাউন্ডারি (মাঝে মধ্যে সীমা ছাড়িয়ে যান)। এগুলো কিন্তু ঠিক নয়। এটার জবাবদিহিতা তো প্রধানমন্ত্রীর (একনেক সভার চেয়ারপারসন) কাছে করব। আপনারা জানতে চাচ্ছেন কেন?’ এই তিনি ফোন কেটে দেন।
বিশেষজ্ঞ ও আইনজ্ঞরা মনে করেন, জবাবদিহিতা-স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার জন্য একনেক সভায় ৫০ কোটির ওপরের প্রকল্পের মতো ৫০ কোটির নিচের প্রকল্পগুলোর খাতভিত্তিক খরচ উল্লেখ করা প্রয়োজন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আইনজীবী খুরশিদ আলম জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমি মনে করি, স্বচ্ছতার কারণে খাত ও খরচের পরিমাণ উল্লেখ করা উচিত। একনেক সভায় যখন অবহিত করবেন, সেটা খাতসহ অবহিত করা উচিত। যদি না করেন, আমার বক্তব্য হলো, স্বচ্ছতার কারণে খাতসহ অবহিত করা উচিত।’
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, ‘পরিকল্পনামন্ত্রী যেগুলোর অনুমোদন দিচ্ছেন, সেগুলোর খাতভিত্তিক খরচ ওয়েবসাইটে (পরিকল্পনা কমিশনের ওয়েবসাইটে জিও আকারে) বিস্তারিত দিয়ে দেয়া ভালো। একনেকে যেটা অবহিতকরণের জন্য দেয়া হলো, সেখানেও বিস্তারিত দিলে ভালো। তা হলেও একধরনের জবাবদিহিতা থাকবে। একনেকে অবহিতকরণ করা হয়েছে, তারপরও যদি একনেক কোনো প্রশ্ন তুলতে চায়, প্রশ্ন তুলতে পারবে। এমন যদি করা যায়, তাহলে আরেকটা লেভেলে জবাবদিহিতা থাকল, আর কি।’
‘একনেকে বিস্তারিত আলোচনা করল না, কেউ যদি দেখতে চান, তাহলে সেকেন্ড লেভেল অব অ্যাকাউন্টিবিলিটি থাকল। আমার মনে হয়, সেটাও খারাপ হয় না।’
সর্বশেষ তিন একনেকে অবগত করা যত প্রকল্প
গত ৬ অক্টোবর, ২৯ সেপ্টেম্বর ও ২২ সেপ্টেম্বর– সর্বশেষ এই তিন একনেকে মোট সাতটি প্রকল্পের বিষয়ে অবগত করেছে পরিকল্পনা কমিশনের বিভিন্ন বিভাগ। সবগুলো অবগতকরণ প্রকল্পে খাত ও খরচ একনেকে অবগত করার জন্য উল্লেখ করা হয়নি। ফলে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতার ঘাটতি থেকে যাচ্ছে এসব প্রকল্পে।
ওই তিন একনেক সভায় অবগত করা প্রকল্পগুলোর বিস্তারিত তুলে ধরা হলো-
গত ৬ অক্টোবর অনুষ্ঠিত একনেকে দুটি প্রকল্প অবগত করা হয়। তার মধ্যে পরিকল্পনা কমিশনের আর্থসামাজিক বিভাগ অবহিত করেছে ‘২৫টি জেলা সদরে বিদ্যমান টেনিস অবকাঠামোসমূহের উন্নয়ন’। প্রকল্পটি যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ বাস্তবায়ন করবে। এতে খরচ হবে ৪৯ কোটি টাকা।
একনেক সভা শেষে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নানের সংবাদ সম্মেলন [ফাইল ছবি]
কৃষি, পানি সম্পদ ও পল্লী প্রতিষ্ঠান বিভাগ অবগত করেছে ‘নোয়াখালী জেলার সুবর্ণচর উপজেলায় ডাল ও তৈলবীজ বর্ধন খামার আধুনিকীকরণ এবং চুক্তিবদ্ধ চাষীদের মাধ্যমে বীজ উৎপাদন ও প্রক্রিয়াজাতকরণ’ প্রকল্প। কৃষি মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি)। এর খরচ বাবদ অনুমোদন দেয়া হয়েছে ৪০ কোটি ১৪ লাখ টাকা।
গত ২৯ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত একনেক সভায় একটি প্রকল্প সম্পর্কে অবগত করা হয়েছে। পরিকল্পনা বিভাগের ভৌত অবকাঠামো বিভাগের অবগত করা প্রকল্পটি হলো ‘আধুনিক পদ্ধতিতে বিভিন্ন সড়কের পটহোলস মেরামত ও ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা উন্নয়নের লক্ষ্যে যান-যন্ত্রপাতি সংগ্রহ’। প্রকল্পটি স্থানীয় সরকার বিভাগের উদ্যোগে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) বাস্তবায়ন করবে। এতে খরচ ধরা হয়েছে ৪৮ কোটি ৩৪ লাখ টাকা।
গত ২২ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত একনেক সভায় চারটি প্রকল্প সম্পর্কে অবগত করা হয়। তার মধ্যে ভৌত অবকাঠামো বিভাগ অবগত করেছে ‘সাম্প্রতিক (২০১৮) বন্যায় সিলেট মহানগরীর ক্ষতিগ্রস্ত রাস্তা ও ফুটপাত সংস্কার’ প্রকল্পের বিষয়ে। প্রকল্পটি স্থানীয় সরকার বিভাগের উদ্যোগে বাস্তবায়ন করবে সিলেট সিটি করপোরেশন (এসসিসি)। এতে খরচ হবে ৪৬ কোটি দুই লাখ ২১ হাজার টাকা। এদিন ভৌত অবকাঠামো বিভাগ আরও একটি প্রকল্প একনেক সভায় অবগত করে। সেটি হলো ‘পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় কমপ্লেক্সে বিদ্যমান ভবন ও অবকাঠামোসমূহের মানোন্নয়ন’। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে পরিকল্পনা বিভাগ ও গণপূর্ত অধিদফতর। এতে খরচ হবে ১৭ কোটি ৮৭ লাখ ৩৩ হাজার টাকা। একনেক সভায় আর্থসামাজিক অবকাঠামো বিভাগ অবগত করেছে ‘দেশের পাঁচটি জেলার এতিম, দুস্থ ও বিধবা মহিলাদের ড্রাইভিং প্রশিক্ষণের মাধ্যমে আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়ন’ প্রকল্প সম্পর্কে। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে সমাজসেবা অধিদফতর (প্রত্যাশী সংস্থা : সমাধান)। এতে খরচ হবে ২৪ কোটি ৯৫ লাখ ৯১ হাজার টাকা।
আর্থসামাজিক বিভাগ আরও একটি প্রকল্প এদিন একনেক সভায় অবগত করে। সেটি হলো ‘সিরাজগঞ্জ জেলার শাহজাদপুরে ফুজলুল হক প্রবীণ নিবাস (থেরাপি সেন্টারসহ) এবং অনগ্রসর কিশোর-কিশোরীদের জন্য বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র নির্মাণ’। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে সমাজসেবা অধিদফতর ও দুগলী ফজলুল হক ফাউন্ডেশন প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে। এতে খরচ হবে ২৪ কোটি ৭২ লাখ ৫৮ হাজার টাকা।
পিডি/এমএআর/এমএস