ধর্ষণের শাস্তি ‘কঠোর’ হচ্ছে, মানসিকতা বদলাবে কে?
প্রেমের প্রস্তাবে প্রত্যাখ্যাত হয়ে স্কুলছাত্রীকে প্রকাশ্যে ছুরিকাঘাতে হত্যা, খাগড়াছড়িতে চাকমা নারীকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ, সঙ্গে বর্বর নির্যাতন; সিলেটের এমসি কলেজ ছাত্রাবাসে স্থানীয় ছাত্রলীগকর্মী কর্তৃক স্বামীকে বেঁধে রেখে স্ত্রীকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনা দেশ-বিদেশে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে।
সব ছাপিয়ে সর্বত্র আলাচনা-সমালোচনা নোয়াখালীর নারী ধর্ষণ, ধর্ষণচেষ্টার ঘটনার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়ার মতো বর্বরতা। এ ধরনের ভয়াবহ ও বর্বর ধর্ষণ-নির্যাতনের ঘটনা এ বছর যেন সবকিছুকে ছাপিয়ে গেছে। বিক্ষোভ-স্লোগানে উত্তাল হয়ে উঠেছে রাজপথ।
ভয়াবহ এসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে সংশোধিত ‘নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০’ এর খসড়া আগামীকাল সোমবার (১২ অক্টোবর) মন্ত্রিসভা বৈঠকে অনুমোদনের জন্য উঠছে। এ বিষয়ে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী আনিসুল হক জাগো নিউজকে বলেন, ‘আইন সংশোধনের জন্য একটি প্রস্তাব আগামী মন্ত্রিসভা বৈঠকে যাচ্ছে। মূলত আইনের ৯ (১) ধারায় পরিবর্তন আনা হচ্ছে। এ ধারায় ধর্ষণের শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড থেকে বাড়িয়ে মৃত্যুদণ্ড করে প্রস্তাব দেয়া হবে। এ আইনের আরও কয়েকটি স্থানেও ছোট ছোট পরিবর্তন আনা হচ্ছে।’
সাধারণ শিক্ষার্থীদের ধর্ষণবিরোধী আন্দোলন
ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান রাখার বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. সাদেকা হালিম জাগো নিউজকে বলেন, প্রযুক্তিগত উন্নতি ঘটলেও নারীর প্রতি মানসিকতার উন্নয়ন ঘটেনি। ধর্ষকের রাজনৈতিক পরিচয় বের হচ্ছে কিংবা কারও না কারও ছত্রচ্ছায়ায় অপরাধী হয়ে উঠছে। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ১৫টি সেকশনের মধ্যে ৯টিতে মৃত্যুদণ্ড দেয়া আছে। তারপরও দেশে নারী ও শিশু নির্যাতনের হার কমছে না কেন, এর উত্তর খোঁজা জরুরি।
তিনি মনে করেন, ‘ধর্ষণ, নির্যাতন, নিপীড়নের বিরুদ্ধে সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে সমন্বিত উদ্যোগের পাশাপাশি যথাযথ আইনের সর্বোচ্চ প্রয়োগ করতে হবে। মানুষ হিসেবে মানসিকতা বদলাতে হবে। তবেই ধর্ষণ কমবে, অপরাধীর বিচার হবে।’
চলতি বছরের ৯ মাসে (জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর) ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে মোট ৯৭৫টি। সে হিসাবে প্রতিদিন গড়ে তিনটির বেশি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) এবং মহিলা পরিষদ কর্তৃক প্রকাশিত প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে এসেছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, আইনের শাসন দুর্বল হয়ে পড়লে ধর্ষণ, নারী ও শিশু নির্যাতনের মতো ঘটনা ঘটতেই থাকে। পাশাপাশি বিচারহীনতার সংস্কৃতি ভুক্তভোগীদের কষ্ট ও যন্ত্রণা আরও বাড়িয়ে দেয়। দেশে আইনের শাসন দুর্বল হওয়ায় রাজনৈতিক প্রভাব-বলয় ও ক্ষমতার অপব্যবহার বাড়ে।
সাধারণ শিক্ষার্থীদের ধর্ষণবিরোধী আন্দোলন
নারীদের অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠনের নেতারা বলছেন, অধিকাংশ ঘটনার বিচার হয় না, অপরাধীরা পার পেয়ে যায়। মূলত বিচারহীনতার সংস্কৃতিই এমন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা বাড়িয়েছে। পুরোনো আইনে ধর্ষণ ও নির্যাতনের বিচার প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতার জন্ম দিয়েছে। পাশাপাশি মূল্যবোধ, নৈতিকতা ও সামাজিক অবক্ষয়ও এজন্য দায়ী। সম্প্রতি ধর্ষকদের রাজনৈতিক ও প্রভাব-বলয় আরও উদ্বেগ তৈরি করেছে।
সম্প্রতি আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত ৯ মাসে সারাদেশে ৯৭৫টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। ধর্ষণের পর ৪৩ জনকে হত্যা করা হয়। আত্মহত্যা করেন ১২ জন নারী। গত বছর একই সময়ে (জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর) ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছিল এক হাজার ১১৫টি। ওই সময়ে ৫৭ নারীকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়।
পারিবারিক নির্যাতনের তথ্য পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে, গত বছরের তুলনায় এ বছরের প্রথম ৯ মাসে পারিবারিক নির্যাতনের সংখ্যা বেড়েছে। গত বছরের প্রথম ৯ মাসে ২৯৭ নারী নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এ বছর তা বেড়ে ৪৩২ জনে দাঁড়িয়েছে। নির্যাতিত নারীদের মধ্যে ২৭৯ জন হত্যার শিকার হয়েছেন। নির্যাতন-নিপীড়নের কারণে আত্মহত্যা করেছেন ৭৪ নারী। গত বছরের প্রথম ৯ মাসে অ্যাসিড নিক্ষেপের ঘটনা ছিল ১২টি, চলতি বছর সেটি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২১টিতে।
আসকের হিসাবে, চলতি বছর গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন ২০৮ জন নারী। যৌন হয়রানির প্রতিবাদ করতে গিয়ে তিন নারী ও ছয় পুরুষ নিহত হয়েছেন। গত ৯ মাসের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে জুন মাসে। এ মাসে ১৭৬টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। গণধর্ষণের ঘটনা ঘটে ৩৯টি। ৯ মাসে এ সংখ্যাও সবচেয়ে বেশি।
ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের দাবিতে নির্মিত প্রতীকী ফাঁসির মঞ্চ
অন্যদিকে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত সেপ্টেম্বরে ১৭৩ কন্যাশিশু নির্যাতন এবং ১২৯টি ধর্ষণের ঘটনাসহ মোট ৩৪০টি নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। গত মাসে ১২৯ জন ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে ৭৩ জন শিশু, ১০৯ জন নারী। ১০ জন শিশুসহ ২০ জন গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন।
এছাড়া ছয় শিশুসহ ধর্ষণচেষ্টার ঘটনা ঘটেছে ৯টি। শ্লীলতাহানির শিকার হয়েছে দুই শিশুসহ চারজন। চার শিশুসহ যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছেন সাতজন। দুই শিশুসহ এসিডদগ্ধের শিকার ছয়জন। শারীরিক নির্যাতনের শিকার সাত শিশুসহ ২৭ জন। বিভিন্ন নির্যাতনের কারণে ১৪ শিশুসহ আত্মহত্যা করেছেন ২০ জন এবং ছয় শিশুসহ ২৮ জনের রহস্যজনক মৃত্যু হয়েছে।
এ ব্যাপারে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান নাছিমা বেগম বলেন, ধর্ষণের ঘটনা উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। সর্বশেষ নোয়াখালীর ঘটনা আদিম যুগের বর্বরতাকেও হার মানায়। নির্যাতনকারীরা পশুর চেয়েও অধম। এমন জঘন্য ঘটনা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয় এবং এ ঘটনা মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন।
তিনি বলেন, নারীর মানবাধিকার সুরক্ষিত করার লক্ষ্যে নারীর প্রতি নির্যাতনের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি বাস্তবায়ন আবশ্যক। নির্যাতনকারী যেই হোক না কেন তাকে আইনের আওতায় এনে দ্রুত দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করতে হবে।
সাধারণ শিক্ষার্থীদের ধর্ষণবিরোধী আন্দোলন
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু বলেন, করোনা মহামারির সময় পুরো দেশ ধর্ষণের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়। নারীরা যখন তাদের মেধা, শ্রম ও নিজ প্রচেষ্টার মাধ্যমে দেশের উন্নয়নে অবদান রাখছে তখন ক্রমবর্ধমান হারে সহিংসতার ঘটনা বড় প্রতিবন্ধকতা। সহিংসতার ঘটনায় রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ছত্রচ্ছায়ায় যে বিভিন্ন অপরাধী বাহিনী গড়ে উঠছে, এগুলো প্রশাসনিকভাবে প্রতিহত করা না হলে সহিংসতার ঘটনা বাড়তেই থাকবে।
আসকের কার্যনির্বাহী পরিষদের মহাসচিব নূর খান জাগো নিউজকে বলেন, যখন দুর্বৃত্তরা সমাজকে, রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করে, তখন দুর্বৃত্তরা বেপরোয়া হয়ে যায়। সেই বেপরোয়ারই বহিঃপ্রকাশ আমরা ইদানিং বেশি দেখছি। বিচারহীনতার সংস্কৃতি, তদন্তে দীর্ঘসূত্রতাও বড় কারণ। পেশিশক্তি, টাকা ও রাজনৈতিক শক্তির কোনোটি যদি কোনো ব্যক্তির কাছে থাকে, তখন তিনি যা ইচ্ছা তাই করতে পারেন। আইন বা কোনো কিছুই তাকে স্পর্শ করতে পারবে না বলে মনে করেন।
‘আর সমাজ বা পরিবারের নৈতিকতাও নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে, পাচারকারীদের কারও কিছুই হচ্ছে না, উল্টো সেই টাকা ভোগ করছে তারা। সেখানে ধর্ষকরা কী করে ভাববে যে, ধর্ষণ করলে তার বিচার হবে?’
উত্তরণের উপায় সম্পর্কে তিনি বলেন, সম্মিলিত উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। রাজনীতিতে আদর্শের চর্চা, আদর্শের সংগ্রাম থাকা দরকার। কারণ সমাজ ও দেশকে এগিয়ে নিতে হলে রাজনৈতিক শক্তিই দরকার। স্বচ্ছতা, আদর্শিক অবস্থান রাজনৈতিকভাবেই আগে দরকার।
জেইউ/এমএআর/পিআর