ভিডিও EN
  1. Home/
  2. বিশেষ প্রতিবেদন

ধর্ম ফেলে দেয়া যাবে না, রাষ্ট্র থেকে আলাদা রাখতে হবে

সায়েম সাবু | প্রকাশিত: ০৯:৫৩ পিএম, ২২ সেপ্টেম্বর ২০২০

শাহরিয়ার কবির। বিশিষ্ট সাংবাদিক, লেখক ও গবেষক। ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি। সংখ্যালঘু নির্যাতন বন্ধ এবং যুদ্ধাপরাধ বিচারের দাবিতে সোচ্চার ছিলেন দীর্ঘকাল। চীনের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের সম্পর্ক উন্নয়নের বিষয়ে নানা ঝুঁকির কথা উল্লেখ করে সম্প্রতি উদ্বেগ প্রকাশ করেন। একই সঙ্গে ‘ভারত অকৃত্রিম বন্ধু’ উল্লেখ করে দেশটির সঙ্গে সম্পর্ক অটুট রাখার অভিমত ব্যক্ত করেন।

ভারত-চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের নানা দিক নিয়ে মুখোমুখি হন জাগো নিউজের। আলোচনা করেন বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রসঙ্গেও। বলেন, ‘রাষ্ট্রক্ষমতায় শেখ হাসিনা থাকলে উদ্বেগের কোনো কারণ নেই’। ‘বর্তমান আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধুর আদর্শ থেকে অনেক দূরে সরে গেছে’ বলেও মত দেন। তিন পর্বের সাক্ষাৎকারের আজ থাকছে শেষটি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সায়েম সাবু

জাগো নিউজ : ভারত-চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের নানা দিক বিশ্লেষণ করেছেন আগের দুই পর্বে। এই পরিস্থিতির মধ্যে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ কী?

শাহরিয়ার কবির : বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ শান্তির দিকে। আমরা কারও সঙ্গে শত্রুতা তৈরির পক্ষে নই। বন্ধুত্ব সবার সঙ্গে। বাংলাদেশ বিশ্ব শান্তির পক্ষে। এগুলো সবই বঙ্গবন্ধুর দর্শন। ১৯৭২ সালের সংবিধান হচ্ছে বাংলাদেশের জাতীর দর্পণ। কিন্তু বর্তমান আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধুর আদর্শ থেকে অনেক দূরে সরে গেছে।

শেখ হাসিনার সরকার এবার এসে গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়ে ব্যাখ্যা দিচ্ছেন। সহনীয় ধর্মনিরপেক্ষতা যাকে বলে। ধর্মকে ফেলে দেয়া যাবে না, কিন্তু রাষ্ট্র থেকে আলাদা রাখতে হবে। তুরস্কের কামাল আতাতুর্ক ধর্মকে নাকচ করেছিলেন। এটি করলে আর চলবে না। ধর্ম ধর্মের জায়গায়, রাষ্ট্র রাষ্ট্রের জায়গায় রাখতে হবে।

জাগো নিউজ : শেখ হাসিনার সরকারের যে অভিযাত্রা সেখানে রাষ্ট্র আর ধর্মকে আলাদা করার সুযোগ আছে?

শাহরিয়ার কবির : আমাদের লড়াইটা ঠিক এখানেই। আমরা দেখতে পাচ্ছি আওয়ামী লীগ ক্রমশই হেফাজতের দিকে ঝুঁকছে। জামায়াতিরা ক্রমশই আওয়ামী লীগে অনুপ্রবেশ করছে। আমরা এ বিষয় নিয়ে লড়াই থেকে সরে আসিনি। যুদ্ধাপরাধের বিচারের জন্য আমাদের ৪০ বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে। ’৭২-এর সংবিধানে ফেরার জন্য লড়াইটা চালিয়ে যেতে হচ্ছে। এ লড়াইটা এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্ম পর্যন্ত চলবে।

আমরা মনে করি, শিক্ষানীতি, নারীনীতি, সংস্কৃতিনীতি, কূটনীতি— সবকিছু যদি সংবিধান অনুযায়ী চলে তাহলে আমরা যেখানে পৌঁছাতে চাই, সেখানে পৌঁছাতে পারব।

জাগো নিউজ : আপনি আশাবাদী?

শাহরিয়ার কবির : আমি আশাবাদী। তবে মাথাপিছু আয় বাড়িয়ে শুধু লক্ষ্যে পৌঁছানো যাবে না। মানবিক সূচকে উন্নয়ন না বাড়িয়ে সৌদি আরবের মতো উন্নত রাষ্ট্রও হতে পারি। কিন্তু সৌদি আরব তো আমার কাছে আদর্শ রাষ্ট্র নয়।

jagonews24

জাগো নিউজ : এই প্রশ্নে গণতন্ত্র, নির্বাচন, ভোটাধিকারের মতো বিষয়গুলোও গুরুত্ব পায়…

শাহরিয়ার কবির : হ্যাঁ। ১৯৪৭ সালের পর বা পাকিস্তান আমলের পর আমরা আসলে কতটুকু গণতন্ত্রের চর্চা করার সুযোগ পেয়েছি? সামরিক শাসকরা বারবার ক্ষমতায় এসে গণতন্ত্রকে হত্যার চেষ্টা করেছে। অবৈধভাবে তারা ক্ষমতায় টিকে থেকেছে।

জাগো নিউজ : বর্তমান সরকারের টিকে থাকা নিয়ে কী বলবেন?

শাহরিয়ার কবির : এজন্য বিরোধী দলের দুর্বলতা-ই দায়ী বলে মনে করি।

গণতন্ত্রের জবাবদিহিতার জন্য একটি শক্তিশালী বিরোধী দল থাকা তো দরকার। সংসদ এবং সংসদের বাইরে কোনো শক্তিশালী বিরোধী দল নেই। বিএনপি এত-ই দেউলিয়া যে জামায়াতকে কিছুতেই ছাড়বে না। বিএনপি নিজস্ব সংকট থেকে বেরিয়ে আসতে পারছে না, এটিই তাদের ধ্বংসের কারণ।

জাগো নিউজ : বিএনপির লাভ-লোকসান মানে জামায়াতের লাভ-লোকসান। বিএনপির কাছে আপনার এমন প্রত্যাশা থাকবে কেন?

শাহরিয়ার কবির : না-না। বিএনপির কাছে আমি প্রত্যশা করছি না। আমি বলতে চাইছি, বামপন্থীরা আসলে কী করছে? বামরা কি একটি বিকল্প তৈরি করতে পারল? ভারতে কিন্তু বামরা এখনও বিকল্প শক্তি।

জাগো নিউজ : বিকল্প শক্তি তৈরির যে পথ, তা সরকার রুদ্ধ করে দিল কি-না?

শাহরিয়ার কবির : না। আমি তা মনে করি না। আপনি কোনো আন্দোলন দেখছেন? আন্দোলন তো থাকতে হবে। আন্দোলন ডেকে ঘরে বসে থাকলে তো হবে না। বিএনপির আন্দোলন প্রেস বিজ্ঞপ্তির আন্দোলন।

জাগো নিউজ : এ অবস্থায় বাংলাদেশের রাজনীতি কোথায় যাচ্ছে?

শাহরিয়ার কবির : দেশে একটি শক্তিশালী বিরোধী দল থাকা সময়ের দাবি। শক্তিশালী বিরোধী দল না থাকলে নাগরিক সমাজকে আরও শক্তিশালী হতে হয়।

জাগো নিউজ : নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরাও তো দলীয় লেজুড়বৃত্তিতে অভ্যস্ত…

শাহরিয়ার কবির : আমি তা মনে করি না। আওয়ামী লীগে জামায়াতীকরণ বা হেফাজতীকরণে আমাদের নির্মূল কমিটি অন্তত এক বিন্দুও ছাড় দেইনি।

নাগরিক সমাজের লড়াই তো আসলে রাস্তার লড়াই না। আমাদের লড়াই হচ্ছে জনগণের মধ্যে চেতনার জাগ্রত করা।

জাগো নিউজ : এ চেতনা জাগানোর প্রশ্নে আপনারা বিএনপি-জামায়াতের সময় যতটুকু প্রতিবাদী হোন, আওয়ামী লীগের সময় তা হন না বলে অভিযোগ রয়েছে। আর এ নীতিই বুমেরাং হচ্ছে চেতনার প্রশ্নে এবং চ্যালেঞ্জও বাড়িয়ে দিচ্ছে…

শাহরিয়ার কবির : আওয়ামী লীগের আমলে অন্তত আমাকে জেলে যেতে হচ্ছে না। আমাদের কর্মীদের অন্তত হত্যা করা হচ্ছে না।

jagonews24

জাগো নিউজ : তাহলে তো বলা যায়, সুবিধা নিচ্ছেন…

শাহরিয়ার কবির : আমি তা মনে করি না। আমার পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেলে আমাকে প্রতিক্রিয়া জানাতেই হবে।

বিএনপির নেতাদের সঙ্গেও আমরা আমাদের নীতি নিয়ে আলোচনা করেছি। গণআদালত গঠনের পরের দিন আমি বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে কথা বলেছি। আমার বইয়ে বিস্তারিত আছে। আমি খালেদা জিয়াকে বলেছি, ‘ম্যাডাম আপনি জামায়াতকে ছেড়ে দিয়ে নিষিদ্ধ করে দেন। নিষিদ্ধ করলেও জামায়াত কোনোদিন আওয়ামী লীগকে ভোট দেবে না। তারা বিএনপিকেই ভোট দেবে। আপনি জামায়াত কেন নিষিদ্ধ করছেন না?’

আমরা চাই, দেশে ডানপন্থা, বামপন্থা, মধ্যপন্থার পরিবেশ থাকবে। কিন্তু ডানপন্থী দল হিসেবে বিএনপি তার ভূমিকা রাখতে পারেনি। বিএনপিকে কেন যুদ্ধাপরাধের বিচারের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হবে। ১৯৯১ সালের পার্লামেন্টে কী অসাধারণ বিতর্ক হয়েছে। রাজশাহীতে ছাত্রমৈত্রীর রিমুকে হত্যা করা হলো। রিমুর মা ছিলেন সাতক্ষীরা জেলার বিএনপিনেত্রী। ১৯৯৩ সালের ঘটনা। সেদিন সংসদে বিএনপি আওয়ামী লীগ একসঙ্গে বলে উঠল, বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামির কোনো রাজনীতি থাকতে পারে না। বিএনপি সরকারের কাছে বিরোধী দল আওয়ামী লীগ জামায়াতকে নিষিদ্ধের দাবি জানাল।

জাগো নিউজ : আওয়ামী লীগ দীর্ঘ সময় ক্ষমতায়। তারা তো জামায়াতকে নিষিদ্ধ করতে পারত…

শাহরিয়ার কবির : এটি আওয়ামী লীগের আপসকামিতা।

জাগো নিউজ : আপনারা মাঠে নেই। এ সরকার আপনাদের জেলে না ভোরে সুরক্ষা দিচ্ছে। আবার হেফাজতে ইসলামের নেতারা গণভবনে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠক করছেন। সরকারের এ দ্বৈতনীতি আপনাদের জন্য চ্যালেঞ্জ বাড়িয়ে দিচ্ছে কি-না?

শাহরিয়ার কবির : অভিযোগ করবেন তথ্যের ভিত্তিতে। নির্মূল কমিটি সম্ভবত একমাত্র নাগরিক সংগঠন যাদের সবচেয়ে বেশি তথ্য সংরক্ষিত আছে। আপনি চাইলে সেখানে আমাদের কর্মকাণ্ড দেখতে পারেন।

আমাদের কর্মকাণ্ড হচ্ছে জনসচেতনতামূলক। বিএনপি যখন ক্ষমতায় ছিল তখন আমরা পাঠাগার তৈরি করেছি। আমাদের ৮০টি পাঠাগার বিএনপি-জামায়াতের লোকরা পুড়িয়ে দিয়েছে। আমাদের কর্মীদের হত্যা করা হয়েছে। এর প্রতিবাদ করতে তো রাস্তায় নামতেই হবে।

আমরা আওয়ামী লীগের সময়ও প্রতিবাদ করছি। অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন বহুবার লিখেছেন যে, ‘নির্মূল কমিটিকে আওয়ামী লীগ সরকার এখন উৎপাত মনে করেন। তারা ফেলতেও পারছেন না, আবার সহ্যও করতে পারছেন না।’

jagonews24

আমরা রাস্তায় নেমে তো লড়াই করতে পারব না। বিএনপির সময়ও আমরা সহিংস প্রতিবাদ করিনি। পুলিশ বাধা দিয়েছে, চলে গেছি। নাগরিক আন্দোলনের দায়িত্ব হচ্ছে জনসচেতনতা তৈরি করা। নিমূল কমিটি যে পরিমাণ কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেছে গত ২৯ বছরে, তা অন্য কোনো সংগঠন করতে পারেনি।

জাগো নিউজ : যুদ্ধাপরাধের বিচারের দাবিতে আপনারা যে ভূমিকা পালন করেছেন, রাষ্ট্রের অন্যান্য অসঙ্গতির ক্ষেত্রে নীরব থেকেছেন বলেও অভিযোগ আছে...

শাহরিয়ার কবির : নির্মূল কমিটি কয়েকটি নির্দিষ্ট এজেন্ডা নিয়ে কাজ করছে। নাগরিক জীবনের বহু সমস্যা আছে। সাংগঠনিক সীমাবদ্ধতার জন্য সবগুলো অ্যাড্রেস করা সম্ভব হয় না। সাংগঠনিক সামর্থ্য ও শক্তি দিয়ে যতটুকু সম্ভব তা-ই তো করতে হবে।

জাগো নিউজ : একজন ‘শাহরিয়ার কবির’-এর পরিচয় নির্মূল কমিটির বাইরেও। সাধারণ মানুষ শাহরিয়ার কবিরের কাছে রাষ্ট্রের অসঙ্গতি নিয়ে প্রতিবাদের প্রত্যাশা করতে পারে কি-না?

শাহরিয়ার কবির : শাহরিয়ার কবির-কে যদি আলাদাভাবে দেখতে চান, তাহলে তার বই পড়ুন। প্রতি বছরই বই বের হচ্ছে। সেখানে সবই জানতে পারবেন।

জাগো নিউজ : সাধারণ মানুষের অধিকারের কথা বলছি...

শাহরিয়ার কবির : আমার তো এত সময় নাই। নির্মূল কমিটি আমার হিংসভাগ সময় নিয়ে গেছে। আমি সৃজনশীল লেখা, কাজগুলো করতে পারছি না।

জাগো নিউজ : অন্য সুশীলদের প্রসঙ্গে কী বলবেন?

শাহরিয়ার কবির : সবই রাজনীতির সঙ্গে সম্পর্কিত। দেশে যদি গণতান্ত্রিক পরিবেশ থাকে, আন্দোলন থাকে, তাহলে অনেকেরই ভূমিকা রাখার ক্ষেত্র তৈরি হয়। দেশের কোথাও কি এখন আন্দোলন হচ্ছে?

জাগো নিউজ : অধিকার আদায়ের প্রশ্নে সুশীলরাই আন্দোলন উস্কে দেয়...

শাহরিয়ার কবির : আন্দোলনের নেতৃত্ব দেয়া নাগরিক সমাজের দায়িত্ব নয়। স্বাধীনতাযুদ্ধের আগে নেতৃত্ব দিয়েছেন, ভিন্ন প্রেক্ষাপটে। আজ তো ছাত্ররাও আন্দোলনে নেই। বামরাও কি সেই নৈতিকতার শক্ত জায়গায় আছেন? সবাই তো আদর্শ থেকে সরে এসেছেন। আন্দোলনের নেতৃত্বটা আসতে হবে রাজনৈতিক দলের কাছ থেকে।

সুশীলরা নেতৃত্ব দিলে বুঝতে হবে ভিন্ন উদ্দেশ্য আছে। আমি গণতান্ত্রিক বাম বিকল্পের কথা বলছি। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, বামরা ব্যর্থ হয়েছে। আন্দোলন করবেন অথচ মার খাবেন না, তা হবে না।

আমরা আমাদের সাধ্য অনুযায়ী চেষ্টা করে যাচ্ছি।

জাগো নিউজ : সামনে কি অপেক্ষা করছে, আলো না-কি অন্ধকার?

শাহরিয়ার কবির : আমি আশাবাদী মানুষ। আলো আসবেই। হয়তো ক্ষণিকের জন্য থমকে যেতে হয়। হয়তো পেছনেও যেতে হয়। তাই বলে হতাশার কিছু নেই। সামনে এগিয়ে যাওয়াই মুক্তি।

এএসএস/এমএআর/এমএস