ভিডিও EN
  1. Home/
  2. বিশেষ প্রতিবেদন

বাহে অ্যাডেতো সময় মতো অফিস খোলে না

প্রকাশিত: ০৩:২৯ এএম, ০৩ নভেম্বর ২০১৫

মাত্র দুই টাকা খরচ করে আমি আমার সন্তানদের ওষুধ নিতে পারছি বাড়ির কাছ থেকে। এই ক্লিনিকের সেবা না থাকলে আমাদের সামান্য সর্দি-কাশি, ঘা-পাচড়া আর চুলকানির ওষুধ শহর থেকে আনতে কয়েকশ টাকা খরচ হয়ে যেত। শুলকুর বাজার কমিউনিটি ক্লিনিকের সামনে কথাগুলো বললেন কুড়িগ্রাম জেলার সদর উপজেলার পাঁচগাছী ইউনিয়নের পানাতি পাড়া গ্রামের মেয়ে স্বপ্না বেগম।        

হিমহিম ঠাণ্ডা বাতাসে ফুটফুটে একটি শিশুকে কোলে নিয়ে রৌদ্র স্নানে দাঁড়িয়ে স্বপ্না বেগম। স্বপ্নার মতো আরও অনেক মা এসেছেন এই কমিউনিটি ক্লিনিকে নিজের ও বাচ্চাদের ওষুধ নেবার জন্য। আবার অনেক গর্ভবতী মা তাদের শরীর চেকআপ করা জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছেন।

বর্তমান সরকারের ভিশন জনগণের দোঁড়গোড়ায় স্বাস্থ্য সেবা পৌঁছে দেয়ার লক্ষ্যেই কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপন করা হয়। সরকারের সেই উদ্দেশ্য কুড়িগ্রামের কয়েকটি কমিউনিটি ক্লিনিকে সফলতার মুখ দেখলেও অধিকাংশ কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোতে আশার গুড়ে বালি হয়েছে। দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম নদী মাতৃক জেলা কুড়িগ্রামকে ১৬টি নদ-নদী ঘিরে রেখেছে। ১শ ৪৭ দশমিক ২০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের নদী পথে সাড়ে চার শতাধিক চর-দ্বীপ চরে প্রায় আট লক্ষাধিক মানুষের বসবাস।     

কাগজ-কলমে সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত কমিউনিটি ক্লিনিক খোলা থাকার কথা থাকলেও বাস্তব চিত্র এর উল্টো। উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের তদারকি না থাকায় প্রত্যন্ত এলাকায় কমিউনিটি ক্লিনিকের কার্যক্রম চলে মাত্র ২ থেকে আড়াই ঘণ্টা। অর্থাৎ সকাল ১০টা থেকে দেড়টা পর্যন্ত।

Comunuty-clinic

একই ইউনিয়নের মিয়াজী পাড়ার সিতাই ঝাড় কমিউনিটি ক্লিনিক সম্পর্কে  স্থানীয় তোপা বেগম (৪৫), আশরাফ আলী (৫০), সাজিনা বেগম (২৫) অভিযোগ করে জাগো নিউজকে বলেন, বাহে এডে তো সময় মতো অফিস খোলেনা আর যদিও খোলে তাহালে জোহরের আজানের সাতত বন্ধ করি চলি যায়। মাঝে মাঝে ওষুদ নিবার গেলে কোনো ট্যাকা পয়সা নাগে না।

স্থানীয়রা আরো বলেন, এই ক্লিনিকে কত প্রকার ওষুধ পাওয়া যায় তার কোনো তালিকা দেয়া নেই। আমরা জানিওনা। তবে শুধুমাত্র ছয় থেকে সাত প্রকার ওষুধ দেন তারা। একই এলাকার গৃহবধূ সাহিনা জাগো নিউজকে জানান, বন্যার পরে আমার শ্বাশুড়ির হাতে পায়ে ঘা হয়েছে। ক্লিনিকে গেলেও তারা কোনো ওষুধ দেয়নি। আমার বাচ্চার শরীরেও ওমন ঘা হওয়ায় ওখান থেকে ওষুধ নিয়ে সন্তান ও শ্বাশুড়িকে ব্যবহার করতে দেই। সরকারি ওষুধ ক্লিনিকের লোকজন রেখেও তারা তা  দেন না।

সরেজমিনে দেখা যায়, শুধুমাত্র কমিউনিটি ক্লিনিক হেলথ প্রোভাইডার ক্লিনিকে সেবা প্রদান করছেন। নাম প্রকাশ না করা শর্তে অনেকেই অভিযোগ করে বলেন, প্রতিটি কমিউনিটি ক্লিনিকে সপ্তাহের ছয়দিন একজন কমিউনিটি ক্লিনিক হেলথ প্রোভাইডার (সিএইচসিপি), তিনদিন করে একজন হেলথ অ্যাসিসটেন্ট (এইচ এ), একজন ফ্যামিলি ওয়েল ফেয়ার অ্যাসিসটেন্ট (এফডব্লিউএ) বসার নিয়ম রয়েছে। কিন্তু এইচএ এবং এফডব্লিউএ তাদেরকে পাওয়া যায় না। তারা কোনো প্রকার সহযোগিতা করেন না। ফলে তাদের কাজগুলো আমাদের করতে হয়।

একজন সিএইচসিপির দৈনন্দিন সকাল ৯টা হতে বিকেল ৩টা পর্যন্ত রোগীদের সেবা প্রদানের পাশাপাশি রেজিস্ট্রেশন করা, প্রায় ২০টি ঘর সংবলিত রিপোর্ট পাঠানো, কইয়া রিপোর্ট, মাসিক রিপোর্ট, গর্ভবতী মায়েদের চেকআপ, কাউন্সিলিং করা, ওষুধ উত্তোলনসহ প্রায় ১০ থেকে ১২ প্রকার কাজ সম্পন্ন করতে হয়।

সিএইচসিপিও সদস্যরা জানান, আর এইচএ এর নামে কোনো প্রকার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স কর্মকর্তাদের কাছে অভিযোগ করলে আমাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেন তারা। প্রতিদিন ৬০ থেকে ৭০ জন রোগী ক্লিনিকে চিকিৎসা নিতে আসেন। আমরা আমাদের সাধ্যমতো রোগীদেরকে ছোট-খাটো সব রোগের প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে থাকি। আমাদের ক্লিনিক থেকে রোগীদের ৩০ ধরনের ওষুধ দেয়া হয়। তবে বিশেষজ্ঞ কোনো চিকিৎসক না থাকায় রোগীদেরকে জটিল কোনো রোগের চিকিৎসা বা ওষুধ দেয়া সম্ভব হয় না।

Comunuty-clinic

আর প্রতি তিন মাস পরপর ক্লিনিক বন্ধ করে ওষুধ উত্তোলনের জন্য উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স যেতে হয়। ওষুধ নিজ খরচে আনার পর তিন থেকে ছয় মাস পরে ওষুধ পরিবহনের জন্য ছয়শ টাকা বিল পাওয়া গেলেও তার থেকে শতকরা ২৫ টাকা ভ্যাট কেটে নেয়। প্রায় সময় নিজেদের পকেটের টাকা খরচ করতে হয়।

সিএইচসিপিও সদস্যরা আরও বলেন, ক্লিনিকগুলোতে বিদ্যুৎ সংযোগ নেই। প্রত্যন্ত এলাকাগুলোতে মডেমের নেটওয়ার্ক না থাকায় তাদের রিপোর্ট পাঠাতে নানা ভোগান্তিতে পড়তে হয়। অনেক ক্লিনিকের সিএইচসিপির সদস্যরা ওষুধ চুরির অপবাদ থেকে পরিত্রাণ পেতে রোগীকে ওষুধের খোসা নিয়ে আসতে বলেন। তারা আরো জানান, চাহিদার তুলনায় ওষুধ সরবরাহ না থাকায় রোগীরা আমাদের সঙ্গে অনেক সময় দুর্ব্যবহার করেন।

কিছু কিছু ক্লিনিকে ডেলিভারি করা হলেও বিকেল ৩টার পরে সেই সুযোগ আর থাকে না। এছাড়াও টেরেডেস হোমস ফাউন্ডেশনের তত্ত্বাবধায়নে কিছু ক্লিনিকে সংস্কার কাজের  নামে অর্থ হরিলুট করা হয়েছে। অনেক ক্লিনিকে গিয়ে দেখা যায় জানালা ভাঙা, দরজা বন্ধ করা যায় না এমন নানা সমস্যায় তাদের কাজ করতে হচ্ছে।

শুলকুর বাজার কমিউনিটি ক্লিনিকের বিদ্যুতের সংযোগ লাইন এবং এক হর্সের মোটর জমিদাতা নিজেই তার বাড়িতে নিয়ে গেছেন। এসব বিষয়ে অভিযোগ করে নানান হয়রানির শিকার হতে হয়েছে  অনেক সিএইচসিপির সদস্য।

তারা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আমাদের এমন হাড়ভাঙা খাটুনির ফলে এই হত অবহেলিত দরিদ্র মানুষের স্বাস্থ্য সেবা দেয়া সম্ভব হচ্ছে। অথচ আমাদের এই পরিশ্রমের কারণে অনেক ডাক্তার বিদেশ সফর করতে পেরেছেন। আর এতকিছু করার পরও আমাদেরকেই বলির পাঠা বানানো হচ্ছে সব জায়গায়।   

Comunuty-clinic  

কুড়িগ্রাম সিভিল সার্জনের কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, কুড়িগ্রাম জেলার ২২৫৫ দশমিক ২৯ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের ২১ লাখ ৭৭ হাজার ৯শ ৩৫ জন জনসংখ্যা। নয়টি উপজেলার মধ্যে পৌরসভা ৩টি, ইউনিয়ন ৭৩টি রয়েছে। চর আছে ৫০টি। প্রস্তাবিত কমিউনিটি ক্লিনিক রয়েছে ২৯৬টি এবং এরমধ্যে চালু রয়েছে ২৬৬টি। কর্মরত সিএইচসিপির সদস্য ২৮০ জন এবং জেলার এইচএ ৩১৯ জনের মধ্যে ২৮০ জন কমিউনিটি হেলথ ক্লিনিকে কাজ করেন। বিদ্যুৎ সংযোগ রয়েছে আনুমানিক ৩টি সিসি কেন্দ্রে।

ফুলবাড়ির ৩টি, উলিপুর ও নাগেশ্বরীতে ২টি এবং সদরের একটি কমিউনিটি ক্লিনিক সেন্টারে নরমাল ডেলিভারি করানো হয়। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ১৫৬টি নরমাল ডেলিভারি করা হয়েছে।

টেরেডেস হোমস ফাউন্ডেশনের তত্ত্বাবধায়নে জেলার ১০১টি কমিউনিটি ক্লিনিকে গড়ে ৩লাখ টাকা ব্যয়ে বারান্দা নির্মাণসহ সংস্কার কাজে অব্যাহত রয়েছে। যা চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত চলবে।

স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর সূত্র জানায়, ৯ উপজেলার ৯টি বিদ্যমান কমিউনিটি ক্লিনিকে নরমাল ডেলিভারি করানোর জন্য প্রায় ৭০ লাখ টাকা ব্যয়ে বার্থিং রুম নির্মাণসহ মেরামতের কাজ চলতি বছরের সেপ্টেম্বর মাসে শুরু হয়েছে। ৯০দিনের মধ্যে কাজ শেষ করতে হবে। এছাড়াও বিগত ২০০৮ সাল থেকে ৩ ধাপে জেলার ২ শতাধিকের মতো কমিউনিটি ক্লিনিকে ৭৫ হতে এক লাখ টাকা ব্যয়ে সংস্কার কাজ সম্পন্ন করা হয়।

জেলার সিভিল সার্জন ডা. জয়নাল আবেদীন জিল­ুর জাগো নিউজকে জানান, কমিউনিটি ক্লিনিক নির্মাণের ফলে এই হতদরিদ্র জেলার স্বাস্থ্যসেবা অধিকাংশই নিশ্চিত করা সম্ভব হয়েছে। এই সেবা পাওয়ায় মানুষের ভোগান্তি কম হচ্ছে। যার ফলে আমি এবং ডা. এসএম আমিনুল ইসলাম, ডা. অজয় কুমার রায়, ডা. জিআরএম মোকসেদুর রহমানসহ চারজন বিদেশ সফর করেছি। স্বাস্থ্য সেবায় এমন সফলতার জন্য সরকারের তরফ থেকে আমাদেরকে আরো উন্নত স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের লক্ষ্যে বিভিন্ন মেয়াদে আমরা বিদেশ সফর করেছি।

কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোতে এইচএদের অনুপস্থিতি এবং কর্মকর্তাদের ভিজিট নিয়মতি হয় কী না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, আপনি প্রমাণ এনে দিন আমি তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।

এমজেড/এমএস

আরও পড়ুন