ভাই হত্যার পূর্ণাঙ্গ বিচার দেখে যেতে চান সৈয়দ ওয়াহিদুল ইসলাম
সৈয়দ ওয়হিদুল ইসলাম। শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলামের একমাত্র ছোট ভাই। কিশোরগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন অনেক দিন। বয়সের ভারে অনেকটা নুয়ে পড়েছেন। একা হাঁটাচলা করতে পারেন না। কথায় দৃঢ়তা থাকলেও ছলছল করছিল চোখ।
যে মানুষটি বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে স্বাধীনতাখেয়ার কাণ্ডারির ভূমিকা পালন করেছেন-জাতিকে উপহার দিয়েছেন একটি নতুন লাল-সবুজের পতাকা, সেই প্রিয় ভাই সৈয়দ নজরুল ইসলামকে কারারুদ্ধ অবস্থায় নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। ভাইকে হত্যার পর তার নিজের জীবনে নেমে অসে নানা হুমকি। জেল-জুলুম সহ্য করে প্রাণে বেঁচে যান সৈয়দ ওয়াহিদুল ইসলাম। কিন্তু জীবন সায়াহ্ণে এসেও বড় ভাইসহ চার জাতীয় নেতাকে হত্যা মামলার পূর্ণাঙ্গ বিচার দেখতে পারেননি তিনি। জীবনের শেষবেলায় তার চাওয়া, জেলহত্যার পূর্ণাঙ্গ বিচার দেখে যাওয়া আর বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠা।
১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর রাতে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে অন্য তিন জাতীয় নেতার সঙ্গে নির্মমভাবে হত্যা করা কিশোরগঞ্জের কৃতি সন্তান বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম। দেশকে মেধাশূন্য করা আর অবৈধভাবে ক্ষমতা কুক্ষিগত করতেই জেলখানায় নৃশংসভাবে হত্যা করা হয় জাতির শ্রেষ্ঠ এ সূর্যসন্তানকে। সেদিন বুলেটের আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত দেহ দেখে কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন সৈয়দ নজরুল ইসলামের পাশের বাড়ির মো. সাহাব উদ্দিন। তিনি বলেন, সেদিন জেলখানা থেকে মরদেহ বের করার পর তার বুক ছিল গুলিকে ঝাঁঝরা। ডান পা চামড়ার সঙ্গে ঝুলে ছিল।
কিশোরগঞ্জ জেলা সদরের যশোদল ইউনিয়নের ছায়া সু-নীবিড় নিভৃত পল্লী বীরদামপাড়া। এ গ্রামেই জন্ম গ্রহণ করেছিলেন জাতীয় বীর সৈয়দ নজরুল ইসলাম। বাল্যকাল কেটেছে যশোদলেই।
যশোদল মিডল ইংলিশ স্কুলে পড়াশোনা শুরু। এরপর কিশোরগঞ্জ আজিমুদ্দিন হাই স্কুল ও ময়মনসিংহ জিলা স্কুলে পড়াশুনা করেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম। ময়মনসিংহ জিলা স্কুল থেকে ১৯৪১ সালে তিনি প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক ও ১৯৪৩ সালে মংমনসিংহের আনন্দমোহন কলেজ থেকে প্রথম বিভাগে আইএ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হলে থাকার সময় রাজনীতির সঙ্গে পরিচয় হয় তার। পরবর্তীতে রাজনীতি সৈয়দ নজরুলের ধ্যান-জ্ঞানে পরিণত হয়।
কিশোরগঞ্জের মাটি-মানুষের প্রতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের ছিল গভীর মমতা। সুযোগ পেলেই ছুটে আসতেন গ্রামের বাড়িতে। বঙ্গবন্ধুর প্রত্যাবর্তনের পর সৈয়দ নজরুল ইসলামকে শিল্প মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেয়া হয়। দায়িত্ব পাওয়ার পর তার নিজ এলাকা যশোদলে গড়ে তুলেছিলেন কিশোরগঞ্জ সুগার মিল, টেক্সটাইল মিলসসহ বিভিন্ন শিল্প কারখানা। আর এসব কল-কারখানায় এলাকার হাজার হাজার মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু তার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই নিভে যায় সকল সম্ভাবনার আলো। একে একে বন্ধ হয়ে পড়ে শিল্প-কারখানাগুলো।
এলাকাবাসীর হৃদয় মনিকোঠায় স্থান করে নিয়েছেন, মাটি ও মানুষের নেতা শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম। প্রতিবছর ৩ নভেম্বর এলেই কান্নায় বুক ভাসে নিহতের স্বজন ও এলাকাবাসীর। তাদের মতে সৈয়দ নজরুলের আদর্শের রাজনীতি নির্বাসিত হওয়ায় দেশ আজ চরম সংকটে।
বর্তমানে শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলামের বড় ছেলে সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন। সৈয়দ নজরুল ইসলামের নামে কিশোরগঞ্জে একটি সরকারি মেডিকেল কলেজ নির্মানাধীন। তার নামে জেলা সদরে একটি স্টেডিয়াম নির্মাণ করা হয়েছে। শহরের প্রবেশ পথে বিন্নাটি মোড়ে স্থাপিত স্মৃতিস্তম্ভে শোভা পাচ্ছে জাতীয় চার নেতার ছবি।
কিশোরগঞ্জবাসীর হৃদয় মনিকোঠায় জায়গা করে নিয়েছেন শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম। তার আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে দেশ গড়ার কাজে উদ্যোমী হবে সবাই এমন আশাবাদ সকলের। সেইসঙ্গে জেলহত্যায় জড়িতদের পূর্ণাঙ্গ বিচার হবে। কলঙ্কমুক্ত হবে জাতি- এমন আশায় দিন কাটছে সৈয়দ নজরুল ইসলামের পরিবারসহ কিশোরগঞ্জবাসীর।
নূর মোহাম্মদ/বিএ