জাল এনআইডিতে ব্যাংক ঋণ : জড়িত ব্যাংক কর্মকর্তা-ইসি অপারেটর

ব্যাংক ঋণ পেতে লাগে বাংলাদেশ ব্যাংকের ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরোর (সিআইবি) প্রতিবেদন। প্রতিবেদন নেগেটিভ হলে মেলে না ব্যাংক লোন। তবে সংঘবদ্ধ প্রতারক চক্র ঋণখেলাপি হয়েও অভিনব উপায়ে ব্যাংক লোন পাইয়ে দিতে সহায়তা করছেন জাল জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) তৈরির মাধ্যমে।
ব্যাংক লোন পেতে চক্রটি নতুন বা মিথ্যা তথ্য দিয়ে প্রথমে তৈরি করছে জাল জাতীয় পরিচয়পত্র। যার তথ্য থাকে না সিআইবিতে। তবে নির্বাচন কমিশনের কেন্দ্রীয় সার্ভারে সফট কপি হিসেবে এন্ট্রি করা থাকে। অভিনব এমন জালিয়াতির মাধ্যমে ব্যাংক থেকে সহজেই লোন তোলা যাচ্ছে, যা পরবর্তীতে পরিশোধ না করে প্রতারণার আশ্রয় নেয়া হচ্ছে।
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
ঋণ নিতে আগ্রহীদের জাল জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরিতে চক্রটি নিচ্ছে লাখ টাকা পর্যন্ত। জাল এনআইডি তৈরি এবং সেই জাল এনআইডিতে লোন পাস করতে সহায়তা করছে এনআইডি’র ডাটা এন্ট্রি অপারেটর এবং ব্যাংকের সাবেক ও বর্তমান কিছু অসাদু কর্মকর্তা।
এভাবে অর্ধশত জাল এনআইডি ব্যবহারের মাধ্যমে সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স, প্রাইম, সিটি, ব্র্যাক ও ইউসিবি ব্যাংকের মতো প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ বাবদ উত্তোলন করা হয়েছে ১০ লাখ থেকে তিন কোটি টাকা পর্যন্ত। এসব জাল এনআইডিধারী অধিকাংশের পেশা ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার কিংবা প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। লোন পাসের পর চুক্তি অনুযায়ী কমিশন বাবদ জালিয়াত চক্রকে তারা দিচ্ছেন লাখপ্রতি ১০ হাজার টাকা।
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
রাজধানীর মিরপুরে দ্বৈত, জাল ও ডুপ্লিকেট জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরি করে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে লোন উত্তোলনে সহায়তাকারী এমন প্রতারক চক্রের পাঁচ সদস্যকে গ্রেফতার করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)।
গ্রেফতার চক্রের অন্যতম প্রধান সুমন পারভেজ (৪০) ও মো. মজিদ (৪২) ২০১৬ সাল থেকে এমন প্রতারণায় জড়িত। নির্বাচন কমিশনের সবুজবাগ এলাকার ডাটা এন্ট্রি অপারেটর সিদ্ধার্থ শংকর সূত্রধর (৩২), গুলশান এলাকার ডাটা এন্ট্রি অপারেটর আনোয়ারুল ইসলাম (২৬) ২০১৬ সাল থেকে যুক্ত হলেও প্রতারণা শুরু করেন গত বছর থেকে। একাধিক ব্যাংকে চাকরি করা সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তা আব্দুল্লাহ আল মামুন (৪১) এ জালিয়াতিতে জড়িত দীর্ঘদিন ধরে।
বিজ্ঞাপন
গতকাল শনিবার (১২ সেপ্টেম্বর) রাত ৮টায় মিরপুরের চিড়িয়াখানা রোডের ডি-ব্লক এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেফতার করে গোয়েন্দা (লালবাগ) বিভাগের সংঘবদ্ধ অপরাধ ও গাড়ি চুরি প্রতিরোধ টিম। গ্রেফতারের সময় তাদের হেফাজত থেকে দ্বৈত, জাল ও ডুপ্লিকেট ১২টি জাতীয় পরিচয়পত্র উদ্ধার করা হয়।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের লালবাগ বিভাগের সংঘবদ্ধ অপরাধ ও গাড়ি চুরি প্রতিরোধ টিমের সহকারী কমিশনার মধুসূদন দাস জাগো নিউজকে বলেন, ‘তিন উপায়ে জাল এনআইডির মাধ্যমে ব্যাংক থেকে ঋণ উত্তোলনের কাজ করে চক্রটি। প্রথমে তারা ঋণ পেতে আগ্রহীদের সঙ্গে তাদের চাকরি ও ব্যবসা সংক্রান্ত পরিচিতি এবং সমাজের প্রতিষ্ঠিত ক্লাইন্টদের সঙ্গে যোগাযোগ করে চুক্তি করে। এক্ষেত্রে সহযোগিতা করে ব্যাংকেরই কিছু সেলস এক্সিকিউটিভ। এরপর মিথ্যা তথ্য দিয়ে জাল এনআইডি তৈরি করে। পরে ব্যাংকেরই অসাদু কর্মকর্তাদের সহায়তায় ঋণ পাস করিয়ে নেয়। সিআইবি রিপোর্ট যাদের খারাপ, তাদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেন ব্যাংকেরই কিছু সেলস এক্সিকিউটিভ।’
বিজ্ঞাপন
মধুসূদন দাস বলেন, ‘ব্যাংকের লোন নিয়ে কেউ ঋণখেলাপি হলে তাদের সিআইবি রিপোর্ট খারাপ থাকে। তারা পুনরায় ব্যাংকে লোনের জন্য আবেদন করতে পারেন না। তখন গ্রেফতার চক্রের অন্যতম সদস্য সুমন ও মজিদ লোন পাস করিয়ে দেবে মর্মে প্রথমে জাল জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরির জন্য প্রত্যেকের কাছ থেকে ৮০ হাজার থেকে এক লাখ টাকা গ্রহণ করেন। পরবর্তী সময়ে লোন পাস হলে মোট লোনের ১০ শতাংশ হারে দিতে হবে মর্মে চুক্তি করেন। চুক্তিতে একমত হলে তারা প্রথমে জাল জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরি করেন। পরে লোন পাস হলে চুক্তি অনুযায়ী লোনের সম্পূর্ণ টাকার ১০ শতাংশ হারে গ্রহণ করেন।’
‘জাল পরিচয়পত্র তৈরি করে দিতেন তাদের অপর দুই সহযোগী সিদ্ধার্থ শংকর সূত্রধর ও আনোয়ারুল ইসলাম। তারা প্রত্যেকটি জাল জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরি বাবদ ৩৫ হাজার থেকে ৪০ হাজার টাকা পর্যন্ত গ্রহণ করতেন।’
সহকারী কমিশনার মধুসূদন দাস জানান, ই-জোন কোম্পানির মাধ্যমে আউট সোর্সিংয়ের মাধ্যেমে নিয়োগ পান সিদ্ধার্থ শংকর সূত্রধর ও আনোয়ারুল ইসলাম। নির্বাচন কমিশনের অধীনে খিলগাঁও-সবুজবাগে সিদ্ধার্থ শংকর সূত্রধর এবং গুলশান অফিসে আনোয়ারুল ইসলাম ডাটা এন্ট্রি অপারেটর হিসেবে কাজ করার কারণে তারা নির্বাচন কমিশন অফিসের সফটওয়্যার ব্যবহার করে সহজেই জাল জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরি করতেন।
বিজ্ঞাপন
জাল এনআইডি তৈরির প্রক্রিয়া সম্পর্কে গোয়েন্দা পুলিশ জানায়, ডাট্রা এন্ট্রি অপারেটরদের কাছে ইসির সার্ভারের একসেস দেয়া থাকে। এই সুযোগ নিয়ে প্রথমে ঋণ পেতে আগ্রহীদের আগের এনআইডি, বিদ্যুৎ বিল ও জন্মনিবন্ধনের কপির তথ্য দিয়ে সার্ভারে প্রবেশ করেন তারা। তারপর ছবি ও ফিঙ্গারপ্রিন্ট নিতেন। এরপর নতুন একটি নামে ওই ভুয়া এনআইডি এন্ট্রি করতেন। পরদিন সার্ভারে আপলোড দিতেন তারা।
জাল এনআইডি’র তথ্য শনাক্তে কোনো সুযোগ রয়েছে কি-না, জানতে চাইলে মধুসূদন দাস বলেন, ‘ফিঙ্গারপ্রিন্ট আইডেন্টিফিকেশন সিস্টেম (এএফআইএস) নামক একটি সফটওয়্যার রয়েছে। এটা মূলত অটোমেটেড সিভিলিয়ান আইডেন্টিফিকেশনের জন্য ব্যবহৃত হয়। কিন্তু এই প্রক্রিয়ায় জাল এনআইডি শনাক্তে সময় লাগে ১০ থেকে ১৫ দিন। জাল হিসেবে শনাক্ত হওয়ার পর তা হ্যাং অবস্থায় থাকে। পরে আরও কিছুদিন পর অফিশিয়াল প্রক্রিয়ায় জাল এনআইডি’র তথ্য মুছে ফেলা হয় সার্ভার থেকে। এই ফাঁকে এন্ট্রি করা জাল এনআইডিতে উত্তোলন করা হয় ব্যাংক ঋণ।
অভিযানকালে সুমন পারভেজের কাছ থেকে কবির হোসেন, জাকির হোসেন ও সুমন পারভেজ নামে তিনজনের জাল এনআইডি পাওয়া যায়। মজিদের কাছ থেকে রোজিনা রহমান, মহিউদ্দিন চৌধুরী; সিদ্ধার্থ শংকর সূত্রধরের কাছ থেকে মো. মিস্টার, সাদিয়া জামান, নাছিমা বেগম; আনোয়ারুল ইসলামের কাছ থেকে আনোয়ারুল ইসলাম, মো. আব্দুল মান্নান, মো. রাকিবুল ইসলাম ও আব্দুল লতিফ নামে চারজনের এনআইডি পাওয়া যায়।
বিজ্ঞাপন
সুমন পারভেজ, মো. মজিদ ও সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তা আব্দুল্লাহ আল মামুন এর আগে দ্বৈত, জাল ও ডুপ্লিকেট এনআইডি তৈরি করে গুলশানের ব্র্যাক ব্যাংক শাখা থেকে নয় লাখ ২৫ হাজার টাকা, নিকেতনের সিটি ব্যাংক শাখা থেকে নয় লাখ ৫০ হাজার টাকা লোন উত্তোলন করেন। সুমন পারভেজ, মো. মজিদ টাকার ১০ শতাংশ হারে নিয়ে বাকি টাকা নিয়ে নেন আব্দুল্লাহ আল মামুন, যা পরবর্তীতে পরিশোধ না করে প্রতারণা করেন তিনি।
আব্দুল্লাহ আল মামুন তার স্ত্রী রোজিনা রহমানের নামে লোন গ্রহণের উদ্দেশ্যে সুমন পারভেজ, মজিদ, ডাটা এন্ট্রি অপারেটর সিদ্দার্থ শংকর সূত্রধর ও আনোয়ারুল ইসলামের মাধ্যমে একটি জাল এনআইডি তৈরি করেন। তবে ঋণ নেওয়ার আগেই ধরা পড়েন তিনি।
চক্রের অন্যতম হোতা সুমন পারভেজ, মো. মজিদ জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেছেন যে, মো. মিল্টন নামে পলাতক এক ব্যক্তি জাল এনআইডি তৈরি করে নর্থ সাউথ রোডের সাউথ বাংলা ব্যাংক হতে তিন কোটি টাকা, ইয়াছির নামে অজ্ঞাত এক ব্যক্তি প্রগতি স্মরণি সিটি ব্যাংক শাখা থেকে অফিসার আরিফের মাধ্যমে ১০ লাখ টাকা, সালেহ আহম্মেদ নামে একজন গুলশান ইউসিবি ব্যাংক শাখা থেকে ১৫ লাখ টাকা এবং মো. আব্দুল মজিদ নামে আরেকজন জাল এনআইডিতে এনআরবি ব্যাংকের গুলশান শাখা থেকে ২০ লাখ টাকা লোন নেন। সব মিলে এখন পর্যন্ত অর্ধশত জাল এনআইডিতে ব্যাংক ঋণ উত্তোলনের তথ্য পেয়েছে ডিবি পুলিশ।
বিজ্ঞাপন
ডিবি জানায়, জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন আইন, ২০১০-এ গ্রেফতারদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। ওই মামলায় তাদের গ্রেফতার দেখিয়ে আদালতে সোপর্দ করে বিশদ জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রিমান্ড আবেদন করা হলে আদালতে দুদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। পাশাপাশি জড়িত পলাতক এবং জালিয়াতির মাধ্যমে ঋণ নেয়া ব্যক্তিদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে।
জেইউ/এমএআর/পিআর
বিজ্ঞাপন