পাইপলাইন নির্মাণ : বিনিয়োগের ৮২৫ কোটিই ঝুঁকিতে!
>> ধনুয়া-এলেঙ্গা-নলকা গ্যাস সঞ্চালন পাইপলাইন স্থাপন প্রকল্প
>> বনের ভেতরের ১৫ কি.মি. অংশে লাইন স্থাপনে প্রতিবন্ধকতা
>> বনভূমি ব্যবহারের অনুমতি পেলেও নতুন জটিলতা ‘গাছ কাটা’
তিতাস গ্যাস অধিভুক্ত এলাকা (ঢাকা ও ময়মনসিংহ বিভাগ), পশ্চিমাঞ্চল গ্যাস অধিভুক্ত এলাকা (রাজশাহী ও রংপুর বিভাগ) এবং সুন্দরবন অধিভুক্ত এলাকায় (খুলনা বিভাগ) গ্যাস সরবরাহ বৃদ্ধির লক্ষ্যে ‘ধনুয়া-এলেঙ্গা ও বঙ্গবন্ধু সেতুর পশ্চিম পাড়-নলকা গ্যাস সঞ্চালন পাইপলাইন (বিডি-পি ৭৮ : ন্যাচারাল গ্যাস ইফিসিয়েন্সি প্রজেক্ট)’ শিরোনামে একটি প্রকল্প হাতে নেয় সরকার। জাতীয় গ্যাস গ্রিডের সার্বিক সক্ষমতা বাড়ানোর লক্ষ্যে ২০১৪ সালের জুলাই থেকে ৯৭৯ কোটি ১৭ লাখ ৬০ হাজার টাকা ব্যয়ে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়/জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের উদ্যোগে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে গ্যাস ট্রান্সমিশন কোম্পানি লিমিটেড (জিটিসিএল)।
২০১৯ সালের জুনে প্রকল্পটি শেষ হওয়ার কথা থাকলেও ব্যর্থ হয়েছে তারা। প্রথম সংশোধন এনে ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত সময় বাড়ানো হয়। খরচ কমিয়ে ধরা হয় ৮২৫ কোটি ৫১ লাখ ৩৮ হাজার টাকা। এর মধ্যে সরকার ৩৯৭ কোটি ১ লাখ ৬ হাজার, জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা) ৪২৪ কোটি ১১ লাখ ৮ হাজার এবং জিটিসিএলের নিজস্ব অর্থায়ন ৭৩ কোটি ৯ লাখ ২৪ হাজার টাকা। চলতি বছরের জুন পেরিয়ে সেপ্টেম্বরেও প্রকল্পটি শেষ করতে পারেনি সংশ্লিষ্টরা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ইতোমধ্যে প্রকল্পটির শতভাগ মালামাল কেনা ও আমদানি হয়েছে। এইচডিডি পদ্ধতিতে ছয়টি নদী ক্রসিংও শতভাগ সম্পন্ন হয়েছে। ধনুয়া ও সিরাজগঞ্জে দুটি রেগুলেটিং অ্যান্ড মিটারিং স্টেশন (আরএমএস) এবং এলেঙ্গায় একটি মিটারিং অ্যান্ড ম্যানিফোল্ড স্টেশন (এমএমএস) নির্মিত হবে। স্টেশনগুলোর ডিজাইন ও ড্রইং চূড়ান্ত হয়েছে। এর ৬০ শতাংশ কাজও সম্পন্ন। মোট ৬৭ দশমিক ২ কিলোমিটার পাইপলাইনের ৭৫ শতাংশের নির্মাণকাজ সম্পন্ন হয়েছে। ভূমি অধিগ্রহণ হয়েছে ৯০ শতাংশ এবং ভূমি রিকুইজিশন হয়েছে ৯০ শতাংশ।
এই পরিপ্রেক্ষিতে গত জুনে দেয়া পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) এক নিবিড় পরিবীক্ষণ প্রতিবেদন বলছে, প্রকল্পে বিনিয়োগের ৮২৫ কোটি ৫১ লাখ টাকার সম্পূর্ণ অর্থই ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। প্রতিবেদনটির এমন মতের সঙ্গে সহমত প্রকাশ করেছেন প্রকল্পটির পরিচালক প্রকৌশলী মোহাম্মদ সামছুর রহমানও।
আইএমইডির প্রতিবেদনে ‘সম্পূর্ণ বিনিয়োগ ঝুঁকি’ সৃষ্টিসহ মোট ছয়টি ঝুঁকির কথা বলা হয়েছে। তিন পর্বের প্রতিবেদনের প্রথমটিতে দুটি ঝুঁকির বিষয়ে আলোকপাত করা হলো।
ঝুঁকি দুটির একটি হলো- বনের ভেতরের ১৫ কিলোমিটার অংশে লাইন স্থাপন। বিভিন্ন জটিলতায় এটি আটকে যাওয়ায় প্রকল্পটির সম্পূর্ণ বিনিয়োগে ঝুঁকির সৃষ্টি হয়েছে। দ্বিতীয়টি হলো- নির্মিত পাইপলাইনের Corrosion/Erosion (ক্ষয়) রোধে ‘ক্যাথডিক প্রটেকশনের’ আওতায় আনার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ না করা হলে অবকাঠামোগুলোর কার্যক্ষমতা কমে যাবে।
প্রতিবেদন বলছে, “পরিকল্পনা অনুযায়ী ধনুয়া থেকে এলেঙ্গা পর্যন্ত ৫২ কিলোমিটার এবং বঙ্গবন্ধু সেতুর পশ্চিম পাড় থেকে নকলা পর্যন্ত ১৫ দশমিক ২০ কিলোমিটার— মোট ৬৭ দশমিক ২০ কিলোমিটার ৩০ ইঞ্চি ব্যাসের গ্যাস সঞ্চালন পাইপলাইন নির্মাণের লক্ষ্যে কাজ করছে জিটিসিএল।
প্রকল্পের আওতায় এখন পর্যন্ত ধনুয়া-এলেঙ্গা সেকশনে প্রায় ৩৭ কিলোমিটার পাইপলাইন এবং বঙ্গবন্ধু সেতুর পশ্চিম পাড়-নকলা সেকশনে ১৫ দশমিক ২০ কিলোমিটার— মোট প্রায় ৫২ কিলোমিটার পাইপলাইন নির্মাণ সম্পন্ন হয়েছে।
বঙ্গবন্ধু সেতুর পশ্চিম পাড়-নকলা ১৫ দশমিক ২০ কিলোমিটার পাইপলাইন কমিশনিং গত বছরের ১১ ডিসেম্বর সম্পন্ন হয়েছে। প্রকল্পের ধনুয়া-এলেঙ্গা সেকশনে বন বিভাগের ভূমি ব্যবহারের অনুমোদন না পাওয়ায় বনভূমিসহ আনুমানিক ১৫ কিলোমিটার পথসত্ত্ব বরাবর পাইপলাইন নির্মাণের কাজ শুরু করা সম্ভব হয়নি। এই ১৫ কিলোমিটার পাইপলাইন নির্মাণ সম্ভব না হওয়ায় মূলত ‘সম্পূর্ণ বিনিয়োগ ঝুঁকিতে’ পড়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।”
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ‘বনের আওতাধীন ভূমিতে ১৫ কিলোমিটার পাইপলাইন স্থাপন সম্পন্ন করা না গেলে বিকল্প কোনো রুট না থাকায় প্রকৃতপক্ষে প্রকল্পটির কোনো কার্যকারিতা থাকবে না।’
সম্পূর্ণ বিনিয়োগে ঝুঁকি সৃষ্টির বিষয়ে গত ৩১ আগস্ট প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী মোহাম্মদ সামছুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, ‘এটা সত্য। প্রতিবেদনে সেটা তুলে ধরা হয়েছে। ২০১৬ সালে আমরা বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়কে লিখেছিলাম যে, আমরা এদিকে পাইপলাইন বসাব। অনুমোদিত ডিপিপি আছে, তাতে আমাদের অবকাঠামো ও লাইনের রাইটও এদিকে দেখানো আছে। কিন্তু নানা জটিলতায় সেই অনুমোদন পেতে আমাদের অনেক দেরি হয়েছে। ২০১৮ সালে এ প্রকল্প শেষ হওয়ার কথা ছিল। যেহেতু আমি বনের অনুমতি পাইনি বহুবার, এটা নিয়ে বন ও অধিদফতরের মধ্যে চিঠি চালাচালি হয়েছে। তারা ছোট ছোট ইনকোয়ারি (জিজ্ঞাসা) দিয়েছেন একাধিকবার। এগুলো কমপ্লাই (মেনে চলা) করতে করতে চলতি বছরের জুলাইয়ে ওই বনভূমি ব্যবহারের অনুমতি পেলাম।’
‘এখন নতুন জটিলতা হচ্ছে গাছ কাটা নিয়ে’ উল্লেখ করে প্রকল্প পরিচালক বলেন, ‘তারা (বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়) বলছে, আবার প্রস্তাব দেন গাছ কাটার অনুমোদনের জন্য। মন্ত্রিপরিষদে আবার প্রস্তাব দিতে হবে। ওটা নিয়েই আজ (৩১ আগস্ট) আমাদের মিটিং হয়েছে। আমরা বলেছি যে, আমাদের মূল প্রস্তাবেই তো আছে বনভূমি ব্যবহার ও গাছ কর্তন। যেহেতু প্রধানমন্ত্রী অনুমোদন দিয়েছেন, সুতরাং গাছ কাটার ব্যাপারে গড়িমসি না করে আমাদের দয়া করে অনুমোদন দেন। না হলে দেরি হয়ে যাবে। ২০১৮ সালে যেটা শেষ হওয়ার কথা, সেখানে ২০২০ সালেরও শেষ প্রান্তে চলে এসেছি, কিন্তু এখনও আমি এই এক্সেসটা পাইনি।’
নির্মিত পাইপলাইনের Corrosion/Erosion (ক্ষয়) রোধে ক্যাথডিক প্রটেকশনের আওতায় আনার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ না করা হলে অবকাঠামোগুলোর কার্যক্ষমতা কমে যাবে। প্রতিবেদনে এমন তথ্যের বিষয়ে জানতে চাইলে প্রকৌশলী মোহাম্মদ সামছুর রহমান বলেন, ‘আমাদের বনের মধ্যে যে ১৫ কিলোমিটার অংশ আছে, তার দুই পাশে ধরেন গাজীপুরের ধনুয়া থেকে ময়মনসিংহ হয়ে এই অংশটা করেছি। আবার টাঙ্গাইলের বন ছাড়াও ১২ থেকে ১৪ কিলোমিটার করেছি। দুই পাশে প্রায় ৩৭ কিলোমিটার কাজ শেষ করেছি। এই যে ৩৭ কিলোমিটার পাইপ আমি আজ থেকে প্রায় দুই বছর আগে মাটির নিচে রেখে দিয়েছি, এখন এই লাইনটাকে কমপ্লিট (শেষ) যদি না করি, এই মাথা থেকে ওই মাথা যদি পুরোপুরি সংযুক্ত না হয়, তাহলে এটার করোশন (ক্ষয়) প্রটেক্টিভ যে লেজার, সেই লেজারটা ডেভেলপ হবে না। খুব টেম্পোরারি একটা প্রটেকশন থাকে। এদিক দিয়ে যদি আরও দু-এক বছর এভাবে থাকে, তাহলে লঞ্জিবিটি (আয়ুষ্কাল) কমে যাবে। কারণ, পাইপলাইন বসানোর পরে এটাকে সুস্থ রাখার জন্য… ক্যাথডিক প্রটেকশন বলি, সেই প্রটেকশনটাকে আমাদের ডেভেলপ করতে হয়। যেটা আমরা এই জায়গাটাতে করতে পারছি না আর কি! বনের অংশটা যদি শেষ করতে পারি, তাহলে অটোমেটিক্যালি (স্বয়ংক্রিয়ভাবে) আমাদের প্রটেকশন মেজারটা (সুরক্ষা ব্যবস্থা) ডেভেলপ (তৈরি) হয়ে যাবে।’
পিডি/এমএআর/জেআইএম