ভিডিও EN
  1. Home/
  2. বিশেষ প্রতিবেদন

তার বিদায়ে কাঁদছে বাংলাদেশও

সায়েম সাবু | প্রকাশিত: ০৯:০০ পিএম, ০১ সেপ্টেম্বর ২০২০

পরবাসী বন্ধু। অথচ আপনের চেয়েও আপন। সীমানা, কাঁটাতার রুদ্ধ করে দিতে পারেনি তার ভালোবাসার দরজা। দেশ ভাগের বিষাদে জর্জরিত থেকেও বাংলাদেশ, বাঙালির মুক্তির ময়দানে ছিলেন এক অতন্দ্র প্রহরী।

প্রণব মুখার্জি। যার বিদায় বেলায় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধুকে হারালাম’।

বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক সতীর্থ ড. কামাল হোসেন। বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভায় পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। স্মৃতিচারণ করে ড. কামাল বলেন, ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ভারতের যে মানুষটিকে সবচেয়ে বেশি খুশি হতে দেখেছি, তিনিই প্রণব মুখার্জি। এমনকি ইন্দিরা গান্ধীকেও বাংলাদেশের পক্ষে সরাসরি অবস্থান নেয়ার জন্য বোঝানোর মতো সক্ষমতা ছিল তার। বহুবার সাক্ষাৎ হয়েছে। বহু স্মৃতি তার সঙ্গে। কখনও বিদেশি মনে হয়নি। সত্যিই তার চলে যাওয়া আমাদের জন্য বড় বেদনার।’

১৯৭১ সাল। পাকিস্তান ভাঙার ঘণ্টা বেজেছে। বাঙালি মুক্তির সংগ্রামে সশস্ত্র সংঘাতে লিপ্ত। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগারে রাজবন্দি। প্রবাসে গঠিত হয়েছে স্বাধীন বাংলার অস্থায়ী সরকার। প্রণব মুখার্জি তখনও যোগ দেননি ইন্দিরা গান্ধীর দল কংগ্রেসে। বাংলা কংগ্রেসের পশ্চিমবাংলা রাজ্যসভার প্রতিনিধি তিনি।

বাংলাদেশের সঙ্গে বন্ধুত্ব তার তখন থেকেই। যদিও বৈবাহিক সূত্রে বাংলাদেশের সঙ্গে আত্মীয়তা আরও আগে থেকে। কিন্তু রাজনৈতিক সম্পর্কটা ঠিক ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকেই।

pronob-mukherjee-04.jpg

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে প্রণব মুখার্জি

প্রণব মুখার্জির আত্মজীবনীমূলক সিরিজের প্রথমটি দ্য ড্রামাটিক ডিকেড : দ্য ইন্দিরা গান্ধী ইয়ারস-এ তিনি একটি পুরো অধ্যায় লিখেছেন ‘মুক্তিযুদ্ধ : দ্য মেকিং অব বাংলাদেশ’ শিরোনামে।

বইয়ে প্রণব মুখার্জি লিখেছেন, ‘১৫ জুন বাজেট অধিবেশন চলাকালে আমি রাজ্যসভায় বাংলাদেশ সমস্যা নিয়ে আলোচনার উদ্যোগ নেই। আমি বলেছিলাম, ভারতের উচিত বাংলাদেশের প্রবাসী মুজিবনগর সরকারকে অবিলম্বে স্বীকৃতি দেয়া। একজন সদস্য জানতে চান, কীভাবে এই সমস্যার সমাধান হতে পারে। উত্তরে আমি জানাই, গণতান্ত্রিক ও সার্বভৌম বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ার মাধ্যমেই এর রাজনৈতিক সমাধান সম্ভব। রাজনৈতিক সমাধান মানে গণতান্ত্রিক ও সার্বভৌম বাংলাদেশকে বস্তুগত সহায়তা করা। আমি সংসদকে এটাও স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলাম যে, বিশ্ব ইতিহাসে এ ধরনের ঘটনায় হস্তক্ষেপের বহু নজির আছে।’

মূলত প্রণব মুখার্জিই ভারতের রাজ্যসভায় প্রথম, যিনি প্রবাসী বাংলাদেশি সরকারকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয়ার প্রস্তাব রাখেন। এর মধ্য দিয়েই ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে তার রাজনৈতিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে।

প্রণব মুখার্জি তার আত্মজৈবনিক গ্রন্থে লিখেছেন, ‘সে সময় থেকেই ইন্দিরা গান্ধী আমাকে গুরুত্ব দিতে শুরু করেন। ১৯৭১-এর সেপ্টেম্বরে আমাকে প্রথম আন্তঃসংসদীয় ইউনিয়নের বৈঠকে ভারতীয় প্রতিনিধি দলের সদস্য মনোনীত করা হয়। ওই বৈঠকে আমাদের কাজ ছিল প্রতিটি দেশের প্রতিনিধিদের কাছে বাংলাদেশের পরিস্থিতি এবং ভারতের অবস্থান বিস্তারিত ব্যাখ্যা করা, যাতে তারা যে যার দেশে ফিরে গিয়ে নিজেদের সরকারকে বিষয়টি অবহিত করতে পারেন। হতে পারে ওই বৈঠকে আমার ভূমিকার কথা প্রধানমন্ত্রীর কানে পৌঁছেছিল এবং তিনি খুশি হয়েছিলেন। কেননা, এরপর একই দায়িত্ব দিয়ে তিনি আমাকে ইংল্যান্ড ও জার্মানি পাঠান।’

pronob-mukherjee-04.jpg

ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে প্রণব মুখার্জি

খালিদ মাহমুদ চৌধুরী। সরকারের নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘পারিবারিক ও বৈবাহিক সূত্রে প্রণব মুখার্জির সঙ্গে আমাদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক। কিন্তু রাজনৈতিক সম্পর্কটা আরও বড়। মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে বাংলাদেশের রাজনীতি ও উন্নয়নে তার অসামান্য ভূমিকা রয়েছে। বিশেষ করে বঙ্গবন্ধু পরিবারের প্রতি তার যে দরদ, তার প্রমাণ আমরা বহুবার পেয়েছি। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যার পর শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানাকে যেভাবে আশ্রয় দিয়ে সহায়তা করেছেন, আমরা সারাজীবন কৃতজ্ঞচিত্তে তা মনে রাখব।’

তিনি বলেন, ‘সহমর্মিতার যে রাজনীতি তার উজ্জ্বল নক্ষত্র প্রণব মুখার্জি। অনেক বিভাজনের মধ্যেও আমাদের আস্থার জায়গা ছিলেন তিনি। তাকে হারিয়ে যে ক্ষতি হলো তা কোনোভাবেই পূরণ হওয়ার নয়। প্রতি মুহূর্তে তার অভাব বোধ করব। প্রণব মুখার্জির তুলনা শুধু প্রণব মুখার্জিই।’

pronob-mukherjee-04.jpg

ড. কামাল হোসেন, আমির হোসেন আমু, খালিদ মাহমুদ চৌধুরী

রাজনৈতিক প্রজ্ঞা আর দায়িত্বশীলতার প্রশ্নে প্রণব মুখার্জি বাংলাদেশের প্রতিটি সংকটময় মুহূর্তে উদারতার পরিচয় দিয়েছেন। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে যেমন ভূমিকা রেখেছেন, তেমনি ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানাকে আশ্রয় দিয়ে বন্ধুত্ব ও ভালোবাসার চরম নিদর্শন রেখেছিলেন। একইভাবে বাংলাদেশের দুর্যোগকালেও তার অবদান অনিস্বীকার্য। ২০০৭ সালে বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে সিডরের সময় ভারত সরকার যে সহায়তা দিয়েছিল, তার পেছনে প্রণব মুখার্জিই মূল ভূমিকা পালন করেছিলেন।

আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য আমির হোসেন আমু। বর্ষিয়ান এই রাজনীতিক তার মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করে বলেন, ‘আমরা বাংলাদেশের বিশ্বস্ত এক বন্ধুকে হারালাম। প্রণব মুখার্জি বঙ্গবন্ধু পরিবারের অকৃত্রিম বন্ধু ছিলেন। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর তার দুই কন্যাকে আগলে রেখেছিলেন প্রণব মুখার্জি।’

আমু বলেন, ‘ভারত আমাদের বন্ধুপ্রতীম দেশ। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক রক্তের। এই সম্পর্ক নির্ধারণ করতে যে কজন মানুষ সর্বাগ্রে ভূমিকা রেখেছিলেন, তাদের মধ্যে প্রণব মুখার্জি প্রধানতম। আমরা বাঙালি হিসেবে তার ঋণ কখনই ভুলতে পারব না। তিনি ছিলেন বাংলাদেশের মানুষের অকৃত্রিম বন্ধু।’

এএসএস/এমএআর/এমএস