ঢাকা-আশুলিয়া এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণকাজে ঢিমেতাল
ঢাকা-আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ প্রকল্প হাতে নেয়া হয় ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে। ২০২২ সালের জুলাইয়ে প্রকল্পটির কাজ শেষ হওয়ার কথা। কিন্তু প্রকল্পের মেয়াদের অর্ধেকের বেশি সময় অর্থাৎ তিন বছর পার হতে চললেও এখন পর্যন্ত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পটির নির্মাণকাজ শুরু করা সম্ভব হয়নি।
কাজ শুরু না করার প্রধান কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে, প্রকল্পটির মোট ব্যয় ১৬ হাজার ৯০১ কোটি টাকার মধ্যে ১০ হাজার ৯৫০ কোটি টাকা অর্থাৎ ১ দশমিক ২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ দেয়ার কথা চীনের এক্সিম ব্যাংকের। বাকি টাকা দেবে বাংলাদেশ সরকার। বাংলাদেশ প্রস্তুত থাকা সত্ত্বেও চীন সরকারের অনুমতি না পাওয়ায় ঋণচুক্তি করছে না ব্যাংকটি। ঋণচুক্তি না হওয়ায় প্রকল্পের কাজও শুরু করা সম্ভব হচ্ছে না। অর্থাৎ চীন সরকারের ধীরগতির কারণেই আটকে আছে এ ঋণচুক্তি। তিন বছর হতে চললেও শুরু হয়নি এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণকাজ।
এ বিষয়ে ঢাকা-আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক (পিডি) শাহাবুদ্দিন খান জাগো নিউজকে বলেন, ‘এই দেরির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের কোনো দায় নেই। কারণ, আমরা তো প্রস্তুত হয়েই আছি। তারাই দেরি করছে। কারণ আমরা ঋণচুক্তির জন্য আবেদন করেছি দুই বছর আগে, ঘোরানো হচ্ছে। ছোট দেশ হলেও কোনো দেশের সাথে আমাদের কিস্তির ডিফল্ট নেই। যেমন পাকিস্তান দিতে পারে না। আমাদের দেশ এদিক থেকে ভালো অবস্থানে। ফলে ওরা আমাদের ওপর খুব আস্থা রাখে।’
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঋণচুক্তি দ্রুত সই হলেও আগামী জানুয়ারির আগে প্রকল্পের মূল নির্মাণকাজ শুরু করা সম্ভব নয়। ঋণচুক্তি সইয়ে দেরি হলে নির্মাণকাজ আরম্ভ করা জানুয়ারিতেও সম্ভব হবে না। ফলে প্রকল্পের মেয়াদকাল ২০২২ সাল পর্যন্ত ধরা হলেও ২০২৪ সালের আগে এর কাজ শেষ হওয়ার সম্ভাবনা নেই।
চীন সরকার অনুমোদন দিলে এক্সিম ব্যাংক বাংলাদেশের অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) সঙ্গে ঋণচুক্তি সই করবে। ইআরডির এশিয়া, জাইকা ও এফঅ্যান্ডএফ উইংয়ের প্রধান যুগ্ম-সচিব মো. শাহরিয়ার কাদের এ বিষয়ে জাগো নিউজকে বলেন, ‘দেখুন, প্রত্যেকটা কাজের একটা প্রক্রিয়া আছে। চীন কর্তৃপক্ষ এখন প্রকল্পটার মূল্যায়ন করছে। তাদের মূল্যায়ন শেষ হলে আমাদের জানাবে। আমরা এখনও চূড়ান্ত কিছু জানতে পারিনি। তবে এই অর্থবছরের মধ্যে আমরা ঋণটা পাওয়ার চেষ্টা করব। কারণ এটা অনেক দূর এগিয়েছে। এটা মূল্যায়নের প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে আছে, আমাদের যা মনে হয়।’
ঋণচুক্তি সইয়ের ক্ষেত্রে দেরি হওয়ার কারণ জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক শাহাবুদ্দিন খান বলেন, ‘দুই বছর হলো আমি এ প্রকল্পের দায়িত্ব নিয়েছি। আমি এসে দেখলাম, চীনের এক্সিম ব্যাংকের সঙ্গে ঋণচুক্তি হয়নি। কিন্তু ঠিকাদারের সাথে ২০১৭ সালের নভেম্বরে চুক্তি হয়েছে। প্রকল্পের ১০ হাজার কোটি টাকা সিভিল ওয়ার্ক (এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ), আর সাত হাজার কোটি টাকা ওইদিকে ক্ষতিপূরণ, এটা-সেটায় খরচ হবে। তখন বলা হয়েছিল, ২ শতাংশ সুদ নেবে তারা (এক্সিম ব্যাংক)। তাদের সিস্টেমটাই ছিল ২ শতাংশ। আমরাও ধরে নিয়েছিলাম ২ শতাংশ সুদ হবে। কিন্তু তারা এটাকে ৩ শতাংশ করলো। তারপর দরকষাকষি করে তারা (চীনের এক্সিম ব্যাংক) বলল যে, আমাদের পলিসি পরিবর্তন হয়েছে। আমরা ৩ শতাংশ হারে সুদ নেব। ৩ শতাংশ সুদে তো অনেক টাকা চলে আসে। তখন এটা নিয়ে দরকষাকষি অনেক হয়েছে। এরপর গত বছরের জুলাইয়ে আমাদের প্রধানমন্ত্রী যখন চীনে গেলেন, তখন আবার দুই প্রধানমন্ত্রীর (বাংলাদেশ ও চীনের প্রধানমন্ত্রী) মধ্যে আলোচনা হলো যে, চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের ২০১৬ সালের বাংলাদেশ সফরের সময় যে প্রকল্পগুলো হাতে নেয়া হয়েছিল, সে প্রকল্পগুলোতে সুদের হার বাড়ানো হবে না। তারপর আমরা আশ্বস্ত হলাম। তখন তারা ২ শতাংশ হারে এ প্রকল্পে ঋণ দিতে সম্মত হয়। এটা নিয়ে কিছুটা সময়ক্ষেপণ হয়েছে। তারপর এ তথ্য, ওই তথ্য— এসব করতে করতে চলে এলো করোনাভাইরাস।’
শাহাবুদ্দিন খান আরও বলেন, ‘চীনে গত নভেম্বরে এলো করোনা। আমাদের এখানে দু-তিন মাস পরে এসেছে। সেই সময় আমাদের সঙ্গে ঋণচুক্তি করতে এক্সিম ব্যাংক সুপারিশ করে তাদের সরকারের কাছে দিল। তার মানে, তাদের মিনিস্ট্রি অব কমার্সের কাছে থাকল। তারপর আমরা এখান থেকে যোগাযোগ করছিলাম ইআরডির মাধ্যমে। বেশকিছু দিন বলল, আমাদের দেশের এইটা-সেইটা। এখনও ওইভাবেই আছে। এপ্রিলে আমরা আবার যোগাযোগ করলাম। জানলাম, এটা মিনিস্ট্রি অব কমার্স থেকে তাদের মিনিস্ট্রি অব ফাইন্যান্সে গেছে। আমাদের যেমন মন্ত্রিপরিষদ, ওদের তেমন স্টেট কাউন্সিল অনুমোদন দেয়। স্টেট কাউন্সিলে অনুমোদন দিলে অনুমোদন হয়ে গেল। হয়ে গেলে আমাদের ইআরডির সাথে তাদের একটা চুক্তি হবে। এখন মিনিস্ট্রি অব ফাইন্যান্সেই আছে। তাদের দেশের কী কন্ডিশন বা আমাদের দেশের কী কন্ডিশন, এ ধরনের কোনো গবেষণা করছে কি-না…। তবে আশাবাদী আমরা, দু-এক মাসের মধ্যে ঋণচুক্তিটা স্টেট কাউন্সিল পাস করে দেবে।’
এ অবস্থায় জানুয়ারির আগে কাজ শুরু করতে পারবেন, এমন আশা এই মুহূর্তে করতে পারছেন না বলে জানান শাহাবুদ্দিন খান। তার দাবি, এই দেরির কারণে বাংলাদেশের আর্থিক ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা নেই।
এক্সিম ব্যাংকের শর্ত অনুযায়ী, চীনের ঠিকাদার দিয়েই এই এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণকাজ করাতে হবে। ফলে ঠিকাদারদের এখানে কাজ পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। চীনের একটি মূল ঠিকাদার থাকবে। তারা আবার তিনটি উপ-ঠিকাদার (সাব-কন্ট্রাক্টর) দিয়ে এই কাজ করিয়ে নেবে।
এ বিষয়ে শাহাবুদ্দিন খান বলেন, ‘এখন যথাসময়ে প্রকল্প শেষ করা যাবে না। নিয়ম অনুযায়ী ওরা সব-কন্ট্রাক্টর নেয়। এ প্রকল্পে বড় বড় সাব-কন্ট্রাক্টর নিয়েছে ওরা। পদ্মা সেতু করছে তারা, আব্দুল্লাহপুরের ব্রিজ করছে তারা এবং আড়িয়াল খাঁ ব্রিজও করছে। সেখানে সাব-কন্ট্রাক্টর হিসেবে তাদের তিনটা বড় কোম্পানি নিয়েছে। এতে তিনজন ঠিকাদার আমাদের। সে হিসেবে আমরা ঠিকাদারের সাথে আলোচনা করেছি যে, পাঁচ বছরের কাজ ছিল, সেটা আমরা সাড়ে তিন বছরের মধ্যে শেষ করার চেষ্টা করব। তবে তাদের সাথে চুক্তি পাঁচ বছর। সেটাই তাদের অনুরোধ জানিয়েছি। তারা বলেছে, হয়তো আমরা সাড়ে তিন বছরে পারব না। তবে আশা করি, চার বছরের মধ্যে শেষ করে দেব। ফলে ২০২৪ সালের মধ্যে শেষ করতে পারব বলে আশা করি।’
প্রকল্পটিতে এক্সিম ব্যাংকের অর্থায়ন থেকে সরে যাওয়ার শঙ্কা আছে কি-না, জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক বলেন, ‘তারা অর্থায়ন করবে নিশ্চিত। কারণ দুই প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা হলো। তাছাড়া ওরা কিন্তু বলে নাই যে, এটা করব না। এ প্রকল্প ওরা বাতিল করবে, এমন কোনো লক্ষণ নেই।’
অন্যদিকে, বাংলাদেশ সরকার এই প্রকল্পে ইতোমধ্যে ১২০০ কোটি টাকা খরচ করে ফেলেছে জানিয়ে শাহাবুদ্দিন খান বলেন, ‘এর মধ্যে আমাদের যে বড় কাজ ভূমি অধিগ্রহণ, সেটা প্রায় গুছিয়ে এনেছি। ভূমি অধিগ্রহণ প্রায় ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ শেষ হয়েছে। ১৮০০ কোটি টাকার মধ্যে ১২০০ কোটি টাকা ইতোমধ্যে গাজীপুর ও ঢাকা জেলা প্রশাসনকে আমরা পরিশোধ করেছি। ৬০০ কোটি টাকা হয়তো দ্রুতই পরিশোধ করব। ভূমি অধিগ্রহণই আমাদের মূল কাজ। ভূমিটা ওদের বুঝিয়ে দিলে ওরা সিভিল ওয়ার্ক করবে। আমাদের তো আর কাজ নেই। সবই করবে ওরা।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা একটা কনসালট্যান্ট প্রতিষ্ঠান নিয়োগ করে রেখেছি। কিন্তু ওদের মোবিলাইজ (কাজ শুরু করানো) করিনি। কারণ মোবিলাইজ করলেই তো বেতন দিতে হবে। ঋণচুক্তি হলে আমরা মোবিলাইজ করব। আমরা আরেকটা এনজিও নিয়োগ করছি, তাদেরও মোবিলাইজ করিনি। করলেই তো একটা টিম লিডারের বেতনই দিতে হয় অনেক। ওই কনসালট্যান্টের একজন টিম লিডারের বেতনই ৩০ থেকে ৪০ লাখ টাকা মাসে। এজন্যই মোবিলাইজ করি না। দিলে তো অনেক টাকা বিল এসে বসে থাকবে, কিন্তু কোনো কাজ নেই।’
প্রকল্প পরিচালক বলেন, ভূমি অধিগ্রহণ ১০০ ভাগ করতে না পারলেও কাজ শুরুর পর যে পেমেন্ট দেব ঠিকাদারকে, সেই ঠিকাদারের পেমেন্টটা ওরা ডিজবার্স (ছাড়) করবে না। এক্সিম ব্যাংক বলবে, ভূমি অধিগ্রহণ হয়েছে কি-না। কিছু শর্ত আছে, পূর্ব শর্ত। আশা করি, চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যেই শেষ করব ভূমি অধিগ্রহণ। পুরো ভূমিটাই ভূমি মন্ত্রণালয়ে পাস হয়েছে।
পিডি/এইচএ/এমএআর/এমএস