দুবাইয়ে জিম্মি তরুণীদের উদ্ধারে নেয়া হবে ইন্টারপোলের সহায়তা
গত আট বছরে ২০/২২ বছর বয়সী হাজারের বেশি তরুণী-কিশোরীকে পাচার করেছে সংঘবদ্ধ আন্তর্জাতিক নারী পাচারকারী একটি চক্র। যাদের দুবাইয়ে বিলাসবহুল হোটেলে মোটা অঙ্কের বেতনের চাকরি দেয়ার কথা বলে প্রলুব্ধ করা হয়েছিল। তাদের অনেককেই জিম্মি করে জোরপূর্বক পতিতাবৃত্তিতে জড়ানো হয়। দুবাইয়ে বাংলাদেশি এসব তরুণী-কিশোরীকে মুক্ত করতে এবং পাচারকারীদের ধরতে ইন্টারপোলের সহায়তা নেবার কথা জানিয়েছে পুলিশ।
পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) বলছে, আন্তর্জাতিক নারী পাচারকারী চক্রটি শুধু বাংলাদেশ নয়, পাশের দেশ ভারত, পাকিস্তান থেকেও মেয়েদের দুবাইয়ে পাচার করে পতিতাবৃত্তিতে জড়ায়। এ ব্যাপারে সিআইডি’র অর্গানাইজড ক্রাইমের ডিআইজি ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, ‘আমরা পুলিশ সদর দফতরের ন্যাশনাল সেন্ট্রাল ব্যুরোর (এনসিবি) মাধ্যমে ইন্টারপোলের সহায়তা চাইব। সেজন্য আমরা ডকুমেন্ট তৈরি করছি। যদিও সময় একটু বেশি লাগছে। তবে আমরা সেখানে জিম্মি বাংলাদেশিদের উদ্ধার করব। সেজন্য ইন্টারপোলের সহায়তা দরকার।’
সম্প্রতি চক্রটির বাংলাদেশের মূলহোতা আজম খানসহ তার দুই সহযোগী ময়না ও মো. আলামিন হোসেন ওরফে ডায়মন্ডকে গ্রেফতার করেছে সিআইডি। ইতোমধ্যে আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন আজম খান ও তার সহযোগী ডায়মন্ড।
সিআইডির হাতে গ্রেফতার আন্তর্জাতিক নারী পাচারকারী চক্রের মূলহোতা আজম খান
জবানবন্দি, জিজ্ঞাসাবাদে প্রাপ্ত তথ্য ও অনুসন্ধানের ভিত্তিতে সিআইডি জানায়, দুবাইয়ের ফরচুন পার্ল হোটেল অ্যান্ড ড্যান্স ক্লাব, হোটেল রয়েল ফরচুন, হোটেল ফরচুন গ্রান্ড ও হোটেল সিটি টাওয়ারের অন্যতম মালিক বাংলাদেশে চক্রটির গডফাদার আজম খান। অর্ধশত দালালের মাধ্যমে অল্পবয়সী মেয়েদের অথবা ২০/২২ বছরের তরুণীদের উচ্চ বেতনে কাজ দেয়ার কথা বলে প্রলুব্ধ করতেন। বিশ্বস্ততার জন্য চাকরির আগেই ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকা পরিশোধ করা হতো। পাশাপাশি দুবাইয়ে যাওয়া-আসার সব খরচও দিত চক্রটি।
দালালরা নির্ধারিত দুটি বিদেশি এয়ারলাইন্স এজেন্সির মাধ্যমে তাদের দুবাই পাঠাত। সেখানে যাওয়ার পরে প্রথমে তাদের ছোটখাটো কাজ দেয়া হতো। এরপর জোরপূর্বক ড্যান্সবারে নাচতে বাধ্য করা হতো। অন্যথায় শারীরিকভাবে নির্যাতন অথবা বদ্ধ ঘরে আটকে রেখে বৈদ্যুতিক শক পর্যন্ত দেয়া হতো। দেয়া হতো না কোনো খাবার। একপর্যায়ে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন অর্থাৎ প্রস্টিটিউশনে (পতিতাবৃত্তি) বাধ্য করা হতো তাদের।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে সিআইডি’র তদন্ত সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেন, দুবাইতে জিম্মি থাকা অনেক তরুণী দেশে ফেরার জন্য উদগ্রীব হয় আছেন। শতাধিক তরুণীর দেশে ফেরার কাকুতি-মিনতির অডিও-ভিডিও রেকর্ডও সিআইডি’র হাতে এসেছে। আজম খানের মোবাইল ফোন থেকে আরও গুরুত্বপূর্ণ তথ্যও উদ্ধার করা হয়েছে বলে জানান তিনি।
দুবাইয়ে আজম খানের বিলাসবহুল হোটেল
‘বেশকিছু ভিকটিমের সাথে ইতোমধ্যে আমাদের যোগাযোগ হয়েছে। তাদের জবানবন্দি ও বক্তব্য রেকর্ড করা হয়েছে। তারা অনেক চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছেন। তাদের মাধ্যমে আমরা জেনেছি, দুবাইয়ের স্থানীয় কিছু সদস্যও পাচার চক্রের সাথে জড়িত’- বলেন ওই কর্মকর্তা।
যোগাযোগ করা হলে সিআইডি'র অর্গানাইজড ক্রাইমের ডিআইজি ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, ইতোমধ্যে এ চক্রের মূলহোতা আজম খান ছাড়াও বেশ কয়েকজনের নাম আমরা জেনেছি। তদন্তের স্বার্থে এখন নামগুলো বলা যাচ্ছে না। তাদের অনেকের অবস্থানও আমরা নিশ্চিত করেছি।
তিনি আরও বলেন, আন্তর্জাতিক এই নারী পাচারকারী চক্রের সাথে ভারতীয় ও পাকিস্তানি নাগরিকরাও রয়েছেন। তারা সবাই এখন দুবাইয়ে অবস্থান করছেন। তাদের সম্পর্কে তথ্য বের করাটা বেশ কঠিন। দুবাইয়ে যে হোটেলগুলোতে বাংলাদেশিদের রাখা হয়, সেগুলোর পরিচালনায় রয়েছেন আজমের দুই ভাই এরশাদ ও নাজিমউদ্দিন। তারা সেখানেই অবস্থান করছেন।
দুবাইয়ে আজম খানের বিলাসবহুল চার হোটেল
‘পাচারকারীদের গ্রেফতার এবং জিম্মি বাংলাদেশিদের উদ্ধারে আমরা পুলিশ সদর দফতরের ন্যাশনাল সেন্ট্রাল ব্যুরোর (এনসিবি) মাধ্যমে ইন্টারপোলের সহায়তা নিচ্ছি। সেজন্য ডকুমেন্ট তৈরির কাজ চলছে।’
বাংলাদেশি পাচারকারীদের গডফাদার আজম খান আদালতে সব স্বীকার করেছেন। আমরা তার বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং সংক্রান্ত অভিযোগও পেয়েছি, সেগুলোর অনুসন্ধান চলছে। তার বিরুদ্ধে সিআইডি শিগগিরই মানি লন্ডারিং আইনে মামলা দায়ের করবে’— বলেন ডিআইজি ইমতিয়াজ আহমেদ।
সিআইডি’র ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, চক্রটি একসাথে ৪/৫ জন মেয়েকে দুবাইয়ে পাঠানোর ব্যবস্থা করে। আমাদের কাছে তথ্য রয়েছে যে, বিপুলসংখ্যক বাংলাদেশি মেয়ে এখনও সেখানে অবস্থান করছেন। তাদের নিরাপদে দেশে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নিতে মন্ত্রণালয় ও দূতাবাসের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হয়েছে। ইতোমধ্যে দূতাবাসের সহযোগিতায় ১৬ ভুক্তভোগী দেশে ফিরেছেন।
জেইউ/এমএআর/এমএস