সংকটে অন্ধকার দেখছেন প্রবাসীরা
প্রবাসী তানভীর ইসলাম। সাত বছর যাবত মালয়েশিয়ায় আছেন। একটি অভিজাত রেস্টুরেন্টে চাকরি করছিলেন। ভালোই চলছিল কর্মজীবন। কিন্তু করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে গত ফেব্রুয়ারি থেকে সবকিছু পাল্টে গেছে। বন্ধ হয়ে গেছে রেস্টুরেন্টটি। কর্মহীন হয়ে পড়েছেন তানভীর। তারপর থেকে প্রায় পাঁচ মাস বেকার। আইনের কঠোরতা ও নানা বিধিনিষেধের কারণে অন্য কোনো কাজও করতে পারছে না। আগের আয় থেকে যে সামান্য অর্থ জমা ছিল, তা-ও শেষ। ধার-দেনা করে এখন দুর্বিষহ জীবন কাটাচ্ছেন। দেশে ফেরত আসা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই তানভীরের সামনে। কিন্তু দেশে এসেইবা কী করবেন, এ নিয়ে দুশ্চিন্তা পিছু ছাড়ছে না তার।
একই অবস্থা সৌদি আরব প্রবাসী সোলেমান হোসেনের। কাজ করছিলেন একটি ড্রায়িং হাউসে। মক্কার বিভিন্ন হোটেলের লন্ড্রি কাজগুলো করতো তার প্রতিষ্ঠান। কিন্তু করোনার কারণে ওমরাহ বন্ধ থাকায় বছরের শুরু থেকেই কাজ নেই। ফলে বেকার ও ঘরবন্দী হয়ে বসে আছেন। এবার হজও সীমিত পরিসরে পালনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সৌদি সরকার। তাই তার ড্রায়িং হাউসে কাজ শুরু হবে কি-না তা নিয়ে অনিশ্চয়তায় রয়েছেন সোলেমান।
সোলেমান জাগো নিউজকে জানান, ঋণ করে জমি বন্ধক রেখে প্রায় চার লাখ টাকা খরচ করে সৌদি এসেছেন। প্রথম তিন বছর ভালোই কাজ করেছেন তিনি। কিন্তু গত হজের পর তেমন কাজ না থাকায় সমস্যা শুরু হয়। চলতি বছরের শুরু থেকে কাজ প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। করোনায় লকডাউনের কারণে এখন কাজ নেই, ঘরবন্দী হয়ে বসে আছেন। কোনোমতে খেয়ে-পরে দিন চলছে তার।
সৌদি যাওয়ার সময় ধার-দেনার বেশিরভাগ অর্থ এখনো বাকি রয়েছে জানিয়ে এ প্রবাসী বলেন, স্ত্রী-সন্তান ও বিধবা মায়ের খরচ দেয়ার পর অবশিষ্ট টাকায় ঋণ কিছুটা শোধ হয়েছে। তবে এখনো বেশিরভাগ দেনা বাকি। এই ক’দিন কাজ না থাকায় এখানে নিজের খাওয়া থাকার খরচ যোগানো যাচ্ছে না। তিন মাস দেশে টাকা পাঠাতে পারিনি। পরে ঈদের আগে ধারদেনা করে ১০ হাজার টাকা পাঠিয়েছি। এখন পর্যন্ত ওই টাকাও শোধ করতে পারিনি। কাজ নেই কীভাবে করব? কারখানায়ই কাজ নেই। বাইরে কাজ করা যায় না, পুলিশ ঝামেলা করে। এখন কী করবো কিছুই বুঝতে পারছি না। দেশে গেলে পাওনাদাররা চাপ দেবে। চারজনের সংসার। দেশে গিয়ে কী করবো? কীভাবে চলবো? সামনে সব অন্ধকার দেখছি।
শুধু তানভীর বা সোলেমান নন, তাদের মতো লাখ লাখ প্রবাসী এখন বেকার হয়ে দুর্বিষহ জীবনযাপন করছেন। দুশ্চিন্তায় নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছেন ভবিষ্যতের চিন্তায়। যারা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে দেশের অর্থনীতির চাকাকে সচল রেখেছেন তাদের বোবা কান্না দেখার যেন কেউ নেই। অনেকে এরই মধ্যে অসহায় হয়ে দেশে ফিরে এসেছেন। আবার কেউ অপেক্ষায় রয়েছেন ফিরে আসার।
বিশেষজ্ঞ ও খাত-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তরুণ-যুবক এসব রেমিট্যান্সযোদ্ধার জন্য সরকারের এখনই পদক্ষেপ নেয়া উচিত। না হলে এসব মানবসম্পদ সরকারের বোঝা হয়ে দাঁড়াবে।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) অনারারি ফেলো ও অর্থনীতিবিদ ড. মোস্তাফিজুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, আমাদের অর্থনীতির অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি হলো প্রবাসীদের আয়। করোনার প্রভাবে এখন মধ্যপ্রাচ্যসহ উন্নত অনেক দেশের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। অনেকে কর্মী ছাঁটাই করছে, আবার অনেকে ছাঁটাইয়ের চিন্তাভাবনা করছে। এর ফলে অনেক প্রবাসী এখন সংকট ও চিন্তার মধ্যে আছেন।
তিনি বলেন, প্রবাসী হিসেবে শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের লোকই কাজ করেন। সব দেশই চাইবে তার দেশের লোকজন যেন কর্মহীন না হয়। দেশে ফেরত না আসে। এক্ষেত্রে দুইটা বিষয়ে আমাদের কাজ করতে হবে। প্রথমত, আমাদের যে দূতাবাসগুলো রয়েছে, তাদের খুব সক্রিয়ভাবে কূটনৈতিক আলোচনা চালিয়ে যেতে হবে ওইসব দেশের সরকারের সঙ্গে। যেন আমাদের দেশের কর্মীদের ছাঁটাই করা না হয়। একইসঙ্গে যেসব প্রতিষ্ঠানে প্রবাসীরা কাজ করেন তাদের সঙ্গে সরকারি ও ব্যবসায়ী পর্যায়ে আলোচনার করতে হবে। দ্বিতীয়ত, প্রবাসীদের নিয়ে কাজ করে এমন বৈশ্বিক সংস্থাগুলোর সঙ্গে আলোচনা করতে হবে। যেমন ‘কলম্বো প্লাটফর্ম’; এখানে যেসব দেশ থেকে লোক যাচ্ছে তাদের যেমন মেম্বার রয়েছে, আবার যে দেশে কাজের জন্য যাচ্ছে ওই দেশের প্রতিনিধিও রয়েছে। এখন এসব প্লাটফর্মকে কাজে লাগাতে হবে, যেন প্রবাসী শ্রমিকরা কর্মহীন না হন। তাদের বেতন-ভাতা যেন ঠিক থাকে।
‘আর যেসব শ্রমিক ইতোমধ্যে কর্ম হারিয়ে দেশে ফিরে এসেছেন অথবা ফিরে আসতে বাধ্য হবেন তাদের জন্য দেশে কর্মসংস্থানসহ বিভিন্ন সহযোগিতামূলক উদ্যোগ নেয়া জরুরি। এজন্য ফেরত আসা প্রবাসীদের প্রথমে নিবন্ধন করতে হবে। এরপর তাদের প্রয়োজনীয়তা কী এটি নির্ধারণ করতে হবে। যেমন অনেকে চাকরি খুঁজবেন, অনেকে স্বল্প পুঁজি দিয়ে ব্যবসা করতে চাইবেন, কারও ঋণ নেয়ার প্রয়োজন হবে। এক্ষেত্রে সরকারকে সহযোগিতা করতে হবে। কর্মসংস্থান ব্যাংক ও প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক আছে; তাদের মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্ত এ প্রবাসীদের বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে ঋণ সহায়তা করতে হবে। এছাড়া সরকার যে প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে এখানে কৃষি খাতসহ কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে যে অর্থ দেয়া হচ্ছে সেখানে প্রবাসীদের অগ্রাধিকার দেয়া যেতে পারে। যারা ব্যবসা করবে তাদের সহজে লাইসেন্সসহ সব ধরনের নীতি সহায়তার ব্যবস্থা নিতে হবে। যেন ব্যবসা শুরুর সময়ে বাধার সৃষ্টি না হয়।’
এছাড়া অনেক বেকার চাকরি খুঁজবেন। তবে চলমান পরিস্থিতিতে সহজে চাকরি পাওয়া সম্ভব হবে না। এমন অবস্থায় সামাজিক সুরক্ষার আওতায় সরকার যে নগদ সহায়তা দিচ্ছে সেখানে বেকার প্রবাসীদের যুক্ত করা প্রয়োজন। মূলত এই চলমান করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত সরকারের এসব ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি—বলেন মোস্তাফিজুর রহমান।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রধান চার খুঁটির একটি হচ্ছে প্রবাসী আয়। পৃথিবীর ১৬৯টি দেশে এক কোটি ২২ লাখ প্রবাসী আছেন। প্রায় প্রতি ১৬ জনে একজন বাংলাদেশি দেশের বাইরে জীবিকার জন্য অবস্থান এবং কাজ করছেন। সদ্যসমাপ্ত অর্থবছরেও তারা বৈধপথেই রেকর্ড ১৮ বিলিয়ন ডলারের বেশি রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন। হুন্ডি এবং অন্যান্য পথে পাঠানো টাকা হিসাবে আনলে এর পরিমাণ আরও ৪-৫ বিলিয়ন ডলার বেশি হয়।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, রেমিট্যান্স প্রবাহের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ আসে মধ্যপ্রাচ্য থেকে। ১১ দশমিক ৬৫ শতাংশ আসে যুক্তরাষ্ট্র থেকে। ইউরোপীয় দেশগুলো থেকে আসে ১২ দশমিক ৩৫ শতাংশ। এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের দেশ অস্ট্রেলিয়া, জাপান, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর থেকে আসে ১১ শতাংশ।
বাংলাদেশে রেমিট্যান্স আসার ক্ষেত্রে শীর্ষ দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে- সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, যুক্তরাষ্ট্র, কুয়েত, যুক্তরাজ্য, মালয়েশিয়া, ওমান, কাতার, ইতালি, বাহরাইন, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ আফ্রিকা, ফ্রান্স, দক্ষিণ কোরিয়া ও জর্ডান।
করোনার প্রভাবে অর্থনৈতিক সংকটে পড়েছে এসব অঞ্চল ও দেশও। যার প্রভাব পড়ছে বাংলাদেশি প্রবাসীদের ওপর। এরই মধ্যে কুয়েত, বাহরাইন, মালদ্বীপসহ বিভিন্ন দেশ থেকে বাংলাদেশি কর্মী ফেরত আনার জন্য তাগাদা দেয়া হচ্ছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, সদ্যসমাপ্ত ২০১৯-২০ অর্থবছরে প্রবাসীরা মোট এক হাজার ৮২০ কোটি ৪৯ লাখ ডলার সমপরিমাণ অর্থ দেশে পাঠিয়েছেন, দেশীয় মুদ্রায় যা এক লাখ ৫৪ হাজার ৭৪২ কোটি টাকা (পরিমাণ প্রতি ডলার ৮৫ টাকা ধরে)। এর আগে কোনো অর্থবছরে এত অর্থ দেশে আসেনি। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে প্রবাসীরা এক হাজার ৬৪২ কোটি ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছিলেন। সেই হিসাবে আগের অর্থবছরের তুলনায় সদ্য সমাপ্ত অর্থবছরে রেমিট্যান্স বেড়েছে ১৭৮ কোটি ৫৩ লাখ ডলার বা ১৫ হাজার কোটি টাকা।
এসআই/এইচএ/এমএস