পদ্মা সেতুর পিলারের গোড়ার মাটি সরে যাওয়ার ঝুঁকি!
অত্যন্ত খরস্রোতা পদ্মা। তারই বুকে বসানো হচ্ছে বৃহৎ স্থাপনা পদ্মা সেতু। ইতোমধ্যে সেতুর কাজ শেষ হয়েছে প্রায় ৮৭ শতাংশ। বসানো হয়েছে ৪০টি পিলার। এর মধ্যে ২২টি পিলারের গোড়ায় এমন মাটি রয়েছে যেটা কোহেনসিভ অর্থাৎ সহজেই সরে যায়। ফলে ঝুঁকি এড়াতে সেই পিলারগুলোতে দেয়া হয়েছে বাড়তি পাইল। তারপরও পদ্মা সেতুর পিলারের গোড়া থেকে মাটি সরে যাওয়ার ঝুঁকি রয়ে গেছে।
গত ২০ মে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) ‘পদ্মা বহুমুখী সেতু নির্মাণ (দ্বিতীয় সংশোধিত)’ শীর্ষক প্রকল্পের ওপর নিবিড় পরিবীক্ষণের দ্বিতীয় খসড়া প্রতিবেদনে এমনটাই উল্লেখ করা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘পদ্মা নদী অত্যন্ত খরস্রোতা বিধায় সেতুর পিলারের গোড়ায় স্কোয়ারিংয়ের (পিলারের গোড়া থেকে মাটি সরে যাওয়া) সম্ভাবনা রয়েছে, যা প্রকল্পটির জন্য ঝুঁকিপূর্ণ।’
তবে আইএমইডির তথ্যের সঙ্গে একমত নন পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক মো. শফিকুল ইসলাম। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘তাদেরকে (আইএমইডি) জিজ্ঞাসা করেন, আপনারা ঝুঁকিপূর্ণ কাজ কেন এলাউ (অনুমতি) করছেন? জিজ্ঞাসা করেন যে, ঝুঁকিপূর্ণ কাজে ৩০ হাজার কোটি টাকার বরাদ্দ কেন বন্ধ করছেন না? তাদের তো কাজ বন্ধ করে দেয়া উচিত। এটা তো ইমিডিয়েটলি (তাৎক্ষণিক) বন্ধ করা উচিত বা অ্যাকশনে (ব্যবস্থা) যাওয়া উচিত। যারা ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করছে, তাদের বিরুদ্ধে অ্যাকশনে যাওয়া উচিত। সরকার এত টাকা খরচ করছে, আর তারা ম্যানেজমেন্ট থেকে পাস করে বা কেউ হয়তো ইতিহাসে পাস করে বলে দিল ঝুঁকিপূর্ণ!’
‘আমরা তো ইতিহাসে পাস করি নাই। আমরা ম্যানেজমেন্টের ছাত্রও না।’
শফিকুল ইসলাম আরও বলেন, ‘আমরা তো ওখানে পার্টি। আমরা কী বলব! উনারা বলবে? আমাদের ডিজাইন ১০০ বছরের। এই ব্রিজের স্থায়িত্ব ১০০ বছরের। সেভাবে কাজ হচ্ছে। কোথাকার কে কী বলল, সেটা আমাদের জানার দরকার নাই।’
এ বিষয়ে কথা বলতে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নানকে ফোন দেয়া হলে তিনি রিসিভ করেননি। অন্যদিকে আইএমইডি সচিব আবুল মনসুর মো. ফয়েজ উল্লাহকে ফোন করা হলে তা বন্ধ পাওয়া যায়। ফলে তারা কেন কাজ বন্ধ করতে বলছেন না কিংবা পদক্ষেপ নিচ্ছেন না, তা জানা সম্ভব হয়নি।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পানিসম্পদ বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. আব্দুল মতিন জাগো নিউজকে বলেন, ‘পদ্মা সেতুর নকশা ওইভাবেই করা হয়েছে। স্কোয়ারিং হলেও কিছু হবে না। প্রথমত, স্কোয়ারিং মনিটরিং করতে হবে। কতটুকু স্কোয়ারিং হলো প্রতি বছর তা মনিটরিং করতে হবে। দেখতে হবে, প্রত্যাশিত স্কোয়ারিংয়ের চেয়ে বেশি চলে গেল নাকি। চলে গেলে এটার ইমিডিয়েট মেজার নিতে হবে। মেজার তো অনেক ধরনের হতে পারে। পাথর ফেলেও করা যায়। অবশ্য পাথর থাকে না। চলে যায়। ড্রেজিং করে, একটু নিয়ম করে ফেলতে হবে আর কী।’
তিনি আরও বলেন, ‘প্রতিবেদনটা যারা তৈরি করেছে, তারা কি টেকনিক্যাল পার্সন, সেটা জানা দরকার। কারণ বিষয়টা নন-টেকনিক্যাল পার্সোনালরা দেখলে হবে না। আইএমইডি এটা উল্লেখ করলে তার মেজার নিতে হবে তো। স্কোয়ারের জন্য মেজার নিতে হবে। এটা টেকনিক্যালি দেখতে হবে।’
আব্দুল মতিন আরও বলেন, ‘আরেকটা সমস্যা হলো, বাংলাদেশে ব্রিজগুলো দেখার লোক নাই। যারা দেখে, তারাই নষ্ট করে। যমুনা ব্রিজটা তো নষ্ট করে ফেলছে। বালু উঠিয়ে নষ্ট করছে। আমাদের নদী তো ভালো। নদীর কোনো সমস্যা নেই। সমস্যা হলো আমাদের নিয়ে। মেঘনা ব্রিজে এমন একটা স্কোয়াল হয়ে গেছিল। কেন হয়েছিল? মাটি উঠিয়ে নেয়া হয়েছিল। আমি তখন মন্ত্রীকে বলেছিলাম, মাটি উঠানো বন্ধ করেন। মাটি আসতেছে না, মানে নদীর মাটি নেই। ঘোলা পানি নেই। ঘোলা পানি থাকলে ভালো। তাহলে বালি আসতেছে, জমতেছে, চলে যাচ্ছে। একটা অ্যাক্টিভিজমের মধ্যে থাকে। যেখানে শুধু পানি আসছে, সেখানে তো মাটি উঠিয়ে নিয়ে যাবে। যদি মানুষ মাটি উঠিয়ে নিয়ে যায়, তাহলে শেষ। মাটি উঠেয়ে নিয়ে যাওয়াই সমস্যা।’
আইএমইডির প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, পদ্মা মূল সেতুর ভৌত অবকাঠামো নির্মাণের জন্য চায়না রেলওয়ে মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং গ্রুপ কোম্পানি লিমিটেডকে ঠিকাদার হিসেবে নিয়োগ করা হয়। চুক্তি মূল্য ছিল ১২ হাজার ১৩৩ কোটি টাকা। ২০১৪ সালের ২৬ নভেম্বর মূল সেতু নির্মাণের কাজ শুরু হয়। চুক্তি অনুসারে কাজ শেষ করার কথা ছিল ২০১৮ সালের ২৪ নভেম্বর। পরবর্তীতে তিনবার সময় বাড়িয়ে করা হয়েছে ২০২১ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত খরচ হয়েছে ১০ হাজার ১ কোটি ৭৩ হাজার টাকা।
চিনা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ২০১৪ সালের ১ নভেম্বর দুই ধাপে গ্রাউন্ড ইনভেস্টিগেশন শুরু করে এবং ২০১৭ সালের ১১ মে তা শেষ করে। সেই প্রতিবেদন অনুসারে সেতুর ২২টি পিলারের জায়গায় কোহেনসিভ সয়েলের (সহজেই সরে যাওয়া মাটির) উপস্থিতি পাওয়া যায়। মূল নকশা অনুসারে, মূল সেতুর ৪০টি পিলারে ছয়টি করে মোট ২৪০টি পাইল বসানোর পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু কোহেনসিভ সয়েলের উপস্থিতির জন্য পিলারের গোড়ায় আরও একটি করে অতিরিক্ত পাইল বসানো হয়। ২০১৯ সালের জুলাইয়ে ৪০টি পিলারে মোট ২৬২টি পাইল বসানোর কাজ শেষ হয়।
অন্যদিকে মূল সেতুর নির্মাণকাজ তদারকির জন্য নিয়োজিত পরামর্শকের চলতি বছরের মার্চে দেয়া প্রতিবেদন অনুসারে, ৪০টি পিলার নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে। পদ্মা-সেতুর দুই প্রান্তের ট্রানজিশন পিলারের কাজও চলতি বছরের ৮ জানুয়ারি শেষ হয়েছে। তারপরও পিলারের গোড়া থেকে মাটি সরে যাওয়ার ঝুঁকি রয়েই গেল।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, করোনাভাইরাসের সংক্রমণের কারণে ২০২১ সালের জুনে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও তা না হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত মূল সেতু নির্মাণের ভৌত অগ্রগতি হয়েছে ৮৭ শতাংশ এবং আর্থিক অগ্রগতি হয়েছে ৮৫ শতাংশ। নদীশাসন কাজের ভৌত অগ্রগতি হয়েছে ৭১ শতাংশ এবং আর্থিক অগ্রগতি হয়েছে ৫৭ শতাংশ। জাজিরা সংযোগ সড়কের কাজ শুরু হয় ২০১৩ সালের ৮ অক্টোবর এবং শেষ হয় ২০১৮ সালের ২ জুন। এতে খরচ হয়েছে এক হাজার ২৭১ কোটি ৮৫ লাখ টাকা। মাওয়া সংযোগ সড়কের কাজ শুরু হয় ২০১৪ সালের ২৭ জানুয়ারি এবং শেষ হয় ২০১৬ সালের ২৬ জুলাই। এতে খরচ হয় ১৯৩ কোটি ৬৫ লাখ টাকা। সার্ভিস এরিয়া-২ এর কাজ শুরু হয় ২০১৪ সালের ১২ জানুয়ারি এবং শেষ হয় ২০১৬ সালের ১১ জুলাই। এতে খরচ হয়েছে ১৯৯ কোটি ৭৩ লাখ টাকা।
আইএমইডি সূত্র বলছে, প্রথমে পদ্মা সেতুর ব্যয় ধরা হয়েছিল ১০ হাজার ১৬১ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। তার মধ্যে প্রকল্প ঋণ ছিল ৬ হাজার ৮৮০ কোটি ৬৬ লাখ টাকা, যা মোট ব্যয়ের ৬৭ দশমিক ৬৭ শতাংশ। পরবর্তীতে প্রকল্প সংশোধন করে ব্যয় দ্বিগুণ করা হয়। সংশোধনীর পর ব্যয় দাঁড়ায় ২০ হাজার ৫০৭ কোটি ২০ লাখ টাকা। তার মধ্যে বিদেশি ঋণ ছিল ১৬ হাজার ২৪৯ কোটি ৫২ লাখ টাকা, যা মোট ব্যয়ের ৭৯ দশমিক ২৪ শতাংশ। এরপর আবার (দ্বিতীয়) সংশোধন করে পদ্মা সেতুর খরচ নির্ধারণ করা হয় ২৮ হাজার ৭৯৩ কোটি ৩৯ লাখ টাকা। এরপর আবার ২০১৮ সালে বিশেষ সংশোধনীর মাধ্যমে ব্যয় বাড়িয়ে করা হয় ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি ১৯ লাখ টাকা এবং মেয়াদ বাড়ানো হয় ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত।
পদ্মা বহুমুখী সেতু নির্মাণ প্রকল্পের প্রভাবে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সেখানকার ১৭ হাজার ৪৯২টি পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের ৭টি পুনর্বাসন এলাকায় মোট ২ হাজার ৯০৬টি প্লটের ব্যবস্থা করা হয়েছে। তার মধ্যে ২ হাজার ৬২৪টি প্লট হস্তান্তর করা হয়েছে। পুনর্বাসন বাবদ চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত খরচ করা হয়েছে ৯৫৭ কোটি ৭৮ লাখ টাকা।
পিডি/এফআর/এমএআর/এমএস