বেসরকারি চাকুরে-শ্রমজীবীদের দুর্দিন
>> ৬৬ দিনের লকডাউনে ৩ কোটি ৬০ লাখ মানুষ কাজ হারায়
>> শ্রেণি কাঠামোর পরিবর্তন হয়েছে ৫ কোটি ৯৫ লাখ মানুষের
>> নতুন করে দুই কোটি ৫৫ লাখ মানুষ হতদরিদ্র হয়েছে
>> অতি-ধনীর অবস্থা অপরিবর্তিত রয়েছে : আবুল বারকাত
রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর মাতুয়াইল কবরস্থান এলাকার হলিচাইল্ড প্রিপারেটরি স্কুলে শিক্ষকতা করেন রুনা আক্তার। সঙ্গে আরও চারটি টিউশনি। এই উপার্জনে মা, বোন, ভাইসহ চার সদস্যের সংসার ভালোই চলছিল। কিন্তু করোনার কারণে গত মার্চ মাস থেকে স্কুল বন্ধ। এপ্রিল থেকে টিউশনিও বন্ধ, কেউ বাইরের মানুষকে ঘরে ঢোকাতে চাইছেন না। করোনা পরিস্থিতির উন্নতিরও কোনো লক্ষণ নেই। চোখে অন্ধকার দেখছেন রুনা আক্তার।
বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) সংক্রমণ এমন অবস্থায় ফেলেছে দেশের বিপুলসংখ্যক বেসরকারি চাকরিজীবী ও শ্রমজীবী মানুষকে। কেউ কেউ টিকতে না পেরে ঢাকা শহর ছেড়ে গ্রামের পথ ধরছেন।
দীর্ঘ ৬৬ দিন ছুটির পর গত ৩১ মে থেকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে সীমিত পরিসরে অফিস-আদালত ও ব্যবসা-বাণিজ্য খুলে দেয়া হয়। কিন্তু করোনা পরিস্থিতির কোনো উন্নতি নেই। এই অবস্থা চলতে থাকলে সংকট আরও ঘণীভূত হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
মার্চ মাসের শুরুতে দেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত প্রথম রোগী ধরা পড়ে। পরিস্থিতি ক্রমাবনতির দিকে যেতে থাকলে ২৬ মার্চ থেকে ৪ এপ্রিল পর্যন্ত সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে সরকার। এরপর দফায় দফায় ছুটি বাড়তে থাকে। সর্বশেষ গত ৩০ মে শেষ হয় টানা ৬৬ দিনের সাধারণ ছুটি।
দীর্ঘ ছুটি, লকডাউন, সংক্রমণ পরিস্থিতির ক্রমাবনতির কারণে সরকারি চাকরিজীবী ও নিত্যপণ্যের ব্যবসায়ী ছাড়া বেসরকারি বিভিন্ন খাতের চাকুরে ও শ্রমজীবী মানুষের দুর্দিন চলছে। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এমন চিত্রই পাওয়া গেছে।
সামষ্টিক অর্থনীতি পর্যালোচনায় করোনার প্রভাবের সার্বিক চিত্র নিয়ে গত ৭ জুন সংবাদ সম্মেলন করে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। তারা বলেছে, করোনার কারণে আয় কমে যাওয়ায় দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বেড়েছে। ফলে সার্বিকভাবে দারিদ্র্যের হার ৩৫ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। পাশাপাশি আয় ও ভোগের বৈষম্যও বেড়েছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) খানা আয় ও ব্যয় জরিপ ২০১৬ অনুযায়ী, তখন দারিদ্র্যের হার ছিল সাড়ে ২৪ শতাংশ। ২০১৯ সাল শেষে অনুমিত হিসাবে তা নেমে আসে সাড়ে ২০ শতাংশে। সিপিডি বলছে, করোনার কারণে কর্মহীন মানুষের সংখ্যা বেড়েছে, মানুষের আয় কমেছে। ফলে দারিদ্র্যের হারও বেড়ে গেছে।
সিপিডির মতে, করোনার কারণে গিনি সহগে ভোগের বৈষম্য বেড়ে দশমিক ৩৫ পয়েন্ট হয়েছে। ২০১৬ সালে এটি ছিল দশমিক ৩২ পয়েন্ট। একইভাবে আয়ের বৈষম্য বেড়ে দাঁড়িয়েছে দশমিক ৫২ পয়েন্ট। ২০১৬ সালের হিসাবে এটি ছিল দশমিক ৪৮ পয়েন্ট।
সিপিডির বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, করোনার কারণে অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল কিংবা সক্ষমতা অনুযায়ী উৎপাদন করতে পারেনি। এতে একদিকে চাকরি হারিয়েছেন অনেকে, অনেকে কম বেতন পেয়েছেন।
২০২০-২১ অর্থবছরের বিকল্প বাজেট নিয়ে গত ৮ জুন এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. আবুল বারকাত জানান, মহামারি করোনাভাইরাসের কারণে সরকারঘোষিত ৬৬ দিনের লকডাউনে প্রায় পৌনে চার কোটি মানুষ কাজ হারিয়েছে। এ সময়ে পাঁচ কোটি ৯৫ লাখ মানুষের শ্রেণি কাঠামোর পরিবর্তন হয়েছে। নতুন করে দুই কোটি ৫৫ লাখ মানুষ হতদরিদ্র হয়েছে। তবে অতি-ধনীর অবস্থা অপরিবর্তিত রয়েছে।
বিদেশে পণ্য পরিবহনের সঙ্গে সম্পৃক্ত একটি কোম্পানির কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে বলেন, আমাদের কোম্পানি তৈরি পোশাক, চামড়াজাত পণ্য ও ওষুধ বিদেশে পরিবহনের কাজ করে। করোনা পরিস্থিতিতে ক্রেতারা বাংলাদেশ থেকে পণ্য কেনা কমিয়ে দিয়েছে। এতে আমাদের কাজও কমে গেছে। প্রতিষ্ঠানে ইতোমধ্যে কিছু ছাঁটাই হয়েছে। বেশি বেতন নেয়া উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তা লেবেলে ছাঁটাইয়ের একটি প্রক্রিয়া চলছে। এখানে কতদিন চাকরি করতে পারব আল্লাহ-ই ভালো জানেন।
করোনায় পোশাক খাতে ইতোমধ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। কাজ না থাকায় অনেক স্থানে কারাখানা বন্ধ হয়ে গেছে। কোনো কোনো কারখানা বন্ধ হওয়ার পথে। ছাঁটাই প্রক্রিয়া চলছে অধিকাংশ কারখানায়।
প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে বেকার হওয়া পোশাক শ্রমিক জসিম উদ্দিন হাওলাদার। স্ত্রী ও এক সন্তান নিয়ে ভাড়া থাকেন নারায়ণগঞ্জের কাঁচপুরের সোনাপুরে। তিনি বলেন, আমি নিটিং স্টার নামে নারায়ণগঞ্জে একটি কারখানায় কাজ করতাম, কিন্তু সেটি বন্ধ হয়ে গেছে করোনার প্রথম ধাক্কায়।
‘আমরা স্ত্রী স্থানীয় সিনহা গার্মেন্টেসে চাকরি করেন। স্ত্রী চাকরি না করলে ঢাকায় হয়তো টিকে থাকতে পারতাম না। এখন শুনতেছি, কাজ না থাকায় স্ত্রীকেও আগামী মাস থেকে বেতন দেবে না। সামনে কী হবে বুঝতে পারছি না।’
করোনার মধ্যে বেসরকারি ব্যাংক মালিকদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকস (বিএবি) ব্যাংকারদের বেতন কমানোর পরামর্শ দিয়েছে সম্প্রতি। সমালোচনা ও প্রতিবাদের মুখে কয়েকটি ব্যাংক এই পরামর্শ বাস্তবায়ন না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু বেতন কমানো ও ছাঁটাই আতঙ্কে রয়েছেন ব্যাংক খাতের কর্মীরা।
ইতোমধ্যে কর্মীদের বেতন কমিয়েছে আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড (এআইবিএল)। ৪০ হাজার টাকার ওপরে বেতন পান এমন কর্মকর্তাদের বিভিন্ন স্তরে মোট (গ্রোস) বেতনের ওপর ১০ শতাংশ থেকে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত কমিয়েছে ব্যাংকটি।
করোনা পরিস্থিতিতে সংবাদকর্মীরাও ভালো নেই। কয়েকটি পত্রিকা ছাপানো বন্ধ করে অনলাইন কার্যক্রম চালাচ্ছে। বেতন বকেয়া পড়েছে অনেক গণমাধ্যমে। বেতন বন্ধ হয়ে গেছে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের, চলছে ছাঁটাইও। গত ঈদুল ফিতরের সময় বহু সংবাদকর্মী বোনাস পাননি। অবনতিশীল করোনা পরিস্থিতি সংবাদকর্মীদের সংকটকে আরও গভীর করে তুলছে।
করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতি শ্রমজীবী মানুষকেও বিপদে ফেলেছে। খেয়েপরে কোনোরকমে টিকে আছেন তারা। শনির আখড়ার গোবিন্দপুর এলাকায় রাজমিস্ত্রির কাজ করেন হাবিবুর রহমান। তিনি জানান, করোনার সংক্রমণ শুরুর পর মানুষ খুব প্রয়োজন না হলে সেভাবে আর নির্মাণকাজে হাত দিচ্ছেন না। সবাই ভয়ে আছেন। তাই কাজকর্ম নাই বললেই চলে। পেশা পরিবর্তন করে অন্যকিছু করার চিন্তা-ভাবনা করছেন বলেও জানান।
রায়েরবাগ থেকে গুলিস্তান রুটে চলাচলকারী শ্রাবণ পরিবহনের চালক শফিকুল ইসলাম। বলেন, ‘দুই মাস গাড়ি চালাই নাই, কেমনে বাঁইচা ছিলাম ভাই কন! এখন কোনোরকম ডাল-ভাত খাইয়া টিক্যা আছি। পরিস্থিতি ভালা না।’
ঢাকা জেলা ট্রাক, ট্যাঙ্কলরি, কাভার্ড ভ্যান শ্রমিক ইউনিয়নের সাবেক সহ-সম্পাদক মো. শিমুল বলেন, পণ্য পরিবহনের সঙ্গে যুক্ত শ্রমিকরা ভালো নেই। পণ্য পরিবহনের বাহনগুলোর যে পরিমাণ ট্রিপ হওয়ার কথা সেই পরিমাণ হচ্ছে না। সরকার থেকে প্রতি মাসে আড়াই হাজার টাকা করে চার মাস যে টাকা দেয়ার কথা ছিল সেটাও পূরণ হয়নি। আর চাঁদাবাজি তো আছেই!
উপার্জন কমে যাওয়ায় বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের মতো সংকটে পড়েছেন বাড়ির ভাড়ার ওপর নির্ভরশীল বাড়িওয়ালারাও। আর্থিকভাবে সমস্যায় থাকায় ভাড়াটিয়ারা ঠিক মতো বাড়িভাড়া দিতে পারছেন না। পরিস্থিতি বিবেচনায় অনেক বাড়িওয়ালাও ভাড়াটিয়াদের ওপর চাপ দিতে পারছেন না।
ডেমরা স্টাফ কোয়ার্টারের হাজীনগরের একটি চারতলা বাড়ির মালিক শামীমা বেগম। স্বামী মারা গেছেন। বলেন, বাড়ির ভাড়ার টাকায় আমি চলি, ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়া করাই। আমার দুই মেয়ে এক ছেলে।
শামীমা বেগম বলেন, ‘করোনার আগে গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানির বিল পরিশোধের পর ভাড়াবাবদ প্রতি মাসে ৫০ হাজার টাকার মতো পেতাম। করোনা তো সবাইকে বিপদে ফেলেছে। ভাড়াটিয়ারা এখন ঠিক মতো ভাড়া দিতে পারছেন না। কোনো কোনো ভাড়াটিয়ার তিন মাসের বকেয়া পড়েছে। সব দেখতে পাচ্ছি, চাপও দিতে পারছি না। এখন মাসে ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকার মতো পাচ্ছি।’
করোনা সংক্রমণ শুরু হলে অনেকে বাসার কাজের বুয়া বিদায় করে দেন। একাধিক বাসায় কাজ করায় তাদের মাধ্যমে করোনার সংক্রমণ হতে পারে, এই ভেবে বেশির ভাগ মানুষই গৃহস্থলীর কাজ নিজের হাতে তুলে নেন। এতে কাজের বুয়ারা বিপদে পড়েছেন, কষ্টে আছেন তারাও।
আরএমএম/এমএআর/জেআইএম