ধনীকে ধনী গরিবকে গরিব করার বাজেট
জাতীয় সংসদে ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটের তীব্র সমালোচনা করেছেন বাম সংগঠনের নেতারা। এর মধ্যে শুধু বিরোধীরা নন, ক্ষমতাসীন দলের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের নেতারাও আছেন। তারা বাজেটের অবাস্তব দিক তুলে ধরে সমালোচনা করেছেন। বাম নেতাদের কেউ বলছেন, উত্থাপিত বাজেটে যে প্রস্তাব করা হয়েছে তা ৯৯ ভাগ মানুষের স্বার্থবিরোধী। কেউ বলছেন, বাজেটে ধনীদের আর কত ছাড় দেয়া হবে? এ বাজেট গতানুগতিক গণ্ডিতে আটকে থাকা বাজেট। নতুন করে যারা কর্মহীন ও আয়হীন হয়েছেন বা হবেন তারা কীভাবে সামাজিক সুরক্ষা খাতে অন্তর্ভুক্ত হবেন, সেটা পরিষ্কার করা হয়নি। সৎ-অসৎ নানা উপায়ে বিপুল সম্পদ ও প্রতিষ্ঠানের মালিক হয়েছেন তাদের ক্ষেত্রে কর বাড়ানোর পদক্ষেপ নেয়া হয়নি বলছেন বাম নেতারা।
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম প্রস্তাবিত বাজেটের প্রতিক্রিয়ায় বলেন, এই বাজেট ৯৯ ভাগ মানুষের স্বার্থবিরোধী, গতানুগতিক, আমলাতান্ত্রিক। করোনা মহাবিপর্যয়কালে পীড়িত মানুষকে বাঁচানোর জন্য স্বাস্থ্যখাতের প্রাধান্য পাওয়ার জন আকাঙ্ক্ষা উপেক্ষিত হয়েছে ঘোষিত বাজেটে।
তিনি বলেন, এবারের বাজেটে ঘাটতির পরিমাণ এক লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা, যা জিডিপির ৬ শতাংশ। এই বিপুল পরিমাণ বাজেট ঘাটতি মেটানোর জন্য ভবিষ্যত প্রজন্মের কাঁধে বিশাল ঋণের বোঝা চাপিয়ে দিয়ে বাজেটের পরিমাণকে পাঁচ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকা করা হয়েছে। এই অর্থের বেশিরভাগ খরচ হবে পূর্বেকার ঋণ পরিশোধ, শ্বেতহস্তির মতো বিশাল সিভিল-মিলিটারি প্রশাসনের রক্ষণাবেক্ষণ, বিলাসদ্রব্য আমদানি, অপচয়, দুর্নীতিসহ বিভিন্ন প্রকারের সিস্টেম লস, কর-রেয়াতের নামে ধনিক শ্রেণিকে বিশাল ভর্তুকি প্রদান ইত্যাদি কাজে। এসবই হলো লুটেরা ধনিক শ্রেণির স্বার্থে গৃহীত পদক্ষেপ।
বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন বলেন, বাজেটে স্বাস্থ্য, কৃষি, শিল্প ও কর্মসংস্থানকে অগ্রাধিকার দিয়ে কাঠামোগত পরিবর্তন আনা হলেও অর্থমন্ত্রীর বাজেট প্রস্তাবনা এখনও প্রবৃদ্ধিকেন্দ্রিক। ইতোমধ্যেই চলতি বছরের প্রবৃদ্ধির হিসাব পাঁচ দশমিক দুই শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছে। কিন্তু কোভিড আক্রান্ত দেশ ও বিশ্বের অর্থনীতির নীতির পরিস্থিতিতে আট দশমিক দুই শতাংশ প্রবৃদ্ধি কতখানি বাস্তবসম্মত সেটা ভেবে দেখার বিষয়।
তিনি বলেন, উন্নয়ন ছয় মাস বা এক বছরের জন্য নেমে থাকতে পারে, কিন্তু জীবন এক লহমার জন্য থেমে থাকতে পারে না। প্রবৃদ্ধিকে মানুষের জীবনের ঊর্ধ্বে স্থান দেয়া সঠিক নয়। মেনন স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ বৃদ্ধিতে সন্তোষ প্রকাশ করলেও এটাকে নিতান্তই অপ্রতুল এবং এখন দক্ষিণ এশিয়ার দেশসমূহের জিডিপির অংশ হিসেবে সর্বনিম্ন বলে মন্তব্য করেন।
তিনি বলেন, বাজেটে যে কর ধার্য করার কথা বলা হয়েছে, যা সাধারণ মানুষকে আঘাত করে। কিন্তু যারা সম্পদশালী মুনাফাখোর তাদের বাঁচিয়ে দেয়া হয়েছে কৌশলে। এদেশে ধনীদের আর কত ছাড় দেয়া হবে?
জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জেএসডি) সভাপতি আ স ম আবদুর রব বাজেট প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ‘সরকার করোনার ভয়াবহতা উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হয়েছে। বাজেটে মানুষের কর্মসংস্থানের যথাযথ ব্যবস্থা নেই। দারিদ্র্যসীমা থেকে উত্তরণের কোনো দিক-নির্দেশনা নেই। করোনা মোকাবিলায় সরকার জাতীয় স্বাস্থ্য কাউন্সিল গঠন করে সক্ষমতা বৃদ্ধিসহ বাজেটে প্রয়োজনীয় বরাদ্দের বিষয় উপেক্ষা করেছে।’ তিনি বলেন, আয় ও অর্থায়নের অনুমানের ওপর ভিত্তি করে দুর্বল বাজেট করা হয়েছে।
জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদের সভাপতি হাসানুল হক ইনু বলেন, সবাই আশা করেছিলেন বৈশ্বিক মহামারি ও জাতীয় বিপর্যয়ের মধ্যে এবারের বাজেট গতানুগতিকতার বাইরে নতুন দিক উন্মোচনকারী বাজেট হবে। তিনি বলেন, স্বাস্থ্যসেবা খাত ও সামাজিক সুরক্ষা খাতে যতটুকু বরাদ্দ বেড়েছে সেটাও অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কীভাবে ব্যয় হবে তা পরিষ্কার না। নতুন করে যারা কর্মহীন ও আয়হীন হয়েছেন বা হবেন তারা কীভাবে সামাজিক সুরক্ষা খাতে অন্তর্ভুক্ত হবেন সেটাও পরিষ্কার না।
ইনু বলেন, শহর থেকে দুই কোটি মানুষ গ্রামে ফিরে যাবার যে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে তাদের কর্মসংস্থানসহ গ্রামীণ অর্থনীতিকে সচল রাখার জন্য পল্লী উন্নয়ন খাতে বরাদ্দ বাড়ানোর বদলে কমানো হয়েছে। তাই এককথায় বলা যায়, বাজেট প্রস্তাব গতানুগতিকতার গণ্ডিতে আটকে আছে।
বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল-বাসদের সাধারণ সম্পাদক খালেকুজ্জামান বাজেট প্রতিক্রিয়ায় বলেন, বাজেটে ভ্যাটের আওতা বাড়ানো হয়েছে। তাতে সাধারণ মানুষ পরোক্ষ কর দিতে বাধ্য হবেন। কিন্তু যারা সৎ-অসৎ নানা উপায়ে বিপুল সম্পদ ও প্রতিষ্ঠানের মালিক হয়েছেন তাদের ক্ষেত্রে কর বাড়ানোর পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। বরং উৎসে কর, করপোরেট করসহ নানা ক্ষেত্রে রেয়াত দেয়ার কথা বলা হচ্ছে। তিনি বলেন, এ যাবৎ ১৬ বার কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেয়ার পরও মাত্র ১৪ হাজার কোটি টাকা সাদা হয়েছে। যার মধ্যে ৯ হাজার কোটি টাকাই ওয়ান ইলেভেনের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে। তিনি বলেন, কালো টাকা সাদা করার যে সুযোগ দেয়া হয়েছে তাতে দুর্নীতি আরও বাড়বে।
এই বাজেটে ঢালাওভাবে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ অব্যাহত রাখার মাধ্যমে অর্থনীতিতে লুটপাটের ধারা আরও জোরদার করার ব্যবস্থা করা হয়েছে বলে মন্তব্য করেন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ শাহ আলম। তিনি বলেন, ধনীকে আরও ধনী এবং গরিবকে আরও গরিব করা, ধন-বৈষম্য ও শ্রেণি-বৈষম্য বৃদ্ধি করা, সামাজিক অস্থিরতা ও নৈরাজ্য বৃদ্ধি করা ইত্যাদি হবে এই বাজেটের ফলাফল। শাহ আলম বলেন, শিক্ষা-স্বাস্থ্য-কৃষি-কর্মসংস্থান ইত্যাদি ক্ষেত্রে বাজেট বরাদ্দ পর্যাপ্ত পরিমাণে বৃদ্ধির দাবি অগ্রাহ্য করা হয়েছে এবং উল্টো কোনো কোনো ক্ষেত্রে আনুপাতিক বরাদ্দ কমানো হয়েছে। সাধারণ মানুষকে ধোঁকা দেয়ার জন্য কিছু প্রতীকী পদক্ষেপের ছিটেফোঁটা যুক্ত করা হয়েছে।
২০২০-২০২১ অর্থবছরের বাজেটে করোনা দুর্যোগ মোকাবিলায় স্বাস্থ্য, চিকিৎসা, কৃষি ও গ্রামীণখাত যে মনোযোগ ও বরাদ্দ পাওয়ার কথা ছিল তা পায়নি বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক। বাজেট প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেন, এই দুর্যোগেও অর্থমন্ত্রী তার মাথা থেকে প্রবৃদ্ধির ভূত নামাতে পারেননি। তিনি আরও বলেন, ‘অর্থনৈতিক উত্তরণ ও ভবিষ্যত পথ পরিক্রমা’ শীর্ষক বাজেটে দেশের প্রতিটি নাগরিকের জন্য সরকারি উদ্যোগে গণস্বাস্থ্য ব্যবস্থা ও দারিদ্র্যসীমার নীচে নেমে আসা আট কোটি মানুষের জন্য টেকসই ‘গণবন্টন ব্যবস্থা’ গড়ে তোলার কোনো পরিকল্পনা ও প্রয়োজনীয় বরাদ্দের প্রস্তাবনা নেই।
বাজেট বাস্তবায়নে সক্ষমতা এবং ভয়ংকর দুর্নীতি দূর করে সুশাসন নিশ্চিত করাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করেন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদের সাধারণ সম্পাদক শিরিন আখতার। তিনি বলেন, দেশে পাঁচ লাখ ব্যক্তি আছে যারা এক কোটি টাকা ব্যক্তিগত আয়কর দিতে পারেন কিন্তু দেন না। এই ধনীদের তালিকা করে তাদের কাছ থেকে পাঁচ লাখ কোটি টাকা ট্যাক্স আদায়ের করা হলে বাজেট বাস্তবায়নে অভ্যন্তরীণ ব্যাংক ঋণের ওপর নির্ভরশীলতা কমে যাবে।
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী)-সিপিবির (এম) সাধারণ সম্পাদক ডা. এম.এ সামাদ বলেন, জাতীয় সংসদে উত্থাপিত বাজেট গরিব মারার বাজেট। গণবিরোধী-শ্রমজীবী খেটে খাওয়া মানুষের স্বার্থবিরোধী ও ধনিক শ্রেণির স্বার্থে গতানুগতিক আমলাতান্ত্রিক বাজেট। তিনি বলেন, আমরা চেয়েছিলাম মধ্যবিত্ত মেহনতি গরিব মানুষকে বাঁচানোর বাজেট স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কৃষি ও কর্মসংস্থানকে প্রাধান্য দিয়ে সরকার বাজেট প্রণয়ন করবে কিন্তু সরকার করেছে তার বিপরীতটা।
দুর্যোগকালীন সময়কে মোকাবিলা করার বাজেট হয়নি বলে অভিমত গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকির। তিনি বলেন, করোনাভাইরাস মোকাবিলার জন্য যে ধরনের অর্থনীতি দরকার-মানুষের হাতে নগদ টাকা দেয়া এবং অভ্যন্তরীণ চাহিদার বৃদ্ধি ঘটানো, সেই নির্দেশনা দেখিনি। গণমুখী বাজেট হয়নি। সেই সুবিধাভোগীদের সুবিধা দেয়ার পুরনো নীতিই করা হয়েছে।
মুঠোফোন গ্রাহক অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদ বাজেট প্রতিক্রিয়ায় বলেন, বাজেটে টেলিযোগাযোগ সেবায় সম্পূরক শুল্ক পাঁচ শতাংশ বাড়িয়ে দিয়েছে। যা কি-না আয় রোজগারহীন গ্রাহকের ওপর অতিরিক্ত করের বোঝা বাড়বে, ‘জুলুম’ হবে। এ খাতে গত পাঁচ বছরে পাঁচবার কর বাড়িয়ে সরাসরি গ্রাহকের কাছ থেকে ২৮ দশমিক ৫০ শতাশ আদায় করা হয়েছে। এবার আরও পাঁচ শতাংশ বৃদ্ধি করার ফলে গ্রাহকের কাছ থেকে ১০০ টাকায় ৩৩.৭৫ টাকার সঙ্গে অপারেটরদের ওপর আরোপিত কর আদায় করা হবে প্রায় ৩০ টাকা। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য অনুযায়ী, দেশের একজন ভিক্ষুকও টেলিযোগাযোগ ব্যবহার করে। ফলে ভিক্ষুককেও কর দিতে হবে।
বাংলাদেশ যুব মৈত্রীর সভাপতি সাব্বাহ আলী খান কলিন্স বলেন, ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে দেশের বিপুল অংকের বেকার ও বিশ্বব্যাপী করোনা ক্রান্তিকালে দেশে কর্মহীন হয়ে পড়া বেকার যুবকদের কর্মসংস্থান ও প্রণোদনা নিয়ে অর্থমন্ত্রীর কোনো বক্তব্য না থাকায় আমরা হতাশ হয়েছি। তিনি বলেন, করোনা পরিস্থিতির কারণে বিভিন্ন দেশ থেকে প্রবাসী শ্রমিকরা চাকরি হারাচ্ছেন এবং দেশে ফিরে আসছেন। তাদের বিষয়ে সুস্পষ্ট কোনো বক্তব্য নেই অর্থমন্ত্রীর প্রস্তাবিত বাজেটে।
এফএইচএস/এসআর/এমএস