একটি পরিচ্ছন্ন পৃথিবীর অপেক্ষায়
ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ। বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর। করোনার পরিস্থিতি, অর্থনীতি, কৃষি-ব্যবস্থাপনা নিয়ে মুখোমুখি হন জাগো নিউজ’র। অর্থনীতিকে টিকিয়ে রাখতে হলে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের জন্য বিশেষ সহায়তা জরুরি বলে মত দেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সায়েম সাবু।
জাগো নিউজ : করোনা মহামারিতে স্থবির বিশ্ব, স্থবির সমস্ত জনপদ। করোনা পরিস্থিতির দীর্ঘসময়ও কেটে যাচ্ছে। পরিবর্তিত পৃথিবী নিয়ে আপনার কোনো পর্যবেক্ষণ...
ড. ফরাসউদ্দিন : আঁধার শেষে আলো আসবেই। তার আগে অনেক দুমড়ে-মুচড়ে যাবে। একসময় সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু অনেক ক্ষতিও হয়ে যাবে।
জাগো নিউজ : ক্ষতি তো হচ্ছেই...
ড. ফরাসউদ্দিন : সাড়ে সাতশ কোটি মানুষের পৃথিবী। মানুষের ক্ষতি হয়তো আর খুব একটা হবে না। যে ক্ষতি হলো সেটাই অনেক বেশি। মানুষের বড় ক্ষতি হচ্ছে, তার মনোবল ভেঙে যাচ্ছে। এই ক্ষতি মূলত মানুষেরই ক্ষতি।
কিন্তু এর চেয়ে বড় ক্ষতি হচ্ছে অর্থনৈতিক ক্ষতি। গোটা বিশ্বেই অর্থনীতি চরমভাবে ধাক্কা খাবে।
জাগো নিউজ : এই ধাক্কায় মানুষের টিকে থাকার প্রশ্নে কী বলবেন?
ড. ফরাসউদ্দিন : করোনা মানুষের পরীক্ষা নিচ্ছে। সবাই টিকে থাকার চেষ্টা করবে। কিন্তু পারবে না। যারা দুর্বল তারা করোনার প্রভাবে ধ্বংস হয়ে যাবে। আমি এটি খুব নিষ্ঠুরভাবে বলছি। গোটা বিশ্বে তো বটেই, বাংলাদেশেও এই চিত্র দেখতে পাব। করোনাকাল শেষ হয়ে যখন পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে থাকবে, তখন রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজে অনেকেই মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে চাইবে। কিন্তু যারা যোগ্য ও দক্ষ তারাই টিকে থাকবে। অন্যরা শেষ হয়ে যাবে এবং এটিই এখন সময়ের অপেক্ষা।
জাগো নিউজ : যোগ্য বা দক্ষ বলতে আসলে কী বোঝাতে চাইছেন?
ড. ফরাসউদ্দিন : ধরুন, যারা ব্যাংক কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িত, তারা আর প্রতারণা করার সুযোগ পাবে না। খেলাপি ঋণের ফাঁদে ফেলে যারা ব্যাংকগুলো ধ্বংস করছে, একসময় তারাও ধ্বংস হয়ে যাবে।
কারণ করোনার পর অর্থনীতির যখন পুনর্গঠন হবে, তখন কিন্তু এই ব্যাংকের ঋণখেলাপিদের বাদ দিয়েই পুনর্গঠন করতে হবে। ভূমিদস্যু, জলাশয় দলখকারীদের বাদ দিয়েই আগামীর পৃথিবী গড়তে হবে।
যারা ক্রমাগতভাবে পৃথিবী দূষিত করে তুলছে, তারা আর আগামীর পৃথিবীর অংশীদার হতে পারবে না। তারা মানবজাতির জন্য অপরাধী। আমরা একটি পরিচ্ছন্ন পৃথিবীর অপেক্ষায়, যেখানে ধোকাবাজরা ধ্বংস হয়ে যাবে। তবে ভালো মানুষের শক্তিমত্তা ব্যাপকভাবে প্রকাশিত হবে।
এখানে ডারউইনের ‘থিওরি অব সিলেকশন’ কাজে আসবে। মানুষ বাড়বে জ্যামিতিক হারে। খাবার বাড়বে গাণিতিক হারে। একসময় খাবারের প্রাপ্যতার অভাবে ভয়ঙ্কর বিপর্যয় নেমে আসবে।
জাগো নিউজ : তার মানে প্রকৃতি একপ্রকার বদলা নিলো?
ড. ফরাসউদ্দিন : আমার তো বয়স বেশ হলো। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, আমরা প্রকৃতিকে চরমভাবে আঘাত করেছি। প্রকৃতি এখন আমাদের আঘাত করছে। আমরা যখন প্রকৃতিকে আপন করে লালন করব, তখন প্রকৃতিও আমাদের লালন করবে। মানুষের এমন বিশ্বাস হওয়া উচিত।
জাগো নিউজ : সমাজের পুনর্গঠন নিয়ে কী বলা যায়?
ড. ফরাসউদ্দিন : এই প্রশ্নের উত্তরের জন্য আরেকটু অপেক্ষা করতে হবে। আপাতত টিকে থাকাই চ্যালেঞ্জ। তবে সচেতন এবং অন্যের পাশে দাঁড়ানোর একটি শিক্ষা সমাজ পেল। পরবর্তীতে সমাজের রূপায়ন কী ঘটে, তার জন্য অপেক্ষা করতে হবে।
তবে সংকট মোকাবিলায় করোনাভাইরাস পরীক্ষার পরিধি আগে থেকেই বাড়ানোর দরকার ছিল। এখনও বাড়ানো দরকার। যত পরীক্ষা হবে ততই মঙ্গল। সামাজিক দূরত্ব বজাই রেখেই আমাদের করোনা মোকাবিলা করতে হবে। কিন্তু সেখানে যেন মনের দূরত্ব না বাড়ে, সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে।
জাগো নিউজ : ক্ষুদ্র-মাঝারি উদ্যোক্তাদের অনেকেই ক্ষতিগ্রস্ত। তাদের জন্য আপনার কী পরামর্শ?
ড. ফরাসউদ্দিন : প্রতিটি কৃষকই এখন উদ্যোক্তা। আর প্রতি উদ্যোক্তাই কোনো না কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। যেমন, একজন ফুলচাষী সারাবছর অপেক্ষা করেছিলেন, বৈশাখী উৎসবে ফুলের বাজার ধরবেন। এবার তা হলো না। তার কী হবে?
প্রধানমন্ত্রী এমন উদ্যোক্তাদের জন্য ২০ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা ঘোষণা করেছেন। খুবই ভালো উদ্দেশ্য। কিন্তু এই প্রণোদনার বাস্তবায়ন নিয়ে প্রশ্ন দেখা যেতেই পারে। কারণ আমাদের ব্যবস্থাপনায় ত্রুটি আছে এবং তা এই করোনাকালেও প্রমাণিত।
জাগো নিউজ : এই ত্রুটি মোকাবিলায় করণীয় কী?
ড. ফরাসউদ্দিন : যেমন, দেশের মধ্যে প্রায় ২০ লাখ ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা আছেন। এর মধ্য থেকে এক লাখ কী, এক লাখ ২০ হাজার উদ্যোক্তাকে সিলেক্ট করতে হবে এবং তাদের স্বচ্ছতার মধ্য দিয়ে প্রণোদনা দিতে হবে। তবেই অর্থনীতি টিকবে। সবার আগে কৃষককে বাঁচাতে হবে। তাদের পণ্য যেকোনো মূল্যে বিক্রির ব্যবস্থা করতে হবে। রাষ্ট্রকে জরুরিভিত্তিতে এসব উদ্যোগী কৃষককে রক্ষা করতে হবে এবং রাষ্ট্র জানে কীভাবে তা সম্ভব।
এএসএস/এমএআর/এমএস