স্বীকৃতিই এখন এশনুরের একমাত্র অবলম্বন
বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত উপজেলা জকিগঞ্জ সিলেট শহর থেকে ৬০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। ভাঙাচোরা রাস্তা মারিয়ে পাওয়া গেলো সিলেটের একমাত্র মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পাওয়া নারী বীরাঙ্গনা এশনু বেগমের দেখা। একটি চিলেকোটা ঝুপড়ি ঘর, দরজা জানালা ভাঙা, ভাঙাচোরা বাঁশের বেড়া, ঘরের কাঠের চৌকিতে বসে আছেন তিনি। স্থানীয় ১০ বছরের শিশু এমরান দেখিয়ে বলল ওই তাইন এশনু বেগম।
গালভরা হাঁসি দিয়ে এশনু বেগম জিজ্ঞেস করলেন, ‘বাবা আপনে কোন জায়গা থাকি আইছইন। পরিচয় দিয়ে জানতে চাওয়া হলো মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পেয়েছেন, কেমন লাগছে? তখনই এশনু আর আবেগ ধরে রাখতে পারেননি। সেই হাঁসিভরা মুখে এবার কান্না চলে এলো। তবে এই কান্না সুখের, স্বীকৃতি পাওয়ার, এই কান্না যে বীরাঙ্গনা এই জননীর কাছে বিশ্বজয়ের মতোই। অসম্ভব দারিদ্রতার মধ্যে থাকা নিঃসন্তান এই বিধবা নারীর দু`বেলা দুমুঠো ভাত পাওয়ার স্বীকৃতিও।
পরক্ষণে চোখ মুছে তাকে এই স্বীকৃতি দেয়ার জন্য এশনু বেগম প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, মুজিবের বেটি আমাকে এই সম্মান দিছইন আল্লাহ যেন তাইনরে আরো বড় সম্মান দেইন।
এই প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে জানালেন, এই ভাঙাচোরা ঘরে রোদ-বৃষ্টি মাথায় নিয়েই অনাহার অর্ধাহারে জীবন চালাচ্ছেন তিনি। আজ থেকে ১৮ বছর আগে বাবা আর ১২ বছর পূর্বে মা মারা যান এশনুর। স্বামী জমির আলীও মারা গেছেন আরো আগে। ছেলে-মেয়ে কেউ নেই। আত্মীয় বলতে আছেন দুই বোন। এখনো লজ্জায় মুখ লুকিয়ে রাখেন এশনু।
বৃদ্ধ বয়সেও শীতলপাটি ও বাঁশ দিয়ে ডাম, চাঁটাই ইত্যাদি তৈরি করে দিনে দু’মুটো ভাত যোগান। অভাব পিছু না ছাড়লেও কোনোদিন কারো কাছে হাত পাতেননি তিনি। তবে মুক্তিযোদ্ধার এই রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি এশনুর বাকি জীবন চালানোর একমাত্র অবলম্বনও। মুক্তিযোদ্ধার ভাতা দিয়ে কোনো রকম হয়তো খেয়ে না খেয়ে চলা জীবন চালাতে পারবেন তিনি।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় মা-বাবার সংসারে তিনি ছিলেন একা। দুই বোন লেবু বিবি ও লেচু বিবির বিয়ে হয়ে যায়। প্রাইমারির গণ্ডি পাড়ি দিতে পারেননি। যুদ্ধ শুরুর আগেই লেখাপড়া ছেড়ে দেন এশনু। যুদ্ধের সময় তিনি ছিলেন ১৩/১৪ বছরের কিশোরী। শুধু তার গ্রাম নয়, আশপাশের গ্রামে তার মতো সুন্দরী কমই ছিল।
স্থানীয় এক রাজাকারের লুলুপ দৃষ্টি পড়ে তার উপর। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর মনোরঞ্জন যোগানোর জন্য যুদ্ধের মাঝামাঝি সময়ে একদিন গভীর রাতে স্থানীয় রাজাকারদের সহায়তায় তার বাড়িতে হানা দেয় পাকবাহিনী। চোখমুখ বেঁধে নিয়ে যায় উপজেলার শাহগলী বাজারস্থ পাকিস্তানি বাহিনীর বন্দি শিবিরে। চলে অমানবিক নির্যাতন।
চারদিন ক্যাম্পে আটকে রেখে তার ওপর পৈশাচিক নির্যাতন চালায় তারা। একাত্তরের বীরাঙ্গনা এশনু বেগমকে সেই ভয়াল স্মৃতি এখনো তাড়া করে। ওই ঘটনা মনে হলে তার বুক এখনো ধড়ফড় করে বলেও জানালেন তিনি।
সিলেটের সীমান্ত এলাকা জকিগঞ্জ উপজেলার বারহাল ইউনিয়নের মনতৈল গ্রামের ময়গুন বেগম ও রিয়াছদ আলীর মেয়ে এশনু বেগমের বয়স এখন ৬০। দেশ স্বাধীন হওয়ার ৪৪ বছর পেরিয়ে গেলেও এতদিন তার পাশে কেউ দাঁড়ায়নি। কোনো সরকারি বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এতোদিন আনুষ্ঠানিক বা অনানুষ্ঠানিকভাবে তাকে সম্মান জানায়নি।
এই প্রথম সরকার তাকে মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি দিয়ে সম্মান জানালো। তিনি জানান, বছর দুই-এক আগে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার শফিকুর রহমানসহ কয়েকজন এসে তার ছবি, নাম ঠিকানা ও ঘটনার বর্ণনা নিলেও এরপর আর কেউ তার খবর রাখেনি। এশনু বলেন, শইল্লে নানা ব্যারাম (শরীরে নানা রোগ)। ওষুধ নাই। ব্যথা অইলে রসুন তেল ঘষি শইল্লে (রসুনের সাথে তেল গরম করে মালিশ করেন)।
একাত্তরের সেই পৈশাচিক কাহিনীর কথা বলতে গিয়ে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন তিনি। বলেন, সংগ্রামের বরছ (বছর) আমি হুরু আছলাম ছোট। দুই বনির (বোনের) বিয়া অইগেলে আমি অইলাম একলা। একদিন মাজরাইতে আকতা (হঠাৎ মধ্যরাতে) কয়জন রাজাকার মিলিটারি লইয়া আমরার বাড়িঘর গেরাও কইরা মা-বাপের সামনে আমার চউখ বাইন্দা (চোখ বেঁধে নেয়) ফালায়। পরে ধইরা আমারে তাদের ক্যাম্পে লইয়া যায়।
সেদিনের পাকিদের নিষ্ঠুরতার কথা বলতে গিয়ে অশ্রু সংবরণ করতে পারেননি এশনু। পাকিস্তানি ক্যাম্পে নিয়ে অফিসাররা তাকে পালাক্রমে পৈশাচিক নির্যাতন করে। এভাবেই চলে চারদিন। তাকে ছেড়ে দেয়া হলেও সেই অভিশাপের ছাপ এখনো তার মন ও শরীরজুড়ে।
এশনু বেগম বলেন, বাড়িতে আওনের বাদে (আসার পর) লজ্জায় লোকজনের সামনে বাইর হইতে পারতাম না। মুখ সব সময় কাপড় দি ডাইক্কা রাখতাম। মাইনষের কতো বাদ বাদ (খারাপ) কথা হুনতে অইছে। কেউ তাকে বিয়ে করতে রাজি হয়নি। নিজে কোনো অপরাধ না করেও হয়েছেন নিগৃহীত, পেয়েছেন বঞ্চনা, কাটান মানবেতর জীবন।
যুদ্ধের তিন-চার বছর পর বাধ্য হয়ে বাবা-মা গ্রামের বিবাহিত বয়োবৃদ্ধ জমির আলীর সঙ্গে বিবাহ দেন এশনুকে। দরিদ্র জমির আলী মাছ ধরে সংসার চালাতেন। পরপর দু’টি ছেলে সন্তান জন্ম নিলেও জন্মের পরপরই মারা যায় তারা।
এক পর্যায়ে স্বামী নামের ছাতার ছায়াটাও সরে যায় এশনুর মাথার ওপর থেকে। বিয়ের মাত্র কয়েক বছরের মাথায় বার্ধক্যজনিত রোগে বিনা চিকিৎসায় মারা যান জমির আলী। এবার আশ্রয় হয় বাবা-মার ছোট্ট ভিটায়। অনাহারে অর্ধাহারে কাটছে তার একার সংসার। জীবন সায়াহ্ণে এসেও এই পৈশাচিকতার বিচার চান তিনি।
জকিগঞ্জ উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান সাজনা সুলতানা হক চৌধুরী বলেন, রূপ লাবন্যই এশনুর জীবনের জন্য বড় কাল হয়ে দাঁড়িয়েছিলো সেদিন। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ তার জীবনটাকে ওলট পালট করে দেয়। পাক হায়েনাদের নিষ্ঠুর থাবা এশনুকে স্পর্শ না করলে রূপসী এশনুর জীবনটা অন্য রকম হতে পারতো। সবই নিয়তি।
তিনি বলেন, এক সময় বীরাঙ্গনা এশনু লোকলজ্জায় কারো কাছে নির্যাতনের কথা বলতে চাইতেন না। পরে আমরা তাকে বুঝানোর পর তিনি মুখ খুলেন। সাজনা বলেন, এশনুদের বিশাল ত্যাগের উপর দাঁড়িয়ে আমরা আজ স্বাধীন দেশের নাগরিক। দীর্ঘদিন পর সরকার তাকে স্বীকৃতি দেয়ায় আমরা এলাকার মানুষ খুশি।
বারহার ইউনিয়ন মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার শফিকুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, বীরাঙ্গনা এশনু সম্ভ্রম হারিয়েছেন একাত্তরে। সেই সাথে হারিয়েছেন সামাজিক স্বীকৃতিও। তারপর স্বামী- সন্তান মা -বাবা সবাইকে হারিয়ে তিনি পুরোপুরি নি:স্ব হন। পেয়েছেন অপমান আর অবহেলা। বুক ভরা কষ্ট নিয়েই বেঁচে আছেন তিনি। মাথা গোজার ভিটে ছাড়া তার নিজের বলতে কিছুই নেই। তাঁর ঘর বলতে বুঝায় একটি ঝোপড়িকে। সেখানে খেয়ে না খেয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন এই বীরাঙ্গনা জননী।
শফিকুর রহমান বলেন, একথাটি ভেবে ভালো লাগছে দীর্ঘ ৪৪ বছর পর হলেও স্বীকৃতি পাওয়ায় এশনুর কিছুটা হলেও দুঃখ লাগব হবে। রাষ্ট্রের প্রতি তার যে ক্ষোভ ছিলো সেটাও হয়তো একটু লাগব হবে। সরকারের যুগান্তকারী এই উদ্যোগে আমরা মুক্তিযোদ্ধারা খুশি।
পাক হানাদার এবং তাদের এদেশীয় দোসর রাজাকারদের বর্বরতার শিকার এশনু বেগমের বড় বোন লেবু বিবি বলেন, আমার কুমারি বইনরে যে রাজাকারের সাহায্যে তুইল্যা নেওয়া অইছিল, নির্যাতন কইরা ছাইরা দেওয়ার সময় কইছিল সে (ওই রাজাকার) তারে বিয়া করব। পরে আর বিয়া করে নাই।
লেবু বলেন-তাইন (এশনু) দেশের লাগি কোনতা করছইন ই কতাখান সরকারে কইলে আমরা শান্তি পাইতাম। বইনে অত দিনে একটা কাগজও পাইল না। ৪৪ বরছ বাদে ই বরছ তাইন পাওয়ার মাঝে পাইছইন পাচ হাজার ট্যাকা। এবলা আমরা তাইনর খবর হুইনা খুশি অইছি। অখন সরকারও তাইনরে সম্মান দিচে হুইনা আমরা সব খুশি।
জকিগঞ্জ উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার খলিল উদ্দিন বলেন, স্থানীয় এক প্রভাবশালী রাজাকারের সহযোগিতায় তাকে ধরে নিয়ে পৈশাচিক নির্যাতন করে পাক বাহিনীর সদস্যরা। উপজেলার একমাত্র বীরাঙ্গনা নারী মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পাওয়ায় তিনি মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্টদের ধন্যবাদ জানান। তিনি এশনুর সভ্রমহানিকারী রাজাকারদের দৃষ্টান্তমূলক বিচার দাবি করেন।
প্রসঙ্গত, ১২ অক্টেবর মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় দেশের ৪১ বীর নারী বীরাঙ্গনাকে মুক্তিযোদ্ধার মর্যাদা দিয়ে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে।
এমএএস/বিএ