ভিডিও EN
  1. Home/
  2. বিশেষ প্রতিবেদন

লাঞ্ছনা বঞ্চনার অবসান ঘটলো বীরাঙ্গনা মাজেদার

প্রকাশিত: ১১:৪৮ এএম, ১৪ অক্টোবর ২০১৫

জীবনের শেষ প্রান্থে এসে মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পেয়ে খুশিতে আত্মহারা মহিয়সী বীরাঙ্গনা এক নারী। কিন্তু এখনও যেন তার দুঃখের শেষ নেই। লাঞ্ছনা বঞ্ছনারও যেন শেষ নেই তার। তার বড় মেয়ে সামছুন্নাহারকে ঘরছাড়া করেছে স্বামী। তার অপরাধ, সে পাক বাহিনীর পাশবিক নির্যাতনের শিকার মায়ের সন্তান। যুদ্ধশিশু হিসেবে তার পরিচয়।

শুধুতো তা-ই নয়, সরকারের তরফ থেকে সামান্য জমি পেয়েছিলেন এ বীরাঙ্গনা। কিন্তু সেটুকুরও দখল পাননা। জমিতে যেতে পারছেন না ভয়ে। দখলদার মারপিট করতে পারে এমন আশঙ্কায়। লোকলজ্জার ভয়ে এখনও ওই সময়কার অনেক কথাই কাউকে বলছেন না। এমনকি নিজের সন্তানদেরও। শেষ বয়সে এসে কাউকে আর তেমন কিছু বলতেও চাননা। মহিয়সী এ নারী হবিগঞ্জ জেলার মাধবপুর উপজেলার আদাঐর ইউনিয়নের সুলতানপুর গ্রামের মৃত আলাই মিয়ার স্ত্রী মাজেদা খাতুন।

বয়স এখন ষাটের কোঠায়। বাবার বাড়ি একই উপজেলার বেলঘর গ্রামে। বাবা আতাব মিয়া ছিলেন কৃষক। ৩ মেয়ে আর এক ছেলে নিয়েই তার সংসার। থাকেন স্বামীর বাড়িতে। সেখানে ভিটেবাড়ি ছাড়া আর তেমন কোন জমি নেই। একমাত্র ছেলে কামরুল হোসেন (৩৩) সবার ছোট। বড় মেয়ে সামছুন্নাহার। যার পরিচয় যুদ্ধশিশু। তাকে বিয়ে দিয়েছিলেন চুনারুঘাটে। বর্তমানে স্বামী পরিত্যক্তা হিসেবে মা-ভাইয়ের সংসারেই আছেন প্রায় ১২ বছর ধরে।

১৪ বছর সংসার করলেও তার কোনো সন্তান হয়নি। দ্বিতীয় মেয়ে নুরুন্নাহারকে বিয়ে দিয়েছেন মুকুন্দপুরে। আর তৃতীয় মেয়ে আসমা বেগম অর্চনাকে বিয়ে দিয়েছেন সিলেটে। তিনিও স্বামী নিয়ে পিত্রালয়েই থাকেন। স্বামী-স্ত্রী মিলে স্থানীয় একটি কোম্পানিতে শ্রমিকের কাজ করেন। একমাত্র ছেলে কামরুল সিএনজি অটোরিকশা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন।

বীরাঙ্গনা এ নারীর সন্ধানে তার বাড়িতে গেলে দেখা যায়, জেলার শেষ প্রান্তে অবস্থিত সুলতানপুর গ্রাম। পাশেই বি.বাড়িয়া জেলা। এ জেলার উপর দিয়েই যেতে হয় ওই গ্রামে। হবিগঞ্জ জেলা সদর থেকে যার দূরত্ব প্রায় ৫৫ কিলোমিটার। মঙ্গলবার দুপুরে তার বাড়িতে গিয়ে উল্লেখিত তথ্য পাওয়া যায়। এ সময় তিনি বাড়িতে ছিলেন না।

কিছুক্ষণ পর ফিরলেও কোনো কথাই বলতে চাননি তিনি। নিয়ে যান স্থানীয় ইউনিয়ন মুক্তিযোদ্ধা ইউনিট কমান্ডার ফরিদ উদ্দিন খানের বাড়িতে। তিনি তার দেবর হন। যার অক্লান্ত পরিশ্রম এবং অনুপ্রেরণায় পেয়েছে এ স্বীকৃতি। গ্রামের ভেতর দিয়ে পিচ্ছিল রাস্তা মাড়িয়ে নিয়ে যান তার বাড়িতে। পথে যেতে যেতে বললেন এ কথাগুলো তিনি কারও সামনে বলতে চাননা। এমনকি নিজের সন্তানদের সামনেও না। নিরব ওই বাড়িটিতে গিয়ে হরহর করে জীবনের সে দিনগুলোর স্মৃতিচারণ করেন।

অনেকটাই ভীত কন্ঠে বলতে থাকেন, ১৯৭১। মাত্র ১৪ বছর বয়স। তখনই তার বিয়ে হয় সুলতানপুর গ্রামের আলাই মিয়ার সঙ্গে। ইংরেজি মাসের নাম মনে নেই। তবে বাংলা মাঘ মাস ছিল। মাত্র দু’মাস পরই চৈত্র মাসে দেশে যুদ্ধ শুরু হয়। এর কয়েকদিনের মাথায় চাচা আজিজ মিয়া তাকে বাড়িতে নিয়ে যান। বলেন, আপাতত সেখানেই থাকতে। যুদ্ধের শুরু থেকেই পাক বাহিনী স্থানীয় জগদীশপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে ক্যাম্প স্থাপন করে। হানাদাররা মাঝে মাঝেই তাদের গ্রাম থেকে মোরগ ধরে নিয়ে যেতো। ভাদ্র মাসের মাঝামাঝি কোনো একদিন তিনি ও তার বাবা-চাচাসহ ৪ জনকে হায়েনারা ধরে নিয়ে যায়। ওই ক্যাম্পে নিয়ে আটকে রাখে। সেখানে গিয়ে দেখতে পান হিন্দু-মুসলিমসহ আরও অসংখ্য নারী-পুরুষকে এনে আটকে রাখা হয়েছে। ভারি কণ্ঠে তিনি বলেন, দুপুর গড়িয়ে যখন বিকেল। তখন পাক হায়েনারা আমার বাবা-চাচাকে খুন্তিু, কুদাল দিয়ে গর্ত খুড়তে বলে। তারা একটি বিশাল গর্ত খুড়ে দেন। পরে তারা নামাজ পড়তে চাইলে তাদের ছেড়ে দেয়। কিন্তু আমাকে সে গর্তে ঢুকিয়ে আটকে রাখে। আমাকে সেখানে রেখে পাশবিক নির্যাতন করা হয়। এতে আমি নিস্তেজ হয়ে পড়ি। শরীরের শক্তি হারিয়ে ফেলি। রক্তে ভিজে গেছে আমার গা, কাপড়-চোপড়। ৭/৮ দিন পর একজন পাঞ্জাবি তাদের দুষর সৈয়দ কায়ছারকে বলে সেতো মারা গেছে। কোথায় ফেলি। তখন তাদের দুষর সৈয়দ কায়ছার পার্শ্ববর্তী একটি শ্মশান দেখিয়ে সেখানে আমাকে ফেলে দিতে বলে। রাতে পাক বাহিনী আমাকে অচেতন অবস্থায় পাশের প্রাইমারি স্কুলের বারান্দায় রেখে আসে। ভোরে আজানের শব্দ শুনে জ্ঞান ফিরে আসে। কিন্তু ভয়ে কাঁপতে থাকেন। ভাবেন পাষণ্ডরা দেখে ফেলে কি-না। কেমন করে বাড়ি যাবেন। চুপিসারে নদীর কিনারা বেয়ে হামাগুড়ি দিয়ে বাড়ি পর্যন্ত যাই। আমার অবস্থা দেখে বাড়ির সবাই কাঁদতে থাকেন। চাচা স্থানীয় ছাতিয়াইন বাজারে নিয়ে আমাকে ডাক্তার দেখান। পরে শিমুলঘর গ্রামে আমার ফুফুর বাড়িতে রেখে আসেন। পাক বাহিনীর পাশবিক নির্যাতনের শিকার আমার গর্ভে সন্তান আসে। যুদ্ধের পরপরই জন্ম হয় আমার প্রথম সন্তান সামছুন্নাহারের। এরপর আমার স্বামী আর আমাকে নিতে চাননা। অনেক দুঃখ কষ্ট মনে নিয়ে পিত্রালয়ে থাকতে হয়েছে। প্রায় ৬ বছর চেষ্টার পর তিনি আমাকে নিতে রাজি হন। ২৪/২৫ বছর পূর্বে সামছুন্নাহারকে বিয়ে দিই। কিন্তু প্রায় ১০/১১ বছর পূর্বে যখন তার স্বামী জানতে পারে সে যুদ্ধশিশু তখনই তাকে ছেড়ে দেয়। সে থেকে মেয়েটি আমার সংসারেই আছে।

তিনি বলেন, এসব কথা কাউকে বলতে পারিনা। চাইওনা। ভয় হয়। লজ্জা হয়। ইদানিং টেলিভিশনে বীরাঙ্গনাদের মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পাওয়ার খবর দেখতে পেয়ে আমার দেবর স্থানীয় ইউনিয়ন মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার ফরিদ উদ্দিন খানের সঙ্গে বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলি। তিনি আমাকে অনুপ্রেরণা দেন। তিনিই চেষ্টা চালান আমার স্বীকৃতির জন্য। এখন স্বীকৃতি পাওয়ায় আমি অত্যন্তই আনন্দিত।

তিনি বলেন, সরকার আমাকে উপজেলা সদরের মিরনগরে ৮ শতাংশ জমি দেয়। জমিটুকু মাপ দিয়ে সীমানা দেয়া হয়। কিন্তু জমির পূর্বের দখলদার ওই গ্রামের জয়নাল মিয়া ওই সীমানা পিলার উপরে ফেলে জায়গা পুনরায় দখল করে নিয়েছে। আমি মহিলা মানুষ। জায়গার দখল নিতে গেলে সে মারপিট করতে পারে। ভয়ে সেখানে যাচ্ছিনা। এখন সরকারের কাছে আমার দাবি, ওই জায়গাটুকু যেন আমাকে দখল বুঝিয়ে দেয়া হয়।

এ ব্যাপারে আদাঐর ইউনিয়ন মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার ফরিদ উদ্দিন খানের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি অনেক চেষ্টা করে জেলা কমান্ডারের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাকে স্বীকৃতি পেতে সহায়তা করেছি। এখন আমার দাবি তার জায়গাটুকু যেন দখলমুক্ত করে দেয়া হয়। পাশাপাশি যুদ্ধশিশু মেয়েটির যেন একটা ব্যবস্থা করা হয়।

মাধবপুর উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা ইউনিটের ডেপুটি কমান্ডার আব্দুল মালেক মধু জানান, সে খুব সুন্দরী ছিল। যুদ্ধের সময় সে স্বামীর বাড়ি থেকে পিত্রালয়ে যায়। সেখান থেকে পাক বাহিনী তাকে ধরে নিয়ে নির্যাতন করে। তাদের শিকার হয়ে তার একটি মেয়ে জন্ম নিয়েছে।

এমএএস/পিআর

আরও পড়ুন