পরিস্থিতি কঠিন হলেও অনলাইনে মামলা চালানোর ডাটাবেজ নেই
করোনাভাইরাসে থমকে গেছে দেশ। প্রাণঘাতী এ ভাইরাসের বিস্তাররোধে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করেছে সরকার। ছুটির আওতায় রয়েছে দেশের সব আদালত। করোনা সংক্রমণের লাগাম টানতে ছুটি দফায় দফায় বেড়েই চলছে। এই পরিস্থিতি কবে স্বাভাবিক হবে সেটাও বলা যাচ্ছে না। এ অবস্থায় আইনজীবীদের মাঝে এক ধরনের দুশ্চিন্তা কাজ করছে। এমন অনেক আইনজীবী রয়েছেন যাদের আয় সীমিত। মাসের আয় মাসেই ফুরিয়ে যায়। তারা রয়েছেন সবচেয়ে বিপাকে।
দেশের এ পরিস্থিতিতে উন্নত বিশ্বের মতো অনলাইনে মামলা পরিচালনা করা কি সম্ভব? এ নিয়ে জাগো নিউজের সঙ্গে কথা বলেছেন বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী প্রশান্ত কুমার কর্মকার। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন নিজস্ব প্রতিবেদক জাহাঙ্গীর আলম।
জাগো নিউজ : করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে দীর্ঘদিন আদালত বন্ধ। কবে খুলবে, তা-ও বলা যাচ্ছে না। আদালত পাড়ায় না এসে কিভাবে দিন পার করছেন?
প্রশান্ত কুমার কর্মকার : একজন আইনজীবীর উপার্জনের একমাত্র উৎস আইন পেশা। এই আইন পেশার মধ্য দিয়েই একজন আইনজীবী বিচারপ্রার্থী মানুষকে সেবা দিয়ে থাকেন। করোনাভাইরাসের প্রার্দুভাব মোকাবেলার প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে আদালতের কার্যক্রম সীমিত করা হয়। পরে জামিন, অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞাসহ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে শুনানি ছাড়া বাকি কার্যক্রম মুলতবি রাখার নির্দেশ দেন প্রধান বিচারপতি বা সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন। জামিন বা নিষেধাজ্ঞার মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও সাধারণ বিচারপ্রার্থীরা যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হন, সেজন্য নতুন করে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন।
আসলে করোনা ভাইরাস সংক্রমণ বৃদ্ধি পাওয়ায় সাধারণ ছুটির কারণে দেশ এখন কার্যত লকডাউনে আছে। আমরা যত দ্রুত এই সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ বা প্রতিরোধ করতে পারবো, তার ওপর নির্ভর করছে কখন আদালত খুলবে, কত দিনে এই বন্দি দশা থেকে মুক্তি পাবো। শুধু আইন-আদালত নয়, রাষ্ট্রের সব অর্গানই তো বর্তমানে স্থবির হয়ে পড়েছে।
জাগো নিউজ : দীর্ঘদিন আদালত বন্ধ থাকায় অনেক আইনজীবী অসহায় হয়ে পড়েছেন, তাদের নিয়ে কী ভাবছেন?
প্রশান্ত কুমার কর্মকার : সেই ২৬ মার্চ থেকে আদালতের কার্যক্রম সরকারি ঘোষণায় বন্ধ আছে। তারও আগে আদালতের কার্যক্রম সীমিত ও মুলতবি করা হয়েছিল। তখন থেকে আইন অঙ্গনে বিচ্ছিন্নভাবে নবীন আইনজীবীদের বিষয়ে কিছু করার দাবি উঠেছিল। সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি ও ঢাকা আইনজীবী সমিতির সভাপতি-সম্পাদকের সঙ্গে আমার কথা হয়েছিল। সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি এ এম আমিন উদ্দিন সাহেব বলেছিলেন, সাধারণ ফান্ড গঠন করে তা থেকে ঋণ কার্যক্রম চালু করার। যা পরিবেশ স্বাভাবিক হলে ওই আইনজীবী তার সুবিধা মতো পরিশোধ করে দেবেন। সমিতির বেনাভোলেন্ট ফান্ডে হাত দেয়ার সুযোগ কম। কেননা তাতে হাউজের অনুমোদন প্রয়োজন হবে। আমরা শুধু নবীনের কথা বলছি, অনেক প্রবীণ আইনজীবীরও সমস্যা রয়েছে। তবে ঢাকা আইনজীবী সমিতির কাছ থেকে আশানুরূপ কোনো কথা শুনিনি। যারা আইনজীবীদের নেতৃত্ব দিচ্ছেন তাদের বলবো, এই দুঃসময়ে আপনারা এগিয়ে আসুন। নবীন-প্রবীণ কোনো আইনজীবীকেই যেন অন্য কারও কাছে সহায়তার জন্য হাত বাড়াতে না হয়। ব্যক্তিগত উদ্যোগে হাজার হাজার আইনজীবীর জন্য কিছু করার সুযোগ কম।
জাগো নিউজ : দীর্ঘ দিন আদালত বন্ধ, মামলা-মোকদ্দমার শুনানি হচ্ছে না। এতে করে মামলার জটও দিন দিন বাড়ছে। এই অবস্থায় উন্নত বিশ্বের মতো বাংলাদেশে কি অনলাইন বিচার কার্যক্রম পরিচালনা করা সম্ভব?
প্রশান্ত কুমার কর্মকার : দেখুন আদালত বন্ধ, অফিস আদালত চলছে না। শুধুমাত্র ফৌজদারি আদালত বিশেষ ব্যবস্থায় চলছে। দেওয়ানি বিষয়ক সকল আদালতের কার্যক্রম পুরোপরি বন্ধ রয়েছে। অনেকেই সমস্যার মধ্যে রয়েছেন। পুলিশ জনগণের নিরাপত্তার পাশাপাশি তাদের দৈনন্দিন স্বাভাবিক কাজকর্ম সীমিত আকারে অব্যাহত রেখেছে। বিশেষ ব্যবস্থায় চালু রাখা আদালতগুলো লঘু অপরাধে ধৃত আসামিদের নিজ জিম্মায় মুক্তি দিয়ে দিচ্ছেন। সিভিল আদালত বিশেষ ব্যবস্থায় খোলা না থাকায় অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে শুনানির সুযোগ নেই। সেসব আদালতে জামিন বিষয়ে শুনানির সুযোগও নেই। আবার উন্নত বিশ্বের মতো অনলাইন বিচার ব্যবস্থা চালু করার সুযোগও কম। কেননা, আমাদের অনলাইনে মামলা-মোকদ্দমা পরিচালনা করার মতো ডাটাবেজ নেই। অনেকের মধ্যে পেশাগত সততার অভাব রয়েছে। তাই কোনো গুরুত্বপূর্ণ মামলায় কোনো আসামি জামিনে বেরিয়ে গেলে তর্ক-বির্তক শুরু হয়ে যাবে। দীর্ঘদিন এভাবে আদালত বন্ধ থাকলে বিচার ব্যবস্থা ভেঙে পড়বে। অপরাধের প্রবণতা এখন হয়তো কম, কিন্ত তা বাড়তে কতক্ষণ! তাই সীমিত পরিসরে সপ্তাহে একদিন আদালত চালু করা যেতে পারে। বাস্তবতার নিরিখে এই সময়ে বিচার সংশ্লিষ্ট ডাটা সংগ্রহ করা সম্ভব নয়, তাই অনলাইন বিচার ব্যবস্থা চালু করার সুযোগ কম।
জাগো নিউজ : এই বন্ধে আইনজীবীদের উপার্জন নেই। অধিকাংশ আইনজীবী ভাড়া বাসায় থাকেন। তারা কিভাবে বাড়িভাড়া পরিশোধ করবেন?
প্রশান্ত কুমার কর্মকার : আইনজীবীসহ যে কোনো পেশাজীবীর উর্পাজনের বড় অংশ বাড়িভাড়ায় চলে যায়। না খেয়ে কেউ মারা যাবেন না হয়তো। কিন্তু বাড়িভাড়া না দেয়ার কারণে এই দুঃসময়ে অনেকেই ঘরছাড়া হবেন। কিংবা বড় ধরনের ঋণে জড়িয়ে যাবেন। তাই শুধু কমিউনিটিভিত্তিক নয়, ব্যাংকগুলোতে সহজশর্তে ঋণ দেয়ার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। তা না হলে, শুধু আইনজীবী নন, সাধারণ পেশার মানুষও বড় বিপদে পড়ে যাবেন। বাড়িভাড়া মওকুফ করার বিষয়টি কিভাবে নিশ্চিত করা যায় সেটা চিন্তা করতে হবে। সরকার বাড়িওয়ালাদের জন্য বিশেষ প্রণোদনা দেয়ার ঘোষণা দিতে পারে, যেমন হোল্ডিং ট্যাক্স মওকুফ। এতে বাড়ির মালিকের লাভ শতভাগ নিশ্চিত। এভাবে ভাড়াটিয়ার ভাড়া মওকুফের বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। তবেই উদ্দেশ্য সফল হবে।
জাগো নিউজ : এই পরিস্থিতিতে সবার জন্য আপনার পরামর্শ কী?
প্রশান্ত কুমার কর্মকার : করোনা সংক্রমণের বিস্তার যত তাড়াতাড়ি প্রতিরোধ করা সম্ভব, তত সবার জন্য স্বস্তির। তাহলেই আইন-আদালত খুলবে। তাই আসুন সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখি, কোয়ারেন্টাইনে থেকে নিজে সুস্থ থাকি, অন্যকে সুস্থ থাকতে সহায়তা করি। সবাই ভালো থাকুন, সুস্থ ও সুন্দর থাকুন। আসছে নতুন বছরের শুভেচ্ছা রইলো। ধুয়ে মুছে যাক যত পাপ তাপ। পুরাতনের কাছ থেকে নেয়া শিক্ষাকে যেন ভুলে না যাই।
জেএ/এইচএ/এমএস