ভিডিও EN
  1. Home/
  2. বিশেষ প্রতিবেদন

দেশের কথা না-ই ভাবুন, আপনার পরিবারকে অন্তত বাঁচান

আবু আজাদ | চট্টগ্রাম | প্রকাশিত: ১১:৩৯ এএম, ১৯ মার্চ ২০২০

ইতালি থেকে গত ৫ মার্চ দেশে ফিরে সাজেক ঘুরার উদ্দেশ্যে ১৫ মার্চ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে (চবি) আসেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা উপজেলার দস্তগীর হোসাইন মাহফুজ। সঙ্গে নিয়ে আসেন আরও তিনজনকে। অথচ নিয়ম অনুযায়ী মাহফুজের ওই সময় হোম কোয়ারেন্টাইনে (নিজ বাড়িতে বিশেষ ব্যবস্থায়) থাকার কথা।

বিষয়টি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের নজরে আসে। গত রোববার (১৫ মার্চ) গভীর রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের আব্দুর রব হল থেকে তাদের উদ্ধার করা হয়।

স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের পরিসংখ্যান বলছে, করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার পর দেশের বিভিন্ন বিমানবন্দর ও সীমান্ত এলাকা দিয়ে প্রায় পাঁচ লাখ মানুষ প্রবেশ করেছেন। তাদের মধ্যে করোনাদুর্গত ছয়টি দেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন এলাকা থেকে বিমানবন্দর ব্যবহার করে দেশে প্রবেশ করেছেন ৯৪ হাজার জন। এর মধ্যে প্রায় দুই হাজার ৪০০ জনকে হোম কোয়ারেন্টাইন দেয়া হয়।

কিন্তু সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অধিকাংশ প্রবাসী দেশে ফিরে মানছেন না হোম কোয়ারেন্টাইনের নিয়মকানুন। এতেই দেশে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি বাড়ছে। কারণ বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত শনাক্ত হওয়া করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ১৪ জনের মধ্যে আটজনই বিদেশফেরত, বাকিরা তাদের সংস্পর্শে আসার পর ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন।

jagonews24

এছাড়া প্রথমবারের মতো করোনায় আক্রান্ত হয়ে বয়স্ক এক ব্যক্তি মারা গেছেন। সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) পরিচালক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা বুধবার গণমাধ্যমকে বিষয়টি জানান। বিশ্বের ১৭২টি দেশ ও অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়া এ ভাইরাসে প্রাণ গেছে ৮ হাজারের বেশি মানুষের। আক্রান্তের সংখ্যা দুই লাখ ছাড়িয়েছে।

এদিকে চট্টগ্রামের পরিস্থিতি জানাতে গিয়ে শাহ আমানত বিমানবন্দরের ম্যানেজার উইং কমান্ডার সারোয়ার-ই আলম জাগো নিউজকে বলেন, ‘গত এক মাসে করোনাদুর্গত ছয়টি দেশের মধ্যে ইতালি থেকে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক প্রবাসী চট্টগ্রামে এসেছেন। এর বাইরে অধিকাংশ যাত্রী এসেছেন সৌদি আরব, কাতার, ওমান ও বাহারাইন থেকে। কয়েকজন যাত্রী ছিলেন যারা দক্ষিণ কোরিয়া ও মালয়েশিয়া থেকে দেশে ফিরেছেন। বিমানবন্দরেই তাদের স্ক্রিনিং হয়েছে। এছাড়া তাদের সমস্ত ডাটা স্বাস্থ্য বিভাগের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।’

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিমানমবন্দরগুলোতে বিদেশফেরত যাত্রীদের প্রাথমিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর কোনো ধরনের লক্ষণ না থাকলেও অন্তত ১৪ দিন হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকার নিশ্চয়তায় প্রায় আড়াই হাজার মানুষকে ছেড়ে দেয়া হয়। ভয়টা তাদের নিয়েই। তারা হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকার আশ্বাস দিয়ে বিমানবন্দর থেকে বাড়ি ফিরলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা মানা হচ্ছে না। অনেককে বাজারে, ঘরের বাইরে, সভা-সমিতি, এমনকি বনভোজনেও যেতে দেখা যাচ্ছে। হোম কোয়ারেন্টাইনে না থাকায় বেশ কয়েকজনকে জরিমানাও করা হয়েছে

তবে বিদেশফেরত অনেকেই বলছেন, বাড়ি যাবার পর তাদের কাছে কোনো স্বাস্থ্যকর্মী বা প্রশাসনিক কোনো কর্মকর্তা যোগাযোগ করেননি।

চট্টগ্রাম সিভিল সার্জন কার্যালয়ের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে জাগো নিউজকে বলেন, প্রতিনিয়ত ঝুঁকি বাড়িয়ে চলেছেন প্রবাসফেরতরা। সরকারের জাতীয় রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের নির্দেশনা অনুযায়ী তাদের হোম কোয়ারেন্টাইনে পাঠানো হচ্ছে। কিন্তু আমরা খোঁজখবর নিয়ে যা জেনেছি, প্রবাসীদের অধিকাংশই সেসব নির্দেশনা মানছেন না।

jagonews24

তিনি জানান, চট্টগ্রাম নগরের হালিশহর এলাকায় বেশ কয়েকজন ইতালিফেরত প্রবাসীর বিষয়ে খবর পাওয়া গেছে যে, তারা হোম কোয়ারেন্টাইন মানছেন না। পরে বিষয়টি মহল্লার সর্দারদের জানানো হয়। কিন্তু তাদের কথাও অমান্য করছেন প্রবাসীরা। তা-ই ঝুঁকির কথা বিবেচনা করে বিশেষজ্ঞরা প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইনের প্রতি গুরুত্ব দিচ্ছেন।

গেল বছর ডিসেম্বরের শেষদিকে চীনের উহান থেকে সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে মরণঘাতি করোনাভাইরাস। সেসময় চীনের পরিস্তিতি নিজ চোখে দেখেছেন চীনের হুবেই প্রদেশের জিংমেন শহরের জিংচু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী টুম্পা প্রামাণিক। নিজের সে অভিজ্ঞতার কথা জাগো নিউজকে জানান। বলেন, ‘চীনে প্রথম দিকে যখন করোনাভাইরাস ছড়াচ্ছিল, তখন অনেকেই বিষয়টিকে পাত্তা দেননি। হোম কোয়ারেন্টাইনের কথা বলা হলেও মানেননি। কিন্তু এসব কারণে দ্রুতই অবস্থার অবনতি ঘটে, পরে ২৪ জানুয়ারি উহান লগডাউন করতে বাধ্য হয় চীন সরকার। যদি উহান আর তিন-চারদিন আগে বন্ধ করা যেত, হয়ত বিশ্ব এটা থেকে রক্ষা পেত।’

লগডাউনের পরে হোম কোয়ারেন্টাইন শতভাগ মানার কারণেই চীনের পরিস্তিতির উন্নতি ঘটেছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘প্রযুক্তি ও সার্ভিলেন্সের সাপোর্ট থাকার কারণে চীন এত দ্রুত পরিস্থিতি সামলে নিয়েছে, বাংলাদেশে যা কল্পনাও করা যাবে না। উহান লকডাউনের পরই পুরো চীন সচেতন হয়, তখন আমরা সবাই শতভাগ হোম কোয়ারেন্টাইন মেন্টেইন করি।’

প্রবাসীদের সচেতনতার প্রতি জোর দিয়ে তিনি আরও বলেন, ‘চীনে যখন করোনার মহামারি, ভাইরাসের গতি-প্রকৃতি অনেক কিছুই অজানা। তখনও প্রায় ৬ থেকে ৮ হাজার বাংলাদেশি শিক্ষার্থী চীন ছেড়ে বাংলাদেশ এসেছেন, কিন্তু কোনো ইনফেকশন ছড়ায়নি। অথচ ইতালি থেকে ৫০০ জনও আসল না, এরই মধ্যে ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ল! কারণ অসচেতনতা।’

‘ইনফরমেশন ফ্লো অত্যন্ত ফাস্ট হওয়াতে চীন থেকে আসা সবাই আপডেটেড ইনফরমেশন জানত এবং সে অনুযায়ী নিজে সচেতন ছিল। সেই সাথে চীনের প্রিভেন্টিভ মেজারগুলো তো আছেই। দেশে সরকারি বাধ্যবাধকতা না থাকলেও অধিকাংশ শিক্ষার্থীই নিজেকে কিছুটা আইসোলেট রেখেছিলেন আর সিম্পটমের প্রতি খেয়াল রেখেছিলেন।’ এখন প্রায় করোনামুক্ত হয়ে চীন বাংলাদেশসহ বিশ্বের অন্য দেশের প্রতি সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে

এ বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন শেখ ফজলে রাব্বী মিয়া বলেন, ‘চট্টগ্রামের হোম কোয়ারেন্টাইন তদারকিতে একটি শক্তিশালী কমিটি কাজ করছে। এতে জেলা প্রশাসক, স্বাস্থ্য বিভাগ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও আছে। বিমানবন্দর থেকে প্রবাসফেরত যাত্রীদের তালিকা স্থানীয় প্রশাসন ও ডিজিএফআইকে সরবরাহ করা হচ্ছে। তারাই হোম কোয়ারেন্টাইনের বিষয়টি তদারকি করছেন। প্রবাসীরা যদি নিয়মকানুন না মানেন তাহলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখা যাবে না। তা-ই নিয়ম অমান্যকারীকে ফৌজদারি সাজাসহ বাধ্যতামূলক কোয়ারেন্টাইন করানো হবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইনের জন্য আমরা নগরের দুটি হোটেল ব্যবহারের চিন্তা-ভাবনা করছি। হোটেল দুটি হলো- স্টেশন রোডের মোটেল সৈকত এবং চকবাজার এলাকার স্টার পার্ক। চট্টগ্রাম রেলওয়ে হাসপাতালকেও প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে। এছাড়া করোনায় আক্রান্ত রোগীদের রাখা হবে আইসোলেশন ওয়ার্ডে। চট্টগ্রামের বিভিন্ন হাসপাতালে মোট ৩৫০টি বেড সে লক্ষ্যে তৈরি করা আছে।’

শিশু রোগ বিশেষজ্ঞ ডা. শহিদুল্লাহ জাগো নিউজকে বলেন, ‘হোম কোয়ারেন্টাইনে না থেকে প্রবাসীরা সবার প্রথমে নিজের পরিবারকেই ঝুঁকিতে ফেলছেন। সেই পরিবারের সদস্যরা পাড়া বা মহল্লার মানুষদের সঙ্গে মিশে পুরো দেশকে ঝুঁকির মুখে ঠেলে দিচ্ছেন। অনেকে আবার বলছেন, আমি সুস্থ। আমি তাদের বলব, দেশের কথা না ভাবুন, আপনার পরিবারকে আগে বাঁচান।’

তিনি আরও বলেন, ‘হোম কোয়ারেন্টাইনের নিয়ম ভালোভাবে পালন করতে হবে। প্রবাসফেরত ব্যক্তিকে অবশ্যই ১৪ দিন তার পরিবার, সমাজ থেকে আলাদা একটি কক্ষে অবস্থান করতে হবে। পরিবারের সদস্যদের মধ্যে যে ব্যক্তি তাকে খাবার বা প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি সরবরাহ করবেন, তাকে অন্তত এক মিটার দূরত্বে থেকে এ কাজ করতে হবে এবং ফিরে আসার সঙ্গে সঙ্গে হাত-পা সাবান দিয়ে ভালো করে ধুয়ে ফেলতে হবে। সেবাদানকারী পার্সোনাল প্রটেকশন না নিলে তারাও আক্রান্ত হতে পারেন।’

jagonews24

চট্টগ্রাম সিভিল সার্জন কার্যালয়ের মেডিকেল অফিসার ডা. মোহাম্মদ নুরুল হায়দার (রোগ নিয়ন্ত্রণ) জাগো নিউজকে বলেন, ‘বাংলাদেশে চীনের মতো লক ডাউন করা যাবে না। তাই এ পরিস্থিতিতে আমাদের সামাজিকভাবে সচেতন হতে হবে। অনেক প্রবাসী দেশে ফিরেছেন, যাদের তথ্য হয়তো সরকারের কাছে নাই। কিন্তু প্রতিটি এলাকার মানুষ একটু খোঁজখবর নিলেই জানতে পারবেন, তার এলাকায় কে বিদেশ থেকে ফিরেছেন। এক্ষেত্রে এলাকাবাসী যদি ওই ব্যক্তিকে বলেন বা অনুরোধ জানান তাহলে হয়তো সামাজিক কারণে হলেও তিনি বিষয়টি মানবেন। এছাড়া সবার আগে পরিবারের মানুষদের সচেতন হতে হবে। কারণ তারাই সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে আছেন। আমাদের সবার উচিত সম্মিলিতভাবে বিদেশফেরত ব্যক্তিদের হোম কোয়ারেন্টাইন যাতে শতভাগ হয় তা নিশ্চিত করা।’

হোম কোয়ারেন্টাইনে স্বাস্থ্য বিভাগের নির্দেশনা

১. হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকা ব্যক্তিবর্গ ১৪ দিন ঘরের বাইরে বের হবেন না এবং নিজ বাড়ির নির্ধারিত একটি কক্ষে অবস্থান করবেন।

২. পরিবারের অন্যান্য সদস্য দেশে প্রত্যাগত সদস্যের হোম কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিত করবেন। তবে কোনোভাবে ওই ঘরে প্রবেশ করা যাবে না। খাবার বা প্রয়োজনীয় জিনিস দরজায় রাখবেন।

৩. কোয়ারেন্টাইনকৃত ব্যক্তির আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব উক্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে আসতে পারবেন না।

৪. সম্ভব হলে কোয়ারেন্টাইনকৃত ব্যক্তিকে আলাদা টয়লেট ব্যবহার করতে হবে।

৫. খুব জরুরি কারণে যদি কারও সঙ্গে কথা বলা বা দেখা করার প্রয়োজন হয় তাহলে হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকা ব্যক্তিকে সাক্ষাৎকারীর সঙ্গে অন্তত ১ মিটার দূরত্ব বজায় রাখতে হবে।

৬. কোয়ারেন্টাইনকৃত ব্যক্তি নিজের কাপড়, তোয়ালে, গামছা, নিজেই পরিষ্কার করবেন। নিজের বিছানা আলাদা রাখবেন।

৭. যথাসম্ভব সাক্ষাৎ এড়িয়ে চলুন, এমনকি পরিবারের সদস্যদের সঙ্গেও।

৮. সবসময় মাস্ক পরে থাকুন।

৯. ঘন ঘন হাত ধুয়ে ফেলুন। যেসব জায়গায় বারবার স্পর্শের সম্ভাবনা আছে, সেগুলো দিনশেষে ভালো করে জীবাণুনাশক দিয়ে মুছে ফেলুন। যেমন- দরজার হাতল, কম্পিউটার, ফোন, টয়লেট ইত্যাদি।

১০. যদি হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকা ব্যক্তি বাসার বাইরে যান তবে অন্যদের দায়িত্ব সেই ব্যক্তিকে হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়া।

আবু আজাদ/এমএআর/এমকেএইচ