মিন্নি-মিজান-মোয়াজ্জেম ইস্যুতে সরগরম বিচারাঙ্গন
দেশের বিচারাঙ্গনের ইতিহাসে ঘটনাবহুল বছর ২০১৯ সাল। এ বছর এমন সব ঘটনা সুপ্রিম কোর্টে ঘটেছে যা ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। বালিশকাণ্ড, রিফাত হত্যার ঘটনায় তার স্ত্রী মিন্নির জামিন আবেদন, ডিআইজি মিজানের জামিন আবেদন, ফেনীর নুসরাতের ভিডিও ভাইরাল করে জামিন নিতে আসা ওসি মোয়াজ্জেমের আবেদন এবং আপিল বিভাগে মানবতাবিরোধী অপরাধে এ টি এম আজহারুল ইসলামের বিরুদ্ধে আদেশ ঘিরে সবার নজর ছিল সর্বোচ্চ আদালতের দিকে। সর্বশেষ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপুর নাম রাজাকারের তালিকায় আসার ঘটনাও ছিল দেশবাসীর আগ্রহ-আলোচনার কেন্দ্রে।
২০১৯-এর বিদায়ের লগ্নে ফিরে দেখা যাক সর্বোচ্চ আদালতের আলোচিত যত ঘটনা।
মিন্নির জামিন হাইকোর্টে, মিডিয়ার সঙ্গে আলাপে নিষেধাজ্ঞা
গত ২৬ জুন সকালে বরগুনা সরকারি কলেজের সামনে রিফাত শরীফকে তার স্ত্রী আয়শা সিদ্দিকা মিন্নির সামনে প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। সেই ঘটনার ভিডিও ফেসবুকে ভাইরাল হলে দেশে ব্যাপক তোলপাড় সৃষ্টি হয়। পরে রিফাতের বাবা আবদুল হালিম শরীফ বাদী হয়ে ১২ জনের নাম উল্লেখ করে মামলা করেন। এতে প্রধান সাক্ষী করা হয় রিফাত শরীফের স্ত্রী আয়শা সিদ্দিকা মিন্নিকে। কিন্তু মামলার ১৮ দিন পর ১৩ জুলাই এ হত্যাকাণ্ডে মিন্নি জড়িত দাবি করে সংবাদ সম্মেলন করেন আবদুল হালিম। পরে এ মামলায় গ্রেফতার করা হয় মিন্নিকে।
২১ জুলাই বরগুনার জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম মো. সিরাজুল ইসলাম গাজীর আদালতে মিন্নি জামিন আবেদন করলে তা নামঞ্জুর হয়। এরপর ৩০ জুলাই বরগুনা জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক মো. আছাদুজ্জামানও মিন্নির জামিন নামঞ্জুর করে আদেশ দেন। মিন্নির জামিনের বিষয়টি হাইকোর্টে আসে। এর পরিপ্রেক্ষিতে মিন্নির জামিন কেন দেয়া হবে না তা জানতে চেয়ে ২০ আগস্ট রুল জারি করেন আদালত।
ওই রুলের শুনানি শেষে ২৯ আগস্ট দুই শর্তে মিন্নিকে জামিন দেন হাইকোর্ট। শর্ত দুটি হলো- মিন্নি গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলতে পারবেন না এবং তাকে তার বাবার জিম্মায় থাকতে হবে।
এদিকে, গত ২ জুলাই এ মামলার প্রধান আসামি সাব্বির আহম্মেদ ওরফে নয়ন বন্ড পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হন। বহুল আলোচিত এ হত্যা মামলার প্রাপ্তবয়স্ক ১০ আসামির বিরুদ্ধে চার্জ গঠনের আদেশের জন্য ১ জানুয়ারি দিন ধার্য করা হয়েছে।
জামিন না দিয়ে ডিআইজি মিজানকে পুলিশে দিলেন হাইকোর্ট
নারী নির্যাতন, ঘুষ প্রদান, অবৈধ সম্পদ অর্জনসহ নানা অপকর্মের অভিযোগে দুই বছর ধরে ডিআইজি মিজানুর রহমানের নাম সংবাদমাধ্যমের আলোচনায় ছিল। ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার থাকাকালে বিয়ে গোপন করতে নিজের ক্ষমতার অপব্যবহার করে স্ত্রীকে গ্রেফতার করানোর অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে। এছাড়া এক সংবাদ পাঠিকাকে প্রাণনাশের হুমকি ও উত্ত্যক্ত করার অভিযোগে মিজানুরের বিরুদ্ধে বিমানবন্দর থানায় সাধারণ ডায়েরিও (জিডি) হয়। নারী নির্যাতনের অভিযোগে গত জানুয়ারির শুরুর দিকে তাকে প্রত্যাহার করে পুলিশ সদরদফতরে সংযুক্ত করা হয়। শেষপর্যায়ে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কর্মকর্তার সঙ্গে ঘুষ লেনদেনের বিষয়টি সামনে এলে ২৫ জুন মিজানুরকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। তার আগের দিন ২৪ জুন সম্পদের তথ্য গোপন ও অবৈধভাবে সম্পদ অর্জনের অভিযোগে মিজানুরের বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক। মামলায় মিজানুর রহমান, তার স্ত্রী সোহেলিয়া আনার রত্না, ছোট ভাই মাহবুবুর রহমান ও ভাগনে পুলিশের কোতোয়ালি থানার এসআই মো. মাহমুদুল হাসানকে আসামি করা হয়।
মামলার পরিপ্রেক্ষিতে ১ জুলাই হাইকোর্টে আগাম জামিনের জন্য যান মিজান। কিন্তু জামিন আবেদন নামঞ্জুর করে আদালত তাকে গ্রেফতারের নির্দেশ দেন। তখন হাইকোর্ট পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে শাহবাগ থানায় হস্তান্তর করে। পরদিন ডিআইজি মিজানের জামিনের আবেদন নামঞ্জুর করে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালত। দুদকের ওই মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য আগামী ৫ জানুয়ারি দিন ধার্য করেছেন আদালত।
ওসি মোয়াজ্জেমের জামিন আবেদন নামঞ্জুর
গত ২৭ মার্চ ফেনীর সোনাগাজীর মাদরাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফিকে শ্রেণিকক্ষে নিয়ে যৌন নিপীড়ন করেন অধ্যক্ষ সিরাজউদ্দৌলা। এমন অভিযোগ উঠলে দু’জনকে থানায় নিয়ে যান তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোয়াজ্জেম হোসেন। এ সময় ওসি নিয়ম ভেঙে নুসরাতকে জেরা করেন এবং তার বর্ণনার ভিডিও ধারণ করেন।
মৌখিক অভিযোগ নেয়ার সময় দুই পুরুষের কণ্ঠ শোনা গেলেও সেখানে নুসরাত ছাড়া অন্য কোনো নারী বা তার আইনজীবী ছিলেন না। ভিডিওটি প্রকাশ হলে অধ্যক্ষ ও তার সহযোগীদের সঙ্গে ওসির সখ্য থাকার বিষয়টি স্পষ্ট হয়।
এর মধ্যে অধ্যক্ষকে গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠানো হয়। কারাগারে থাকা অধ্যক্ষ সিরাজের নির্দেশে তার অনুসারীরা ৬ এপ্রিল নুসরাতকে মাদরাসার ছাদে ডেকে নিয়ে গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়। দগ্ধ নুসরাত চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। ওই ঘটনায় হত্যা মামলা হয়। মামলায় অধ্যক্ষ সিরাজউদ্দৌলাসহ ১৬ আসামির ফাঁসির আদেশ দেন আদালতে।
সেই ভিডিও ছড়ানোয় ১৫ এপ্রিল ওসি মোয়াজ্জেম হোসেনের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করেন ব্যারিস্টার সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন। ২৭ মে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার রীমা সুলতানার পক্ষে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলার প্রতিবেদন জমা দেয় পিবিআই। সেটি গ্রহণ করে বাংলাদেশ সাইবার ট্রাইব্যুনাল গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন ওসি মোয়াজ্জেমের বিরুদ্ধে।
গ্রেফতারি পরোয়ানা নিয়ে ১৬ জুন গোপনে হাইকোর্টে আগাম জামিনের আবেদন করেন ওসি মোয়াজ্জেম। আদালত পরদিন অর্থাৎ ১৭ জুন আবেদনটি শুনানির জন্য রাখলেও ১৬ জুন সুপ্রিম কোর্ট এলাকা থেকে মোয়াজ্জেমকে গ্রেফতার করে শাহবাগ থানা পুলিশ। ১৭ জুন তাকে সাইবার ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হলে ওই দিন আদালত মোয়াজ্জেমের জামিন আবেদন খারিজ করে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন।
এরপর ৩ নভেম্বর ওসি মোয়াজ্জেম হাইকোর্টে জামিন আবেদন করলে তা নামঞ্জুর করে ওই মামলা ৪০ কার্যদিবসে নিষ্পত্তি করার নির্দেশ দেন আদালত।
বিচার প্রক্রিয়ার পর ২৮ নভেম্বর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের দুটি ধারায় ওসি মোয়াজ্জেমকে আট বছর কারাদণ্ড দেন বাংলাদেশ সাইবার ট্রাইব্যুনালের বিচারক মোহাম্মদ আস-শামস জগলুল হোসেন। দেশে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলার প্রথম রায় ছিল এটি।
রাজাকার তালিকা থেকে নাম বাদ দিতে ৩ মন্ত্রণালয়ে টিপুর চিঠি
মহান স্বাধীনতাযুদ্ধের ৪৮ বছর পর অনেক ঢাক-ঢোল পিটিয়ে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় রাজাকারের তালিকা প্রকাশ করে ১৫ ডিসেম্বর। কিন্তু এতে অনেক মুক্তিযোদ্ধার মতো আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর বর্ষীয়ান আইনজীবী অ্যাডভোকেট গোলাম আরিফ টিপুর নামও দেখা যায়।
এ নিয়ে বিক্ষুব্ধ টিপু ১৮ ডিসেম্বর সংবাদ সম্মেলন করেন। পরে তিনি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠান। যেখানে ভুল সংশোধন করে প্রজ্ঞাপন জারি করে গণমাধ্যমে প্রচার ও প্রকাশ করার দাবি জানান তিনি।
টিপুকে ২০১০ সালের ২৮ মার্চ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর নিয়োগ দেয়া হয়।
আজহারের মৃত্যুদণ্ডাদেশ আপিলেও বহাল
একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় সংঘটিত হত্যা, গণহত্যা, নির্যাতনসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ২০১৪ সালের ৩০ ডিসেম্বর জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এ টি এম আজহারুল ইসলামকে মৃত্যুদণ্ড দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেন তিনি। গত ৩১ অক্টোবর মৃত্যুদণ্ডের আদেশ বহাল রাখেন আপিল বিভাগ। নিয়ম অনুযায়ী, আপিল বিভাগের রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ করতে পারবেন আজহার। রিভিউ খারিজ হলে শেষ সুযোগ হিসেবে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চাওয়ার সুযোগ পাবেন তিনি।
এফএইচ/এইচএ/এমকেএইচ