বিজেপির সামনে দাঁড়ানোর মতো কোনো দল এখন নেই
আলতাফ পারভেজ। দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক ইতিহাসের গবেষক। বিশ্লেষণ করছেন, লিখছেন আন্তর্জাতিক নানা প্রসঙ্গ নিয়ে। ভারতের নাগরিকপঞ্জি আইন এবং এ আইন ঘিরে ঘটনাপ্রবাহের খবর রাখছেন, বিশ্লেষণ করছেন নিয়মিত।
ভারত প্রসঙ্গ নিয়ে সম্প্রতি মুখোমুখি হন জাগো নিউজ-এর। দীর্ঘ আলোচনায় ভারতের রাজনীতি এবং বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের বিষয়েও আলোকপাত করেন। বলেন, বর্তমান ভারতে বিজেপির যে উত্থান, তা আপাতত ঠেকাতে পারবে না সমসাময়িক আন্দোলন। তবে এ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ভারতে নতুন রাজনৈতিক দলের ক্ষুধা তৈরি হয়েছে।
‘ভারতের বর্তমান পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের প্রস্তুতিরও ঘাটতি আছে ‘- এমন মন্তব্য করে তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের সীমানা এ মুহূর্তে প্রচণ্ড বিপদের মধ্যে আছে। মিয়ানমার সীমান্তে চরম উত্তেজনা দেশটি প্রচণ্ডভাবে ‘বাংলাদেশি-বিদ্বেষ’ অবস্থানে আছে। আসামে ১৯ লাখ মানুষ নাগরিকহারা। বলা হচ্ছে, তারা বাংলাদেশি এবং আসামেও প্রচণ্ড রকমের বাংলাদেশবিরোধী মনোভাব আছে। বাংলাদেশ হাইকমিশনের গাড়ি ভাঙার মধ্য দিয়ে কিন্তু বিশেষ লক্ষণ আমরা বুঝতে পারলাম। তার মানে, এ সীমানায় টেনশন বাড়িয়ে দিল। পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে আমাদের দীর্ঘ সীমানা। সেখানেও উত্তেজনা। খবরে আসছে, এ সীমানা দিয়ে ভারতীয়রা বাংলাদেশে প্রবেশ করছে। তার মানে, বাংলাদেশের সব সীমান্তেরই এখন উত্তেজনা।
তিন পর্বের সাক্ষাৎকারের আজ থাকছে শেষটি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সায়েম সাবু।
জাগো নিউজ : বাংলাদেশ সরকার শুরু থেকে বলছে, নাগরিকপঞ্জি ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়। আবার দুই মন্ত্রীর সফরও বাতিল করল। এমন স্ববিরোধী অবস্থানে...
আলতাফ পারভেজ : আসামে বাংলাদেশ নিয়ে বিজেপি প্রতিনিয়ত রাজনীতি করছে। অমিত শাহ রোজ বাংলাদেশ বিষয় টেনে কথা বলছেন। বাংলাদেশের হাইকমিশনের গাড়ি ভাঙচুর হলো। তার মানে, বাংলাদেশ নিয়েই তো কিছু একটা হচ্ছে। আপনি চাইলেও এড়িয়ে যেতে পারবেন না। জবাব দিতে হবে।
নাগরিকপঞ্জি ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয় এটি সবাই জানে। কিন্তু নাগরিকপঞ্জির সঙ্গে তো বিজেপি বাংলাদেশের বিষয় বানিয়ে ফেলেছে। ক্যাবের মধ্যে বাংলাদেশ শব্দটি আছে। কারণ ক্যাবের কারণে যারা আবেদন করবেন, তাদের স্বীকার করতে হবে যে, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, আফগানিস্তান থেকে তারা ধর্মীয় নিপীড়নের কারণে গিয়েছেন।
বাংলাদেশ-কে এভাবে বিষয় করার পরও যদি আপনি বলেন যে, এটি ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়, তাহলে আপনি মূলে গিয়ে বুঝতে পারছেন না। এটি স্ববিরোধী অবস্থান।
জাগো নিউজ : স্ববিরোধী এ অবস্থান বাংলাদেশের জন্য কী বার্তা দিচ্ছে?
আলতাফ পারভেজ : বড় বিপদ ডেকে আনবে। বাংলাদেশ বলছে, আমাদের বিষয় নয়। ভারত বলছে, বাংলাদেশের নাগরিক এসেছে অবৈধভাবে। এটি খোলামেলা আলোচনার বিষয় বলে মনে করি। নির্মোহ ও বুদ্ধিমত্তা দিয়ে সবাই মিলে বিষয়টির মোকাবিলা করা উচিত। বাংলাদেশ খুবই ছোট দেশ। বাংলাদেশ সরকারের একার পক্ষে এটি মোকাবিলা করা সম্ভব নয়।
জাগো নিউজ : শেখ হাসিনার সরকার এককভাবে ভারত-কে যেভাবে গুরুত্ব দিয়ে আসছে, সেখানে সবাই মিলে মোকাবিলা করবে- এমনটি কি প্রত্যাশা করা যায়?
আলতাফ পারভেজ : সময় ও বাস্তবতার নিরিখে এমন কিছু ইস্যু সামনে এসে যায়, যখন দলীয় মতের বাইরে জাতীয় ঐক্যের প্রয়োজন পড়ে। রোহিঙ্গা ইস্যুতে তো গোটা বিশ্ব আলোচনা করছে। ভারতের বিষয়টি দলীয়ভাবে দেখলে সমাধান আসবে না।
জাগো নিউজ : কিন্তু অনেকেই তো মনে করেন, ভারত ভাবনা মানেই আওয়ামী লীগের ভাবনা। অন্তত কংগ্রেস-বিজেপি সরকারের সঙ্গে আওয়ামী লীগের গাঁটছড়া সম্পর্ক প্রশ্নে...
আলতাফ পারভেজ : এটি একটি ভুল ধারণা বলে মনে করি। এককভাবে এ পরিস্থিতি মোকাবিলা বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে কোনোভাবেই সম্ভব নয়। গোটা দেশ মিলে একটি অবস্থান তৈরি করতে হবে। নইলে বাংলাদেশ আরও দুর্বল হয়ে যাবে এবং ভারত সেই সুযোগটা কাজে লাগাবে।
জাগো নিউজ : বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে ভারতবিরোধী মনোভাব বাড়ছে বলে অনেকেই মনে করেন। বর্তমান পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে দূরত্ব আরও বাড়ল কি-না?
আলতাফ পারভেজ : নাগরিকপঞ্জির মধ্য দিয়ে ভারতের নীতিনির্ধারকরা খুব অন্যায়ভাবে তথ্যপ্রমাণ ছাড়া বাংলাদেশ-কে দুষছেন। বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি নিয়ে অনেক ভুল তথ্য ছড়াচ্ছেন। তারা কোনো তথ্য উপস্থাপন না করেই এমন করছেন।
ভারতের অনেকেই বাংলাদেশ-কে তুলে ধরেন যে, সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি খুবই খারাপ। অথচ, তারা কোনো তথ্য তুলে ধরতে পারেন না। ভারতের মানুষের মধ্যে একধরনের ভুল ধারণা দিয়ে আসছে ওরা।
জাগো নিউজ : বিতর্ক থাকলেও গত দুই জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে একতরফাভাবে সমর্থন দিয়েছে ভারত, এমন আলোচনাও আছে। ভারতে অস্থিরতা বাড়লে বাংলাদেশের রাজনীতিতে কী প্রভাব পড়তে পারে?
আলতাফ পারভেজ : এনআরসি ও ক্যাব আলোচনায় আমি বাংলাদেশের রাজনীতির প্রসঙ্গ টানতে চাই না। ভারতে যারাই ক্ষমতায় আসুক, তারা বাংলাদেশ প্রশ্নে নীতিগত বড় পরিবর্তন আনবেন, তা মনে করি না। মূলত ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক নির্ধারণ করেন ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, ব্যবসায়ী ও আমলারা। তাদের অবস্থানে কোনো পরিবর্তন আসবে বলে মনে করি না।
বরং বাংলাদেশ কীভাবে চাইবে তার ওপর অনেক কিছু নির্ভর করে। ভারত একটি বড় দেশ। তারা আগ্রাসী অর্থনীতির যুদ্ধে সবাইকে বশে আনতে চাইবে।
জাগো নিউজ : রাষ্ট্র হিসেবে ভারত কোথায় যাচ্ছে?
আলতাফ পারভেজ : ভারতের বহুত্ববাদী চরিত্র আর থাকছে না। নাগরিকত্ব আইনটাই ভারতের সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। নাগরিকপুঞ্জি আইনে ভারত ক্ষতিগ্রস্ত, কিন্তু লাভবান হচ্ছে বিজেপি।
জাগো নিউজ : এ লাভের হিসাব কতদিন?
আলতাফ পারভেজ : বিজেপির জন্য চ্যালেঞ্জ হচ্ছে অর্থনীতি। তারা যদি অর্থনীতি ম্যানেজ করতে পারে, তাহলে আপাতত বিজেপির সামনে দাঁড়ানোর মতো কোনো রাজনৈতিক দল থাকছে না।
জাগো নিউজ : কিন্তু সর্বশেষ ফলাফল?
আলতাফ পারভেজ : অনেক দূর, অনুমান করা কঠিন। একটি উগ্রবাদী সংগঠন যখন ক্ষমতায় আসে, তখন সে ধ্বংসাত্মক চরিত্র নিয়েই আসে। বিজেপির কারণে ভারতের সমাজে বড় ক্ষতি হয়ে যাবে। প্রতিষ্ঠানগুলো ভেঙে যাবে। আন্তঃসম্প্রদায়ের সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হবে। পৃথিবীর ইতিহাস তা-ই বলে।
মূলত বিজেপি অর্থনীতি সামলাতে পারছে না বলেই ধর্মকে সামনে আনতে হচ্ছে।
জাগো নিউজ : আঞ্চলিক প্রশ্নে ভারতের সম্প্রসারণবাদ নীতিও আছে। এ নীতির কী হবে?
আলতাফ পারভেজ : ভারতে পুঁজিবাদী সংগঠনগুলো প্রচুর বিনিয়োগ করছে। বাইরে থেকেও আসছে। বৈশ্বিক শক্তি অর্জনের খায়েশও আছে ভারতের। ভারত চায় নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য দেশগুলোর মতো শক্তি অর্জন করতে।
কিন্তু সেই শক্তি অর্জন করতে হলে পাশের দেশগুলোর ওপর খবরদারি দেখাতে হয়। ভারতের দিক থেকে এ সম্প্রসারণবাদ দোষের কিছু নয়। প্রশ্ন হচ্ছে, ভারতের পাশের দেশগুলো কীভাবে দেখছে। পাশের দেশগুলো যদি গণতান্ত্রিক ধারায় শক্তিশালী হয়, তাহলে ভারতের চাওয়া-পাওয়ার ওপর কিছুই নির্ভর করবে না। যুক্তরাষ্ট্রের পাশে কিউবা। কিউবা তো পাত্তা দেয় না যুক্তরাষ্ট্র-কে। আবার মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশই যুক্তরাষ্ট্র-কে মুরুব্বি মানে।
তবে দক্ষিণ এশিয়ার খারাপ দিক হচ্ছে, দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা (সার্ক) কাজ করছে না। এটি বিপদের কথা। দ্বিপক্ষীয়ভাবে ভারত-কে মোকাবিলা করতে হয়। সার্ক নিষ্ক্রিয় করে ভারত এ প্রশ্নে সফল বলে মনে করি।
জাগো নিউজ : কাশ্মীর আলোচনা আড়ালে পড়ে গেল কি-না?
আলতাফ পারভেজ : কাশ্মীর যে কত খারাপ অবস্থার মধ্যে আছে, তা বলা মুশকিল। পৃথিবীর সবচেয়ে দুর্বিষহ এলাকা বলা হয় গাজা-কে। কিন্তু আমার মনে হয়, কাশ্মীর এখন সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় আছে। কাশ্মীর সম্পর্কে হয়তো ভারতের মানুষও জানে না।
ব্রিটেন ও আমেরিকায় মধ্যপন্থীরা ক্ষমতায় এলে কাশ্মীর পরিস্থিতির পরিবর্তন হতে পারত। তা হলো না। আন্তর্জাতিক মহলে আর আলোচনা নেই। ওআইসি বা মুসলিম দেশগুলোও ভূমিকা রাখতে পারছে না।
আমি আপাতত কাশ্মীর ইস্যুতে আশার আলো দেখতে পাচ্ছি না।
এএসএস/এমএআর/এমএস