ভিডিও EN
  1. Home/
  2. বিশেষ প্রতিবেদন

কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে মামলা পরিচালনায় বিমানের লাভ কী?

রফিক মজুমদার | প্রকাশিত: ০৩:৩২ পিএম, ২৫ নভেম্বর ২০১৯

>> ৮ বছরে মামলা পরিচালনায় আইনজীবীদের দেয়া হয়েছে ১৫ কোটি
>> অধিকাংশ মামলায় হার হয়েছে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের
>> একটি একটি করে সব অনিয়ম দূর করা হবে : জিয়াউদ্দিন আহমেদ

বিভিন্ন সময় নানা কারণে মামলার মুখোমুখি হতে হয় বাংলাদেশি পতাকাবাহী একমাত্র সরকারি এয়ারলাইন্স ‘বিমান বাংলাদেশ’-কে। মামলার পেছনে ব্যয় হয় কোটি কোটি টাকা। কিন্তু দেখা যায় অধিকাংশ মামলায় হেরে যায় সংস্থাটি।

সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, গত আট বছরে বিমানের পক্ষে বিভিন্ন মামলা পরিচালনায় আইনজীবীদের পেছনে ব্যয় হয়েছে ১৫ কোটি টাকার ওপর। সঠিকভাবে মামলা পরিচালনা না করা এবং এক্ষেত্রে দুর্নীতি ও অনিয়মের মাধ্যমে অর্থ হাতিয়ে নেয়ার উদ্দেশ্য কাজ করায় অধিকাংশ মামলায় হেরে যাচ্ছে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স। প্রশ্ন উঠেছে, তাহলে মামলা পরিচালনায় বিপুল অংকের এ অর্থ ব্যয় কেন?

জানা গেছে, মামলা পরিচালনায় বিমানের মনোনীত প্যানেল থাকে। তাদের দিয়ে মামলা চালানো হয়। নির্দিষ্ট এসব আইনজীবীকে নির্ধারিত অর্থ প্রদান করা হয় বিমানের লিগ্যাল শাখার মাধ্যমে। এ শাখায় বিমানের জনবল ছিল তিনজন। ইতোমধ্যে অনিয়মের অভিযোগে একজনকে বিমান ফ্লাইট ক্যাটারিং সেন্টারে (বিএফসিসি) বদলি করা হয়েছে। দীর্ঘদিন লিগ্যাল শাখার প্রধান হিসেবে দায়িত্বে থাকা উপ-মহাব্যবস্থাপককে অনিয়মের কারণে শোকজ করা হয়েছে।

অনিয়মের প্রসঙ্গে বিমান প্রশাসন বলছে, বিমানের নিজস্ব প্যানেলের বাইরের আইনজীবীদের নামে হিসাব শাখা থেকে কোটি কোটি টাকা তোলা হয়েছে। এসব টাকা সংশ্লিষ্টদের কাছে পৌঁছায় কি-না এবং কী পরিমাণ অর্থ এ খাতে ব্যয় হয়েছে তা খতিয়ে দেখবে প্রশাসন।

biman

বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের হিসাব শাখা সূত্রে জানা গেছে, অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমের (কোড নং- ১০৯২২২) নামে গত আট বছরে বিমানের হিসাব থেকে উত্তোলন করা হয়েছে এক কোটি ৮৮ লাখ ৫০ হাজার টাকা। বিমানের ক্যাশ রেজিস্টার বুকের ২৭৮নং পৃষ্ঠার বিবরণে দেখা গেছে, চলতি বছরের এপ্রিল মাসের ৩ তারিখ অ্যাটর্নি জেনারেলের নামে উত্তোলন করা হয়েছে আট লাখ ৭৫ হাজার টাকা। ২০১৮ সালের আগস্ট মাসের ৭ তারিখ তোলা হয়েছে চার লাখ টাকা। একই বছরের মার্চ মাসের ২৭ তারিখ তোলা হয়েছে পাঁচ লাখ ২৫ হাজার টাকা। ২০১৭ সালের ২০ আগস্ট তোলা হয়েছে তিন লাখ টাকা। একই বছরের ৯ জুলাই তোলা হয়েছে ১১ লাখ টাকা।

রেজিস্টারের ২৭৬নং পৃষ্ঠার বিবরণে উল্লেখ রয়েছে, ২০১৭ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি তোলা হয়েছে এক লাখ টাকা। ২০১৬ সালের ১৭ জুলাই তোলা হয়েছে এক লাখ ৪০ হাজার টাকা। একই বছরের ১৮ এপ্রিল তোলা হয়েছে চার লাখ টাকা। ৩ ফেব্রুয়ারি তোলা হয়েছে এক লাখ ২৫ হাজার টাকা। ২ আগস্ট তোলা হয়েছে এক লাখ টাকা। ২২ জুলাই তোলা হয়েছে সাত লাখ ৫০ হাজার টাকা। একই মাসের ১৩ তারিখ তোলা হয়েছে আরও তিন লাখ টাকা। ২০১৩ সালের ২০ এপ্রিল তোলা হয়েছে তিন লাখ ২০ হাজার টাকা। এর পাঁচদিন আগে অর্থাৎ ১৫ এপ্রিল তোলা হয়েছে ১৪ লাখ ৭০ হাজার টাকা।

২০১৪ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর অ্যাটর্নি জেনারেলের নামে তোলা হয় পাঁচ লাখ ৭৫ হাজার টাকা। জুলাই মাসের ২১ তারিখ তোলা হয় তিন লাখ টাকা। একই বছরের মে মাসের ১৪ তারিখ তোলা হয় চার লাখ ৫০ হাজার টাকা। ২০১৪ সালের ৬ মার্চ অ্যাটর্নি জেনারেলের নামে তোলা হয় সাত লাখ ৫০ হাজার টাকা। একই বছরের ২১ জানুয়ারি তোলা হয় চার লাখ ৫০ হাজার টাকা। ২০১৩ সালের ৭ সেপ্টেম্বর তোলা হয় সাত লাখ ৫০ হাজার টাকা। একই বছরের ৫ আগস্ট তোলা হয় আট লাখ ৫০ হাজার টাকা। ২২ মে তোলা হয় ৮০ হাজার টাকা। একই তারিখে তোলা হয় আরও দুই লাখ ৪০ হাজার টাকা। ২৮ মার্চ তোলা হয় তিন লাখ ২০ হাজার টাকা।

রেজিস্টার বুকের ২৭৪নং পৃষ্ঠার হিসাব বিবরণ থেকে জানা যায়, ২০১২ সালের ৮ সেপ্টেম্বর অ্যাটর্নি জেনারেলের নামে তোলা হয় আরও ১০ লাখ ৫০ হাজার টাকা। রেজিস্টার বুকের ২৭২নং পৃষ্ঠার হিসাব বিবরণী থেকে জানা যায়, ২০১২ সালের ১৪ আগস্ট তোলা হয় তিন লাখ টাকা। একই বছরের জানুয়ারি মাসের ২ তারিখ এক লাখ ৫০ হাজার টাকা তোলা হয়। ২০১১ সালের ৩ নভেম্বর ৩০ হাজার টাকা, ২০১১ সালের ২১ সেপ্টেম্বর তোলা হয় ছয় লাখ টাকা। জুন মাসের ১৩ তারিখ তোলা হয় দুই লাখ টাকা। মার্চ মাসের ১৬ তারিখ তোলা হয় চার লাখ টাকা। একই বছরের ফেব্রুয়ারি মাসের ২ তারিখ তোলা হয় আরও চার লাখ টাকা। ২০১১ সালের ১ জানুয়ারি তোলা হয় এক লাখ ৫০ হাজার টাকা। ২০১০ সালের নভেম্বর মাসের 8 তারিখ তোলা হয় দুই লাখ টাকা। সেপ্টেম্বর মাসের ২৯ তারিখ তোলা হয় আরও এক লাখ টাকা।

একইভাবে প্যানেলভুক্ত আইনজীবী এ এম আমিন উদ্দিনকে প্রদান করা হয় ৫৬ লাখ টাকার ওপর। কোটি টাকার ওপর প্রদান করা হয় অনেক আইনজীবীকে। আবার প্যানেলবহির্ভূত বেশকিছু আইনজীবীকে অর্থ প্রদান করার প্রমাণ পাওয়া গেছে।

আইনজীবী মেজবাহুর রহমান ছিলেন বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের পরিচালনা পর্ষদ সদস্য। মামলা পরিচালনার পারিশ্রমিক হিসেবে তাকেও দেয়া হয়েছে ৬৬ লাখ ৩৬ হাজার টাকা।

এক বছর ধরে বিমানে চলছে অনিয়ম ও দুর্নীতিবিরোধী অভিযান। অভিযান শুরু হওয়ার পর থেকে মামলা পরিচালনার জন্য হিসাব শাখা থেকে কোনো অর্থ উত্তোলন করা হয়নি বলেও সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।

biman

কোটি কোটি টাকা খরচ হলেও অধিকাংশ মামলায় বিমান হেরেছে। তাহলে কেন এত অর্থ ব্যয়- এমন প্রশ্নের জবাবে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের পরিচালক (প্রশাসন) জিয়াউদ্দিন আহমেদ বলেন, আমরা বিমানের সব বিভাগে ইতিবাচক পরিবর্তনে অঙ্গীকারবদ্ধ। একটি একটি করে সব অনিয়ম দূর করা হবে। ইতোমধ্যে অনেক বিভাগে পরিবর্তন লক্ষণীয়।

তিনি বলেন, ফাইন্যান্স বিভাগের অনিয়ম খতিয়ে দেখা হবে। প্রয়োজন হলে তদন্ত করে প্রকৃত ঘটনা উদঘাটন করা হবে। অপরাধ করলে কাউকে ছাড় দেয়া হবে না।

জানা গেছে, বিমানের তালিকাভুক্ত আইনজীবীর সংখ্যা ২৪ জনের মতো। ২০১০ সাল থেকে এসব আইনজীবীর নামে বিমানের হিসাব থেকে কোটি কোটি টাকা তোলা হয়। তালিকাভুক্ত বা বিমানের প্যানেল আইনজীবীর বাইরেও কিছু ব্যক্তির নামে এসব অর্থ তোলা হয়।

বিমানের হিসাব শাখা সূত্রে জানা গেছে, গত আট বছরে বিমানের পক্ষে বিভিন্ন মামলা পরিচালনায় আইনজীবীদের দেয়া হয়েছে ১৫ কোটি টাকার ওপর। যদিও স্বেচ্ছায় অবসর কর্মসূচির (ভিআরএস) আটটিসহ খুব কম মামলায়ই বিমান জিতেছে।

সম্প্রতি মামলা খাতে কোটি কোটি টাকা প্রদান করায় আইন শাখার উপ-মহাব্যবস্থাপককে শোকজ করা হয়েছে। দুর্নীতি ও অনিয়মের সঙ্গে জড়িত সন্দেহে এ শাখার একজনকে অন্যত্র বদলিও করা হয়েছে।

এ বিষয়ে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের লিগ্যাল শাখার উপ-মহাব্যবস্থাপক আজরা নাসরিনের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি কোনো কথা বলতে রাজি হননি।

প্রসঙ্গত, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে স্বেচ্ছা অবসর কর্মসূচিতে (ভিআরএস) ছাঁটাই হওয়া কর্মীদের নিয়ে সে সময় সংকটে পড়ে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স। এ সংক্রান্ত মোট আটটি মামলাও দায়ের করেন বিমানের সংশ্লিষ্ট কর্মীরা।

চাকরির মেয়াদ ২৫ বছর পূর্ণ হয়নি, এমন কর্মীদের ২০০৭ সালে ভিআরএসের মাধ্যমে অবসর প্রদানকে অবৈধ ঘোষণা করেন হাইকোর্ট। একই সঙ্গে এসব কর্মীর চাকরি বহাল আছে মর্মে রায় দেন আদালত। বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী ও বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেনের সমন্বয়ে গঠিত তৎকালীন হাইকোর্ট বেঞ্চ ২০১২ সালের ৮ মে এ রায় দেন।

জানা গেছে, চাকরির মেয়াদ ২৫ বছরের কম, ভিআরএসের নামে চাকরি হারিয়েছেন এমন কর্মীর সংখ্যা ছিল ৪৩২ জন। চাকরি বিধিমালার ১১ (১) ধারা অনুযায়ী, ২৫ বছর পূর্ণ না হলে চাকরি থেকে অবসর নেয়া বা বাদ দেয়া যায় না। কিন্তু এ বিধিমালা লঙ্ঘন করে তাদের জোরপূর্বক চাকরি থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়, যা আদালতে বিমানের বিপক্ষে যায়। কিন্তু আদালতের আদেশের বিপক্ষে গিয়ে ৬০৮ জনের মধ্যে মাত্র ১৬০ জনকে নিয়োগ দেয়া হয়। এরপর আদালত অবমাননার অভিযোগে বিমান কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আটটি আবেদন করেন ১৫০ কর্মী। পরে ওইসব কর্মীর পক্ষে আদালতের রায় আসে।

আরএম/এমএআর/জেআইএম

আরও পড়ুন