ভিডিও EN
  1. Home/
  2. বিশেষ প্রতিবেদন

ইউজিসির কাঠগড়ায় ১৪ ভিসি

মুরাদ হুসাইন | প্রকাশিত: ১০:১৭ পিএম, ২২ সেপ্টেম্বর ২০১৯

দেশের ১৪ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের (ভিসি) বিরুদ্ধে পাওয়া অনিয়মের তদন্ত করছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)। তাদের মধ্যে দুজন সাবেক ভিসিও রয়েছেন। নিয়োগ বাণিজ্য, অর্থ আত্মসাৎ ও অনিয়মের মাধ্যমে পদোন্নতি-পদায়নসহ বিভিন্ন অভিযোগ রয়েছে ভিসিদের বিরুদ্ধে।

ভিন্ন ভিন্ন তদন্ত কমিটি গঠন করে ভিসিদের অনিয়ম তদন্ত করা হয়েছে। বেশ কয়েকটি তদন্ত কাজ শেষে প্রতিবেদন তৈরি করা হচ্ছে। ভিসিদের অনিয়ম কর্মকাণ্ডের ফল হিসেবে বর্তমানে তিন বিশ্ববিদ্যালয়ে অস্থিরতা বিরাজ করছে।

সূত্র জানায়, সম্প্রতি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সবচেয়ে বড় বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) উপাচার্যকে নিয়ে। উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ নিয়ে ছাত্রলীগ নেতাদের আর্থিক সুবিধা দেয়ার অভিযোগ উঠেছে জাবি উপাচার্য অধ্যাপক ফারজানা ইসলামের বিরুদ্ধে। ওই ঘটনায় বেশ কয়েক দিন ধরে আন্দোলন চলছে বিশ্ববিদ্যালয়ে। অনিয়ম তদন্তে ‘বিচার বিভাগীয় তদন্ত’ দাবি করে সময় বেঁধে দিয়েছেন শিক্ষার্থীরা। বিচার বিভাগীয় তদন্ত না করায় উপাচার্য অধ্যাপক ফারজানা ইসলামের পদত্যাগও দাবি করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের একাংশ। উপাচার্যের উন্নয়ন প্রকল্পের অর্থ ছাত্রলীগকে দেয়া নিয়ে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের শীর্ষ দুই নেতাকে পদও হারাতে হয়েছে

ভিসিদের অনিয়মের তদন্ত হচ্ছে যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ে

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে সাময়িক দায়িত্ব পান অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান। দায়িত্ব গ্রহণের পর কোটা সংস্কার আন্দোলন ও ডাকসু নির্বাচনসহ বিভিন্ন ইস্যুতে দ্বিচারিতা ও উস্কানিমূলক মন্তব্য করে বিতর্ক সৃষ্টি করেন উপাচার্য আখতারুজ্জামান। সর্বশেষ [ডাকসু নির্বাচনে ছাত্রত্ব না থাকা ছাত্রলীগ নেতাদের অনিয়মের মাধ্যমে ভর্তি করার অভিযোগ উঠেছে খোদ উপাচার্যের বিরুদ্ধে। এ ঘটনায় উপাচার্যের পদত্যাগ দাবিতে আন্দোলনে নেমেছেন শিক্ষার্থীদের একাংশ।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (বশেমুরবিপ্রবি) বিতর্কিত উপাচার্য অধ্যাপক ড. খোন্দকার নাসির উদ্দিনের পদত্যাগ দাবিতে উত্তাল ক্যাম্পাস। গত ১৯ সেপ্টেম্বর থেকে আন্দোলনে নামেন শিক্ষার্থীরা।

জানা গেছে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেয়া স্ট্যাটাস ও ব্যক্তিগত আলাপ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রী ফাতেমা তুজ জিনিয়াকে বহিষ্কার করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। পরে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার দফতরের এক বিজ্ঞপ্তিতে জিনিয়ার বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করা হয়। শুধু তা-ই নয়, বশেমুরবিপ্রবির উপাচার্যের বিরুদ্ধে শিক্ষক ও কর্মকর্তা নিয়োগে বাণিজ্যের অভিযোগ রয়েছে। অভিযোগ খতিয়ে দেখতে তদন্ত কাজ শুরু করেছে ইউজিসি।

মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

ভর্তি পরীক্ষা পরিচালনার জন্য তিনবার সম্মানী নিয়েছেন টাঙ্গাইলে অবস্থিত মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (মাভাবিপ্রবি) উপাচার্য মো. আলাউদ্দিন। কেবল অতিরিক্ত সম্মানী নেয়া নয়, শিক্ষকদের পদোন্নতি, কর্মকর্তা নিয়োগসহ বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় নিয়মকানুনের চেয়ে ব্যক্তিগত ইচ্ছা-অনিচ্ছাই প্রধান করে দেখেন তিনি- এমন অভিযোগও পাওয়া গেছে।

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. হারুন-অর-রশিদের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরে নিয়োগ বাণিজ্য, জমি ক্রয়ে অর্থ আত্মসাৎসহ বিভিন্ন অভিযোগ রয়েছে। এসব অভিযোগ খতিয়ে দেখতে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে বলে জানা গেছে। তার বিরুদ্ধে বাড়ি কেনাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে অনিয়মের ব্যাপারে খোদ সরকারি অডিট দল আপত্তি তুলেছে। এর মধ্যে ধানমন্ডিতে কেনা বাড়ির ভেতরের রাস্তা দুবার কেনার অভিযোগও আছে। বিষয়টি ইউজিসি তদন্ত করছে।

পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (প্রাবিপ্রবি) উপাচার্য অধ্যাপক ড. এম রোস্তম আলী নিয়মনীতি ভঙ্গ করে স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ে তার আপন ভাগ্নেসহ ২২ জন নিকটাত্মীয়কে চাকরি দিয়েছেন। ভিসি প্রশাসনিক ভবনের অবকাঠামো নির্মাণে ঠিকাদারদের কাছ থেকে অধিক হারে অর্থ আদায়ের চেষ্টা করেন বলেও অভিযোগ আছে। ফলে চলতি বছরের জুন মাসের মধ্যে কাজ শেষ করার কথা থাকলেও ঠিকাদার তা করছেন না। নির্ধারিত সময়ে প্রশাসনিক ভবনের কাজও এ কারণে শেষ হয়নি।

বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়

বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহর বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় অভিযোগ, তিনি বছরের অধিকাংশ সময়ই বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে অবস্থান করেন না। যদিও তার নিয়োগের অন্যতম শর্তই ছিল ক্যাম্পাসে সার্বক্ষণিক অবস্থান। গত বছরের ২৯৫ দিনই তিনি ক্যাম্পাসে অনুপস্থিত ছিলেন। ২০১৭ সালে ক্যাম্পাসের বাইরে ছিলেন ১৩১ দিন। চলতি বছরেও তার বিশ্ববিদ্যালয়ে উপস্থিতির হার খুবই কম। এছাড়া ভর্তি পরীক্ষায় জালিয়াতি, ইউজিসির নির্দেশনা অমান্য করে জনবল নিয়োগ, শিক্ষক ও জনবল নিয়োগে দুর্নীতি ও অনিয়ম, সভাপতি হয়েও নিয়োগ বোর্ডে অনুপস্থিত থাকা, অবৈধভাবে গাড়ি বিলাসিতা, অর্গানোগ্রাম লঙ্ঘন করে নিয়োগ, নিয়ম ভেঙে সিটিং অ্যালাউন্স গ্রহণ, ইচ্ছামতো পদোন্নতি প্রদান, আইন ভেঙে নিয়োগসহ বিভিন্ন কমিটি গঠন, একাধিক প্রশাসনিক পদ দখল, স্বজনপ্রীতি, ক্রয় নীতিমালা লঙ্ঘন ও বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন কার্যক্রমে আর্থিক অনিয়মসহ নানা বিষয়ে বিতর্ক সৃষ্টি করেছেন উপাচার্য নিজেই।

বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়

চলতি বছরের শুরুর দিকে শিক্ষার্থীদের ‘রাজাকারের বাচ্চা’ বলে বিতর্কের সৃষ্টি করেন বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য এস এম ইমামুল হক। ঘটনার প্রতিবাদে উপাচার্যের পদত্যাগ দাবিতে আন্দোলনে নামেন শিক্ষার্থীরা। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয় ক্যাম্পাস। পরে শিক্ষার্থীদের লাগাতার আন্দোলনের মুখে উপাচার্যকে ছুটিতে পাঠানো হয়। ছুটিতে থাকা অবস্থায় তার মেয়াদ শেষ হয়।

এর আগে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক হারুন অর রশীদের বিরুদ্ধে অর্থ কেলেঙ্কারির অভিযোগ আনা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাব থেকে অর্থ সরিয়ে নিয়মবহির্ভূতভাবে নিজের নামে নিয়ে একটি ট্রাস্ট ভবন নির্মাণ করেন। শুধু তা-ই নয়, তিনি অবসরে যাওয়ার পর এ সংক্রান্ত সব ফাইলপত্র নিয়ে যান।

ইউজিসি সূত্র জানিয়েছে, সাবেক উপাচার্যের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ খতিয়ে দেখা হচ্ছে। তবে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র না থাকায় তদন্ত কাজ বিঘ্নিত হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তার সঙ্গে যোগাযোগ করলেও তিনি তা ফেরত দেননি।

ইউজিসির কর্মকর্তারা জানান, তদন্ত কাজ শেষ। বর্তমানে প্রতিবেদন লেখার কাজ চলছে। তবে ওই উপাচার্যের পক্ষ থেকে তদবির চালানোর অভিযোগ রয়েছে।

এছাড়া শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাকৃবি) উপাচার্য অধ্যাপক ড. কামাল উদ্দিন আহমেদের বিরুদ্ধে নিয়োগ বাণিজ্য, হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (হাবিপ্রবি) উপাচার্য অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ আবুল কাশেমের বিরুদ্ধে নিয়োগ বাণিজ্যের অভিযোগ, একই অভিযোগ নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (নোবিপ্রবি) উপাচার্য অহিদুজ্জামান, ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি হিসেবে অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ আহসান উল্লাহর বিরুদ্ধে নৈতিক স্খলনের অভিযোগ খতিয়ে দেখছে ইউজিসি।

ভিসিদের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগের বিষয়ে ইউজিসি চেয়ারম্যান অধ্যাপক কাজী শহীদুল্লাহ বলেন, বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিদের বিরুদ্ধে অভিযোগের তদন্ত চলছে। আমাদের কাজ কেবল তদন্ত শেষে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ ও প্রতিবেদন পাঠানো। আমরা তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারি না। তবে এটা ঠিক, দুর্নীতি ও অনিয়ম প্রমাণিত হলে অপসারণই শেষ পদক্ষেপ নয়, অপরাধীদের বিরুদ্ধে অন্য পদক্ষেপও নেয়া উচিত।

তিনি আরও বলেন, চিহ্নিত দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা যে নেয়া হয় না তা নয়, জনগণ যে দ্রুততার সঙ্গে আশা করে সেটা হয়তো হয় না। আমাদের বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা রয়েছে বলে অনেক কাজ ধীরগতিতে হলেও তা সম্পন্ন করা হচ্ছে।

এমএইচএম/এএইচ/এমএস