ভিডিও EN
  1. Home/
  2. বিশেষ প্রতিবেদন

রোহিঙ্গাদের ক্ষোভ কাজে লাগিয়ে তাদের সশস্ত্র করছে জামায়াত

সায়েম সাবু | প্রকাশিত: ০৮:০৭ পিএম, ১১ সেপ্টেম্বর ২০১৯

শাহরিয়ার কবির। সাংবাদিক, কলামিস্ট, প্রামাণ্যচিত্র নির্মাতা। একজন খ্যাতনামা শিশুসাহিত্যিক হিসেবেও পরিচিত তিনি। বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির বিরুদ্ধে সোচ্চার ভূমিকা পালন করছেন দীর্ঘদিন ধরে। ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির নির্বাহী সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

সাংবাদিকতা ও গবেষণার স্বার্থে কাশ্মীরে গেছেন বহুবার। লিখছেন, কাশ্মীরের সংগ্রাম-রাজনীতি, ইতিহাস-ঐতিহ্য নিয়ে। সম্প্রতি কাশ্মীর, আসাম, রোহিঙ্গা প্রসঙ্গ নিয়ে মুখোমুখি হন জাগো নিউজ’র। দীর্ঘ সাক্ষাৎকারে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের পাশাপাশি নিজস্ব মতামতও ব্যক্ত করেন। বলেন, কাশ্মীরের মানুষের তিনটি অবস্থান। কেউ ভারতের সঙ্গে থাকতে চান। কেউ পাকিস্তানে যুক্ত হতে চান। আবার কেউ চান স্বাধীন হতে। ‘কাশ্মীরের উন্নয়নে ৩৭০ ধারা বাতিল জরুরি ছিল’ বলেও মত দেন।

আসাম ইস্যু নিয়ে তিনি বলেন, ‘ইন্দিরা-মুজিব চুক্তিকে সম্মান করতে হবে। ইন্দিরা-মুজিব চুক্তির বাইরে একজন বাঙালিকেও যদি পুশইন করে ভারত, তাহলে বিপর্যয় ডেকে আনবে।’ তিন পর্বের সাক্ষাৎকারের আজ থাকছে শেষটি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সায়েম সাবু

জাগো নিউজ : আসামে ১৯ লাখ মানুষ রাষ্ট্রহীন। আসাম পরিস্থিতি কীভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন?

শাহরিয়ার কবির : মুসলমান বাঙালিরা বাংলাদেশ থেকে আসাম গেছে, এটি প্রমাণ করতে না পারলে আমরা একজনকেও গ্রহণ করব না। ইন্দিরা-মুজিব চুক্তির পর যদি কেউ ভারতে যায়, তবে সে অবশ্যই সে দেশের অবৈধ নাগরিক। তাদের গ্রহণ করতে আপত্তি নেই। ২০০১ সালের পর ৫০ হাজারের মতো বাংলাদেশি ভারতে গেছে। তাদের সঙ্গে যোগাযোগ আছে আমার। তারা অনেকেই ভারতের নাগরিকত্ব চায়। সেটি ভারতের ব্যাপার।

জাগো নিউজ : বাংলাদেশ ছেড়ে যাচ্ছে এখনও...

শাহরিয়ার কবির : না। এখন যাচ্ছে না। শেখ হাসিনার সরকার আসার পর বাংলাদেশে হিন্দু জনসংখ্যা বেড়েছে।

জাগো নিউজ : শিক্ষিত হিন্দু তরুণরা বিদেশ পাড়ি দিচ্ছে প্রায় স্থায়ীভাবেই…

শাহরিয়ার কবির : মুসলমান তরুণরাও যাচ্ছে। সেটি অর্থনৈতিক কারণে। মাইগ্রেশন হয় ধর্মীয় এবং অর্থনৈতিক কারণে। অর্থনৈতিক কারণে হিন্দু-মুসলমান উভয়ই যাচ্ছে। অর্থনৈতিক কারণে অনেক মুসলমানও ভারতে যাচ্ছে।

গত ১০ বছরে আড়াই লাখ হিন্দু বাংলাদেশে ফেরত এসেছে। নতুন করে কেউ ভারতে যাচ্ছে না। এ কারণে ২.৫ শতাংশ হিন্দু জনসংখ্যা বেড়েছে।

জাগো নিউজ : কিন্তু সংখ্যালঘু নির্যাতন তো শেখ হাসিনার সরকারের আমলেও হচ্ছে…

শাহরিয়ার কবির : আমরা তা অস্বীকার করছি না। আমরা সংখ্যালঘু নির্যাতনের প্রতিবাদে নিয়মিত কর্মসূচি পালন করছি। আমরা জাতীয় সংখ্যালঘু কমিশন গঠনের দাবি জানিয়ে আসছি। আইন করতে বলছি। নির্যাতন বন্ধ হয়েছে তা কখনই বলিনি। তবে বিএনপি-জামায়াত সরকারের সঙ্গে তুলনায় অনেক কমেছে। রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশের সংখ্যালঘু নির্যাতন নিয়ে অচিরেই আমরা শ্বেতপত্র প্রকাশ করব।

জাগো নিউজ : রোহিঙ্গা সংকটের ভবিষ্যৎ কী দেখছেন?

শাহরিয়ার কবির : চীনের ফর্মুলায় দ্বিপাক্ষিক আলোচনা করে রোহিঙ্গাদের ফেরত নেবে মিয়ানমার, আমি তা বিশ্বাস করি না। আমি মনে করি, প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করতে হবে মিয়ানমারের ওপর, যা বাংলাদেশ সরকার করতে পারেনি।

জাগো নিউজ : এ প্রশ্নে বাংলাদেশ সরকারকে ব্যর্থ বলবেন কি-না?

শাহরিয়ার কবির : আমি ব্যর্থ বলতে চাই না। এ সরকারই রোহিঙ্গা সমস্যাকে আন্তর্জাতিকীকরণ করেছে। তিন লাখ রোহিঙ্গা আগে থেকেই ছিল। সব মিলে এখন ১০ লাখের মতো। তাদের নিয়ে জামায়াত-পাকিস্তানের নকশা আছে। ২০০৪ সাল থেকে আমি এসব নিয়ে লিখছি।

জাগো নিউজ : পাকিস্তানের নকশা কী?

শাহরিয়ার কবির : আরাকান, বান্দরবান, কক্সবাজারের অংশ নিয়ে স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্র গঠন হোক, এটি পাকিস্তান চায়। রোহিঙ্গাদের পাকিস্তান জঙ্গি বানিয়েছে। ২০০৪ সালে দেখেছি, ১২৫টি জঙ্গি সংগঠনের মধ্যে ১৭টি ছিল রোহিঙ্গাদের নিয়ে।

জাগো নিউজ : আর জামায়াতে ইসলামীর নকশা…

শাহরিয়ার কবির : জামায়াত আর পাকিস্তানের আইএসআই’র নকশা একই। তারা উভয়ই চায় স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্র গঠন করা।

চীনেরও নকশা আছে। চীন বাংলাদেশের সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর করতে চেয়েছিল। শেখ হাসিনা দেননি। পাকিস্তানে করেছে। মিয়ানমারের আকিয়াবে গভীর সমুদ্রবন্দর করতে চাইছে চীন। যে কারণে মিয়ানমার বিশেষ গুরুত্ব পাচ্ছে চীনের কাছে।

জাগো নিউজ : এতগুলো নকশার মধ্যে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর চ্যালেঞ্জ কতটুকু?

শাহরিয়ার কবির : মিয়ানমার এমন একটি দেশ যাদের গণতন্ত্র সম্পর্কে কোনো ধারণাই নেই। ১৯৬২ সাল থেকে সেখানে সামরিক শাসন চলছে। মানবাধিকার তারা বোঝে না। অথচ অং সান সুচি মানবাধিকারের জন্য নোবেল পেয়েছেন। সুচির মুক্তির জন্য আমরা ঢাকার রাস্তায় মিছিল করেছি। মিয়ানমারকে সত্যিকার মানবাধিকারের বিষয়টি বোঝাতে হবে।

মিয়ানমারের ভেতরে জনমত গড়ে তুলতে হবে। যেমন- একাত্তরে আমরা যুক্তরাষ্ট্রের মানুষের মধ্যে করেছিলাম। যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের পক্ষে ছিল। মিয়ানমারের সব মানুষ রোহিঙ্গা নিধনের পক্ষে নয়। বুদ্ধিস্টদের অনেকে হত্যার বিপক্ষে। বাংলাদেশে একটি বৌদ্ধ সম্মেলেন করা দরকার। কেন বৌদ্ধ ধর্মের নেতারা বৌদ্ধ মগদের বলবে না যে, এভাবে তোমরা মুসলমান হত্যা করতে পার না! এ সম্মেলন নিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে আমরা কথা বলব।

জাগো নিউজ : রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে আপনার নিজের পর্যবেক্ষণ কী?

শাহরিয়ার কবির : আমি তিনটি উপায়ের কথা বলছি। প্রথমত, মিয়ানমারের ওপর চাপ বাড়ানো এবং এ চাপ বিভিন্ন উপায়ে বাড়াতে হবে। কমলাপুর বৌদ্ধ মন্দিরের প্রধান শুদ্ধানন্দ মহাথেরো বিশ্বে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের মধ্যে তিন নম্বরে অবস্থান করছেন। খ্রিষ্টানদের পোপদের মতো তাদের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। শুদ্ধানন্দ মহাথেরো মিয়ানমার গেলে অং সান সুচি হাতজোড় করে দাঁড়িয়ে থাকবেন। অথচ তাকে আমরা কাজে লাগাতে পারছি না। তাকে দিয়ে বলাতে হবে, বৌদ্ধ ধর্মের নামে এ গণহত্যা বন্ধ করুন। চীন, মিয়ানমারের বৌদ্ধদের তিনি বোঝাতে পারেন। বৌদ্ধ বা হিন্দুত্বের নামে মৌলবাদ বাড়লে আমাদের এখানে ইসলামের নামেও মৌলবাদ বাড়বে।

পাকিস্তানের সঙ্গে তাল মিলিয়ে একজন কংগ্রেসম্যান বলেছেন, আরাকানকে মিয়ানমার থেকে বিচ্ছিন্ন করে বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্ত করতে। এটি করলে আরেকটি ইসরায়েল তৈরি হবে। যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে ওই কংগ্রেসম্যানের সঙ্গে কথা বলেছি। তার প্রস্তাবের বিপরীতে বলেছি, এটি যুদ্ধ ডেকে আনবে। আমরা যুদ্ধ করতে চাই না। তারা এখন বুঝতে পারছে।

দ্বিতীয় উপায় হচ্ছে, নাগরিক উদ্যোগ বাড়াতে হবে। মিয়ানমারে অনেকেই সংখ্যালঘু, মানবাধিকার নিয়ে কাজ করছেন। তারা সবাই বর্বর নন। পাকিস্তানেও ঠিক তা-ই। পাকিস্তানের সাধারণ মানুষ বাংলাদেশের প্রতি সহানুভূতিশীল। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এ চাপ নিয়ে যেতে হবে। ওআইসি মুসলমানদের কথা বলে। কিন্তু রোহিঙ্গা ইস্যুতে কেন চুপ করে বসে আছে?

তৃতীয় উপায় হচ্ছে, যদি সব রোহিঙ্গাকে ফেরত পাঠানো সম্ভব না হয়, তাহলে অন্য কোনো দেশের সঙ্গে আলোচনা-সাপেক্ষে স্থানান্তর করতে হবে। জাতিসংঘের এমন উদাহরণ আমাদের সামনে আছে। ১৯৯২ সালে নেপাল দেড় লাখ ভুটানিকে বের করে দিয়ে শরণার্থী করল। নেপাল ও ভুটান কেউই তাদের নিতে চাইল না। তখন জাতিসংঘের আলোচনায় বিভিন্ন দেশে তাদের স্থানান্তর করা হলো। যুক্তরাষ্ট্রে চলে গেল নব্বই হাজার শরণার্থী।

কানাডা প্রস্তাব করেছে দুই লাখ ফিলিস্তিনি শরণার্থী তাদের দেশে নেবে। এমন উদাহরণ তো আছে। এটিও আমাদের ভাবতে হবে। তুরস্ক, মালয়েশিয়া রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে আগ্রহী। তাদের সঙ্গে সরকারি পর্যায়ে আলাপ করতে হবে এবং সেটা জাতিসংঘকে মাধ্যম করে। তবে এটি অবশ্যই সর্বশেষ উপায় এবং এর আগে ফেরত পাঠানোর সব চাপ প্রয়োগ করতে হবে।

জামায়াত রোহিঙ্গাদের যেভাবে জিহাদিকীকরণ করছে, সেটি অবহেলার কোনো সুযোগ নেই। রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে স্থায়ী হলে গোটা দক্ষিণ এশিয়ায় বিপর্যয় নেমে আসবে। এটি বাংলাদেশ-মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ বিষয় নয়। এটি অবশ্যই আন্তর্জাতিক ইস্যু। ১০০ জনে একজন রোহিঙ্গাকে জঙ্গি বানাতে পারলে বছরে ১৫ হাজার জঙ্গি হবে। আমি যুক্তরাষ্ট্রকে বলে এসেছি, তোমরা সিরিজ ৯/১১-এর জন্য অপেক্ষা করো। যদি রোহিঙ্গা সংকটকে অবহেলা করো, রোহিঙ্গাদের ক্ষোভ কাজে লাগিয়ে জামায়াত তাদের সশস্ত্র করে তুলবে। জামায়াত বোঝাতে চাইছে জিহাদ করে মিয়ানমার দখল করতে হবে। এজন্য তোমাকে প্রশিক্ষণ নিতে হবে। জামায়াতের জিহাদ মানে ইসলাম। আর ইসলাম মানে মৌলবাদ। এটিই তারা প্রমাণ করতে চাইছে।

জামায়াতের এজেন্ডা আর আইএস বা আল-কায়েদার এজেন্ডা একই। আইএস বা আল-কায়েদা মনে করে, অন্তিম জিহাদ হবে ভারতের বিরুদ্ধে। আমি ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রকে বলে এসেছি, আপনারা হয়ত এ বিষয়গুলো ভাবছেন না। সিরিয়ায় আইএস হটিয়ে স্বস্তিতে আছেন। এটি বোকামি হবে। জঙ্গিবাদ একটি আদর্শ। অস্ত্র দিয়ে আদর্শ মোকাবিলা করা যায় না। এর বিপরীত আদর্শ নিয়ে আমরা কেউ ভাবছি না।

রোহিঙ্গাদের সমাবেশ-বিক্ষোভ বিশেষ ইঙ্গিত দিচ্ছে, যা বিপদ অনিবার্য করে তুলছে। যুবলীগের ছেলেটাকে মেরে ফেলল, ইয়াবা ব্যবসায় বাধা দেয়ার কারণে। কক্সবাজার শেষ হয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ শেষ হওয়ার আগেই আক্রমণাত্মক কূটনৈতিক চাপ সৃষ্টি হোক রোহিঙ্গা ইস্যুতে। জামায়াত, পাকিস্তান, আইএস-এর ষড়যন্ত্র বুঝেই সমাধানের পথ বের করতে হবে।

এএসএস/এমএআর/পিআর

আরও পড়ুন