‘দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি’ কমাতে পারে পুলিশের অপরাধ
১৮ বছর থেকে পুলিশে নিয়োজিত কনস্টেবল সোহেল। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ কার্যালয়ে কর্মরত সোহেল গত ১৬ আগস্ট এক সহকারী কমিশনারের (এসি) অফিসের ড্রয়ারের তালা ভেঙে অভিযানে জব্দ করা পাঁচ হাজার পিস ইয়াবা চুরি করেন। পরে সিসিটিভির ফুটেজ দেখে তাকে শনাক্ত করা হয়।
জিজ্ঞাসাবাদে ইয়াবা চুরির বিষয়টি স্বীকারের পর তার বাসা থেকে উদ্ধার করা হয় চুরি যাওয়া ইয়াবা। ওই ঘটনায় ডিবি পুলিশের পরিদর্শক মো. শাহাবুদ্দিন খলিফা ইয়াবা চুরির অভিযোগে রমনা থানায় একটি মামলা করেন। মামলায় তাকে গ্রেফতার করে আদালতে সোপর্দ করা হয়।
অন্যদিকে দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্রীকে ধর্ষণ চেষ্টার অভিযোগে মামলা করতে গেলে ঘুষ হিসেবে বাবা মোজাম্মেল হাওলাদারের কাছ থেকে কাফরুল থানার দায়িত্বরত উপ-পরিদর্শক (এসআই) আব্দুল কুদ্দুস বেপারি চার হাজার টাকা নেন। পরে এক নারী মানবাধিকার নেত্রীর চাপে সে টাকা ফেরত দেয়া হয়। তাদের কথোপকথনের একটি অডিও রেকর্ডও ভাইরাল হয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।
গত ২১ মে’র ওই ঘটনা জানাজানির পর পুলিশ প্রথমে কাফরুল থানা থেকে উপ-পরিদর্শক আব্দুল কুদ্দুসকে প্রত্যাহার করে মিরপুর ডিসি কর্যালয়ে সংযুক্ত করা হয়। গঠিত তদন্ত কমিটি গত ১০ জুলাই তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করে। তদন্তে টাকা নেয়া ও অপেশাদার আচরণের প্রমাণ মেলায় সাময়িক বরখাস্ত করা হয় তাকে।
ওই দুই ঘটনা পুলিশ সদস্যদের অপরাধের খণ্ডচিত্র হলেও প্রায় প্রতিদিনই নানা অভিযোগ উঠছে পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে। বাংলাদেশে পুলিশ এবার যুগান্তকারী পদক্ষেপ ও মনিটরিংয়ে স্বচ্ছতার সাথে ১০৩ টাকায় কনস্টেবল নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে। কিন্তু এ নিয়োগ পরীক্ষায় অনিয়মের কারণে ১০০ জনকে বদলি ও স্ট্যান্ড রিলিজ করা হয়। এছাড়া টাঙ্গাইলের এক পুলিশ সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের অপরাধে জড়ানো, দুর্নীতি ও অপেশাদার আচরণ বন্ধ করা সম্ভব না হলেও পুলিশ সদর দফতর বলছে, অভিযোগ ওঠার পর প্রমাণের ভিত্তিতে শাস্তি নিশ্চিত করা হচ্ছে।
দুর্নীতি কিংবা অপরাধে জড়ালে এবং অপেশাদার আচরণের বিরুদ্ধে পুলিশ সদর দফতর কঠোর হুঁশিয়ারি দিলেও মাঠ পুলিশের দৃশ্য উল্টো। গরু ব্যবসায়ীর টাকা ছিনতাই, মাদক বহন ও ব্যবসা, ডাকাতি ও ছিনতাইয়ের মতো ঘটনা ছাড়াও রয়েছে ঘুষ নেয়ার অভিযোগ।
পুলিশ সদর দফতর বলছে, আইনানুগ ব্যবস্থার পাশাপাশি অপরাধ প্রমাণিত হলে বিভাগীয় ব্যবস্থাও নেয়া হচ্ছে। বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের পাশাপাশি প্রতিনিয়ত কাউন্সেলিং করা হচ্ছে। শাস্তির কারণে আগের তুলনায় সদস্যদের মধ্যে অপরাধ প্রবণতা কমছে বলেও দাবি পুলিশ সদরের।
গত ১৮ আগস্ট নানা অনিয়মের অভিযোগে চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলার চরণদ্বীপ ফকিরাখালী পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ মো. ছানোয়ার ও কনস্টেবল রাশেদকে প্রত্যাহার করে চট্টগ্রাম পুলিশ লাইন্সে সংযুক্ত করা হয়।
১৬ জুলাই দুদক পরিচালক শেখ মো. ফানাফিল্যা ঢাকার এক নম্বর সংবলিত জেলা কার্যালয়ে ডিআইজি মিজানুর রহমান ও দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) পরিচালক খন্দকার এনামুল বাছিরের বিরুদ্ধে মামলা করেন। ঘুষ লেনদেনের অভিযোগ ওঠার পর দুই প্রতিষ্ঠান থেকে তাদের সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। ডিআইজি মিজান এখন কারাগারে।
১২ জুলাই এক নারীকে (৪২) থানায় ডেকে এনে এবং পরে হাসপাতালে গিয়ে মারধরের অভিযোগে বগুড়ার ধুনট থানার সহকারী উপ-পরিদর্শক (এএসআই) শাহানুর রহমানকে সাময়িক বরখাস্ত করে পুলিশ।
নারী নির্যাতনের অভিযোগে দায়িত্ব থেকে প্রত্যাহার হওয়া ডিআইজি মিজানুর রহমানের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ ওঠে। গত ২৪ জুন তিন কোটি সাত লাখ টাকার সম্পদের তথ্য গোপন এবং তিন কোটি ২৮ লাখ টাকা অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে ডিআইজি মিজান, তার স্ত্রী, ভাই ও ভাগনের বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক।
ওই তদন্ত করতে গিয়ে দুদকের পরিচালক খন্দকার এনামুল বাছির ৪০ লাখ টাকা ঘুষ নেন বলে অভিযোগ করেন মিজানুর রহমান। ওই ঘটনায় ঘুষ দেয়া ও গ্রহণে দুই প্রতিষ্ঠান থেকে দুজনকে বরখাস্ত করা হয়।
গত ১৩ জুন সোহান বাবু আদর (৩২) নামে এক যুবককে বগুড়া সদর থানা হেফাজতে ঝুলিয়ে অমানুষিক নির্যাতনের ঘটনা ঘটে। বিষয়টি জানাজানির পর বগুড়া সদর থানার চার পুলিশ সদস্যকে ১৫ জুন বরখাস্ত করা হয়।
গত ২৪ মে টাঙ্গাইলের গোপালপুরে জুয়া খেলার কারণে পুলিশি নির্যাতনে আব্দুল হাকিম (৫০) নামে এক ব্যবসায়ীর মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। ওই ঘটনায় গোপালপুর থানার চার পুলিশ সদস্যকে প্রত্যাহার করা হয়।
সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদরাসার নুসরাত জাহান রাফিকে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনায় ‘নুসরাতের পরিবারকে অসহযোগিতার অভিযোগে’ প্রথমে প্রত্যাহার এবং পরে বরখাস্ত করা হয় ওসি মোয়াজ্জেম হোসেনকে। পরবর্তীতে তথ্যপ্রযুক্তি আইনে দায়ের করা এক মামলায় তিনি বর্তমানে কারাগারে আছেন।
ওই ঘটনায় পুলিশ সদর দফতরের উচ্চপর্যায়ের কমিটির প্রতিবেদন অনুযায়ী দায়ী চার কর্মকর্তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করা হয়। ফেনীর এসপি এস এম জাহাঙ্গীর আলম সরকারকে গত ১২ মে ফেনী থেকে প্রত্যাহার করে পুলিশ সদর দফতরে সংযুক্ত করা হয়।
বিভিন্ন সড়কে চাঁদাবাজির অভিযোগে গত ১০ মে শরীয়তপুর ট্রাফিক পুলিশের উপ-পরিদর্শক (টিএসআই) গোলাম মোস্তফা, সহকারী টিএসআই আব্দুল কুদ্দুস ও কনস্টেবল সুব্রতকে বরখাস্ত করা হয়।
গত ২৮ এপ্রিল রামগোপালপুর বাজারে মোবাইল রিচার্জ ব্যবসায়ী খোকন মিয়াকে ইয়াবা দিয়ে ফাঁসানোর চেষ্টা করায় এসআই আব্দুল আউয়ালসহ পাঁচ পুলিশ সদস্যকে প্রত্যাহার করে পুলিশ লাইন্সে সংযুক্ত করা হয়।
সর্বশেষ ২৫ আগস্ট ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) ওয়ারী বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) মোহাম্মদ ইব্রাহিম খানকে সাময়িক বরখাস্ত করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
ডিসি ইব্রাহিমের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি মিথ্যাচার, তদন্তে অসহযোগিতা এবং দায়িত্বে অবহেলা করেছেন। জানা যায়, স্বাধীনতা যুদ্ধে নিহত শহীদ এ কে এম সামসুল হক খানের পরিবারের নামে বরাদ্দ দেয়া পুরান ঢাকার নবাবপুরের একটি সরকারি জমি ২০১৮ সালে জবরদখল ও ভবন ভেঙে ফেলে সন্ত্রাসীরা। এ বিষয়ে বংশাল থানা ও জেলা প্রশাসনের কাছে অভিযোগ করে পরিবারটি।
জমি ফিরে পেতে প্রধানমন্ত্রীর কাছেও আবেদন করেন তারা। তাদের সম্পত্তির দাম ছিল প্রায় ২০ কোটি টাকা। স্থানীয় শেখ জাবেদ উদ্দিন নামে এক ব্যবসায়ীসহ কয়েকজন ওই জমি আর বাড়ি দখলের জন্য দীর্ঘদিন ধরে ভয়ভীতি দেখিয়ে আসছিলেন। এ ব্যাপারে থানায় একাধিকবার জিডিও করা হয়েছে।
গত বছর ২৮ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় জাবেদ উদ্দিনের লোকজন জমি দখল করে প্রায় পাঁচ কোটি টাকার মালামাল লুট করে নিয়ে যায়। ওই ঘটনার পরদিনই তারা এ বিষয়ে বংশাল থানায় মামলা করেন। কিন্তু থানা পুলিশ কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। পুলিশের আইজি ও লালবাগ জোনের তৎকালীন ডিসি ইব্রাহিম খানের সঙ্গে তারা সাক্ষাৎ করেন। এতেও কোনো কাজ হয়নি। ওই ঘটনায় পুলিশ সদর দফতরে ডিসির বিরুদ্ধে অভিযোগ করে পরিবারটি।
অভিযোগ তদন্তে একটি কমিটি করে পুলিশ সদর দফতর। তদন্ত কমিটি ডিসি ইব্রাহিম খানের বিরুদ্ধে মিথ্যাচার, তদন্তে অসহযোগিতা ও দায়িত্ব অবহেলার প্রমাণ পায়। তার বিরুদ্ধে সব অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় চলতি বছরের ২৩ মে পুলিশ সদর দফতরের অতিরিক্ত ডিআইজি (পার্সোনাল ম্যানেজমেন্ট -১) আমিনুল ইসলাম তাকে একটি চিঠি দিয়ে এসব অপরাধের বিষয়ে ব্যাখ্যা জানতে চান। ডিসি ইব্রাহিমকে ১০ কার্যদিবস সময় দেয়া হয়। তার ব্যাখ্যা সন্তোষজনক না হওয়ায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তাকে বরখাস্ত করার সুপারিশ করে সদর দফতর।
পুলিশ অ্যাক্ট- ১৮৬১ অনুযায়ী, কোনো পুলিশ সদস্য অপরাধমূলক কার্যক্রমে জড়ালে তার বিরুদ্ধে দুই ধরনের বিভাগীয় শাস্তির বিধান রয়েছে। এর একটি লঘুদণ্ড, অন্যটি গুরুদণ্ড।
পুলিশ সদর দফতরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৭ সালে কনস্টেবল থেকে এসআই পর্যন্ত লঘুদণ্ড পান ১২ হাজার ৮৫৮ জন, গুরুদণ্ড দেয়া হয় ৫৬৩ জনকে। এছাড়া বাধ্যতামূলক অবসর সাতজনসহ বরখাস্ত করা হয় ৮২ জনকে। পুলিশ পরিদর্শক পদমর্যাদার ৭৩ জনকে লঘুদণ্ড, গুরুদণ্ড ছয়জনকে এবং একজনকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়। এএসপি পদমর্যাদার একজনকে লঘুদণ্ড এবং দুজনকে গুরুদণ্ড দেয়া হয়।
২০১৮ সালে কনস্টেবল থেকে এসআই পর্যন্ত ১৩ হাজার ৬১৪ জনের বিরুদ্ধে লঘুদণ্ড, ৬০০ জনের বিরুদ্ধে গুরুদণ্ড এবং পাঁচজনকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানোসহ মোট বরখাস্ত করা হয় ৭৪ জনকে। পুলিশ পরিদর্শক ১৪ জনকে লঘুদণ্ড এবং চারজনকে গুরুদণ্ড দেয়া হয়।
পুলিশ সদর দফতরের এআইজি (মিডিয়া) সোহেল রানা এ প্রসঙ্গে জাগো নিউজকে বলেন, পুলিশ সদস্যদের অপরাধপ্রবণতা রোধ বা কোনো পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে অপরাধ প্রমাণিত হলে বিভাগীয় শাস্তির বিধান রয়েছে। অপরাধের ধরনভেদে বিভাগীয় শাস্তি হতে পারে- লঘুদণ্ড বা গুরুদণ্ড।
তিনি বলেন, বিভাগীয় ব্যবস্থার পাশাপাশি পুলিশ সদস্যরা যেন অপরাধে জড়িয়ে না পড়েন সেজন্য প্রতিনিয়ত কাউন্সেলিং করা হয়। পুলিশের সকল প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান যেমন- বাংলাদেশ পুলিশ একাডেমি, পুলিশ স্টাফ কলেজ বাংলাদেশসহ পুলিশ ট্রেনিং সেন্টারসমূহে তাদের কাউন্সেলিং করা হয়। এছাড়া, প্রতিনিয়ত সকল পর্যায়ের পুলিশ সদস্যদের কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা রয়েছে।
এ বিষয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান জাগো নিউজকে বলেন, এমন কোনো অপরাধ নেই, যার সঙ্গে পুলিশের যুক্ত হওয়ার অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে না। সাধারণ মানুষকে ইয়াবা দিয়ে ফাঁসানোর চেষ্টার ঘটনা ঘটছে। হেফাজতে নির্যাতনসহ অন্যান্য নির্যাতনের ঘটনার অভিযোগ তো আরও পুরনো। বিভাগীয় তদন্তের মাধ্যমে অপরাধে জড়িত পুলিশ সদস্যদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে যাতে করে অন্যরা অপরাধপ্রবণ না হয়। এক্ষেত্রে নিরপেক্ষ তদন্ত, বিভাগীয় ব্যবস্থা, শাস্তি কিংবা কাউন্সেলিংসহ অন্যান্য শক্তিশালী উদ্যোগ জরুরি।
জেইউ/এমআরএম/এমএআর/পিআর