আরএসএস নীতির প্রতিফলন ঘটছে আসাম আর কাশ্মীরে
আলতাফ পারভেজ। লেখক ও গবেষক। গবেষণা করছেন দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক ইতিহাসের নানা প্রসঙ্গ নিয়ে। লিখছেন এ অঞ্চলের রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ নিয়েও। কাশ্মীর পরিস্থিতি এবং আসামের এনআরসি (জাতীয় নাগরিক নিবন্ধন) ইস্যু নিয়ে মুখোমুখি হন জাগো নিউজ’র। নির্মোহ আলোচনা করেন দুটি বিষয়েই। দীর্ঘ সাক্ষাৎকারে গুরুত্ব পায় রোহিঙ্গা ইস্যুও।
তিন পর্বের সাক্ষাৎকারের আজ থাকছে প্রথমটি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সায়েম সাবু।
জাগো নিউজ : কাশ্মীর পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে আসছেন দীর্ঘদিন ধরে। ভারতের সংবিধান থেকে ৩৭০ অনুচ্ছেদ তুলে দেয়ার মধ্য দিয়ে আসলে কী দাঁড়াল?
আলতাফ পারভেজ : ভারতের সংবিধানে জম্মু-কাশ্মীর নিয়ে ৩৫ (ক)- এর কিছুটা কার্যকারিতা ছিল। কিন্তু ৩৭০ অনুচ্ছেদের কোনো কার্যকারিতাই ছিল না। একটি কাগুজে বিষয় ছিল মাত্র। কিন্তু এর একটি প্রতীকী মূল্য ছিল।
৩৭০ অনুচ্ছেদ তুলে দেয়ার কারণে কাশ্মীরিরা মনে করছেন, তারা মানসিকভাবে হেরে গেল। অর্থাৎ পরাজয়ের একটি বোধ তৈরি হয়েছে। কার্যকারিতা না থাকলেও নিজেদের মধ্যে গৌরব কাজ করত। সেটি কেড়ে নেয়া হলো। এতে তারা এক ধরনের ট্রমার মধ্যে আছে।
যেমন- কাশ্মীরের স্কুলগুলো খুলেছে। কিন্তু বাচ্চারা স্কুলে যাচ্ছে না ওই ট্রমার কারণে। চরমভাবে লজ্জিত বা হেরে যাওয়ার বোধ কাজ করায় ঘর থেকেই বের হতে চাইছে না।
প্রতিবাদ হচ্ছে, কিন্তু মনের কষ্টটা ঠিক প্রকাশ করতে পারছে না। কাশ্মীর তো চরমভাবে অবরুদ্ধ এখন। কথা বলতে পারছে না মানুষ। খাবার ফুরিয়ে যাচ্ছে। চিকিৎসাসেবা নিতে পারছে না। মিডিয়া নেই। কাশ্মীরে এখন প্রতি দশজনে একজন সেনা। আরও সেনা পাঠানো হচ্ছে। তার মানে কার্ফ্যু জারি করে রীতিমতো সামরিকায়িত একটি জনপদ তৈরি করা হয়েছে।
জাগো নিউজ : কাশ্মীর থেকে জম্মু আলাদা করা হয়েছে। কাশ্মীরের পরিস্থিতির সঙ্গে জম্মুর তুলনা করে কী বলবেন?
আলতাফ পারভেজ : জম্মুর আলোচনা আসলে সেই অর্থে সামনে আসছে না। সবাই কাশ্মীরের মুসলমানদের কথা ভাবছেন। জম্মুর মুসলমানদের কথা ভাবছেন না। জম্মুর মুসলমানরা মূলত কাশ্মীরিদের মতো নয়। তারা সাধারণত মেষ পালক, ছাগল পালক। তাদের অবস্থা আরও খারাপ। কারণ, কাশ্মীরিদের সঙ্গে তাদের সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়েছে। আবার জম্মুতে তারা সংখ্যালঘু। দরিদ্র।
লাদাখে আবার ভিন্ন চিত্র। সেখানে বৌদ্ধ বেশি। মুসলমানরা সংখ্যালঘু। লাদাখের মুসলমানরা আবার কাশ্মীরি নয়। শিয়া ঘরানার মুসলমান। ভাগ হওয়ার কারণে জম্মু ও লাদাখের মুসলমানরা এমনিতেই সংখ্যালঘু হয়ে গেল।
তার মানে, তিন জায়গাতেই মুসলমানরা ভিন্ন ভিন্নভাবে সমস্যায় পড়ল। কাশ্মীরের মুসলমানরা প্রতিবাদ করতে পারছে। জম্মু ও লাদাখের মুসলমানরা তা-ও পারছে না।
জাগো নিউজ : এ পরিস্থিতির ভবিষ্যৎ কী?
আলতাফ পারভেজ : কাশ্মীরের সংকট সাত দশকের। এ সংকট আরও দীর্ঘায়িত হবে। তবে আমার ধারণা, কাশ্মীরিরা এখনই মাঠে নেমে পড়বে না এবং এটিই তাদের চরিত্র। তারা একসময় ভীষণভাবে প্রতিরোধ করবে। কারণ সেখানে রাজনৈতিক সমাধানের সুযোগটাই এখন শূন্য হয়ে গেছে। রাজনীতির পথ একেবারে বন্ধ হয়ে গেছে।
তার মানে, কাশ্মীরে এখন দুটি পথ খোলা থাকল। একটি হচ্ছে সেনাবাহিনীর। আরেকটি হচ্ছে গেরিলার…।
জাগো নিউজ : লড়াই, গেরিলা লড়াই কিন্তু কাশ্মীরিরা দীর্ঘদিন ধরে চালিয়ে আসছে। এখন আসলে কোন ধরনের কৌশল নিতে পারে তারা?
আলতাফ পারভেজ : স্বাধীনতার বিষয় নিয়ে কাশ্মীরিদের কারও কারও মধ্যে দ্বিমত ছিল। যেমন- ফারুক আব্দল্লাহ, মুফতি মেহবুবারা রাজনৈতিক আলোচনার পক্ষেই ছিলেন। অনেকেই মধ্যপন্থী সমাধানের পক্ষেও ছিলেন।
কিন্তু কাশ্মীরিদের সামনে মধ্যপন্থার আর কোনো সুযোগ নেই। যে কারণে কাশ্মীরিদের সামনে একটি পথই খোলা রয়ে গেল, আর তা হচ্ছে আজাদী বা মুক্তি পাওয়া। এর বাইরে তো আর কোনো পথ তাদের কাছে খোলা নেই।
জাগো নিউজ : এ ‘মুক্তি’ পাওয়া কী কোনো সহজ সমীকরণে, বলতে পারেন?
আলতাফ পারভেজ : না। আমি তা মনে করি না। প্রথমে দেখতে হবে, কাশ্মীর সংকট আসলে বাড়ল কেন? আমার নিজের কাছে একটি ব্যাখ্যা আছে।
আমি মনে করি, কাশ্মীর পরিস্থিতির নাটকীয় অবনতির কারণ হচ্ছে আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের নীতির বিরুদ্ধে ভারতের একটি প্রতিশোধ।
জাগো নিউজ : যদি ব্যাখ্যা করতেন?
আলতাফ পারভেজ : তালেবানদের সঙ্গে যে শান্তিচুক্তি হচ্ছে সেখানে যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের অবস্থানকেই মেনে নিয়েছে। তালেবানদের সঙ্গে চুক্তি করতে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের মতামতকেই গুরুত্ব দিচ্ছে। শিগগিরই এ চুক্তি সম্পন্ন হচ্ছে।
জাগো নিউজ : আফগানিস্তানে চুক্তি তো শান্তির জন্যই হচ্ছে…
আলতাফ পারভেজ : চুক্তির এক বা দুই বছর পরই আফগানিস্তানে তালেবানরা ক্ষমতায় আসবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। আর তালেবান শক্তিটা কোনো না কোনোভাবে পাকিস্তান দ্বারা প্রভাবিত। তালেবানদের রাজনৈতিক ও সামরিক শক্তিতে পাকিস্তানের প্রভাব রয়েছে বলে অনেকে ধারণা করেন। এ ধারণা পাকিস্তানের জন্য ইতিবাচক। সম্প্রতি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের যুক্তরাষ্ট্র সফরের মধ্য দিয়ে এ বিষয়ে গতি পেয়েছে।
ভারত যখন এ পরিস্থিতি বুঝতে পেরেছে, ঠিক তখনই সংবিধান থেকে ৩৭০ অনুচ্ছেদ তুলে দিল। আর ৫ আগস্টের (২০১৯) আগে ভারত খুব দ্রুত নাটকীয় পরিস্থিতির জন্ম দেয় কাশ্মীরে। সহজ কথা হচ্ছে, আফগানিস্তানে পাকিস্তানের প্রভাব বাড়লে, কাশ্মীরে ভারতের প্রভাব বাড়বে। যদিও কাশ্মীরে সামরিক শক্তির প্রভাব ছিল দীর্ঘদিন ধরেই।
এসবের মধ্য দিয়ে কাশ্মীরিদের আরও বিপদে ফেলে দেয়া হলো। যেখানে লড়াই ছাড়া আর কোনো উপায়ই থাকল না।
জাগো নিউজ : আপনি আফগান প্রসঙ্গ আনলেন। অনেকে বলছেন, মোদি সরকারের মুসলমানবিরোধী নীতির প্রতিফলন ঘটছে কাশ্মীরে?
আলতাফ পারভেজ : হ্যাঁ। গোটা ভারতেই মুসলমানদের ব্যাপারে বিজেপি সরকারের নীতি কঠোর এবং প্রতিনিয়তই দেশটিতে ধর্মীয় উগ্রবাদের নামে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে। অন্তত আসাম থেকে কাশ্মীর পর্যন্ত আমরা তা-ই দেখতে পাচ্ছি।
আপনাকে মনে রাখতে হবে, বিজেপি হচ্ছে আরএসএস’র অঙ্গসংগঠন। মূলত, মোদি সরকার হচ্ছে আরএসএস’র সরকার। আরএসএস হচ্ছে অত্যন্ত আদর্শবাদী সংগঠন। ভারতের আজকের রাজনীতি বুঝতে হলে আরএসএস-কে বুঝতে হবে।
জাগো নিউজ : আরএসএস আসলে কী চাইছে?
আলতাফ পারভেজ : আরএসএস চায় একটি অখণ্ড ভারত। আরএসএস মনে করে, ভারতে তাদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হচ্ছে তিনটি। খ্রিস্টান, মুসলমান ও কমিউনিস্টরা; তারা তাদের শত্রু এবং তারা ভারতের রাজনীতির ক্ষতি করছে। আরএসএস মনে করে, যেকোনো শক্তি প্রয়োগ করে এ তিন শত্রুকে মোকাবিলা করতে হবে।
বিশেষ করে কমিউনিস্টদের উৎখাত করতেই হবে- এমনটি আরএসএস সচেতনভাবে ঘোষণা দিয়ে আসছে। আর মুসলমান ও খ্রিস্টানদের তাদের অধীনস্ত করতে হবে। প্রকাশ্যে না বললেও তারা নীতিতে বোঝাতে চায় যে, অন্য ধর্মের মানুষদের দ্বিতীয় শ্রেণি করে রাখা। এমনকি কোথাও কোথাও নাগরিকহীনও করে রাখা। বিদেশি আগ্রাসনের কলুষমুক্ত করতে হবে যেকোনো উপায়েই- এটিই হচ্ছে আরএসএস’র সাংস্কৃতিক বিশ্বাস।
আমরা দেখেছি, উড়িষ্যায় এক চার্চের ফাদারকে গাড়িতে রেখে আগুন জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছিল। ওই আগুন লাগানোর ঘটনায় যিনি ইন্ধন দিয়েছিলেন, তিনি বিজেপি সরকারের মন্ত্রীও ছিলেন। এসব ঘটনাকে আপনি বিচ্ছিন্ন বলতে পারেন না। এগুলো আরএসএস’র রাজনীতির অংশ।
ভারতে এমন দাবিও আছে যে, নথুরাম গডসের ছবি টাকায় দিতে হবে। নথুরাম গডসে ভারতের জাতির পিতা মহাত্মা গান্ধীকে হত্যা করেছিলেন। তার মানে গান্ধী নয়, খুনি নথুরাম গডসে তাদের কাছে হিরো।
এসব ঘটনার জন্ম দিয়েই কিন্তু বিজেপি ক্ষমতায় আসছে এবং আসাম আর কাশ্মীরে আরএসএস’র নীতির প্রতিফলনই ঘটছে। দেখবেন, পশ্চিম বাংলাতেও এনআরসি হবে। সেখানে হয়ত হিন্দুরাও এনআরসি’র শিকার হবেন। কিন্তু বিজেপি বলছে, হিন্দুদের থাকতে দেবে, মুসলমানদের থাকতে দেবে না। আরএসএস’র পদ্ধতিগত এ অবস্থান আর লুকোচুরি নয়, এটি এখন প্রকাশ্য।
জাগো নিউজ : তার মানে, ভারতে হিন্দুত্ববাদের বিকাশ...
আলতাফ পারভেজ : হিন্দুধর্ম এবং হিন্দুত্ববাদ কিন্তু এক বিষয় নয়। আরএসএস হিন্দুধর্মের একটি ভিন্ন সংযোজন। আরএসএস হিন্দুত্ববাদ-কে সামনে এনে জঙ্গি বা জাতীয়তাবাদে রূপ দিয়েছে। তারা অপরকে ঘৃণা করতে শেখায়।
হিন্দুধর্ম তো আগেও ছিল। বাংলাদেশ, পাকিস্তান, নেপালেও হিন্দু আছে। অন্য ধর্মের মানুষকে পিটিয়ে হত্যা করতে হবে- এটি হিন্দুধর্মের সঙ্গে যায় না। আরএসএস নিজে উগ্র এবং অপরকে ঘৃণা করার ব্যাখ্যাটাও দাঁড় করিয়েছে।
এএসএস/এমএআর/পিআর