১০ হাজারে ২ জন শিক্ষকও নেই যারা বিশ্ববিদ্যালয়ের ধারণা রাখেন
অধ্যাপক মলয় ভৌমিক। বিশিষ্ট নাট্যকার, রাজনীতিক ও সমাজ বিশ্লেষক। অধ্যাপনা করছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা বিভাগে। লিখছেন সমাজের নানা প্রসঙ্গ নিয়েও। সম্প্রতি রাষ্ট্র, সমাজ, রাজনীতির মতো বিষয় নিয়ে মুখোমুখি হন জাগো নিউজ’র। বলেন, ক্ষমতার বলয়কে কেন্দ্র করেই হিংসা, সহিংসতা প্রতিষ্ঠা পাচ্ছে মানুষের মননে। সামাজিক অস্থিরতার জন্য অসহিষ্ণু রাজনীতিকেও দায়ী করেন এ বিশ্লেষক। দুই পর্বের সাক্ষাৎকারের আজ থাকছে প্রথমটি।
জাগো নিউজ : নানা ইস্যুতে হিংসা ছড়াচ্ছে সমাজে। প্রকাশ্যে মানুষকে পিটিয়ে হত্যা করা হচ্ছে। মানুষের মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তন কীভাবে প্রত্যক্ষ করছেন?
মলয় ভৌমিক : আশির দশকের শেষের দিকে সামাজিক অসঙ্গতির কিছু বিষয় আমরা লক্ষ্য করতে থাকি। সেই লক্ষণগুলো এখন প্রায়োগিক পর্যায়ে দেখছি।
আরও পড়ুন > শিক্ষায় গলদ আছে বলেই সমাজে বর্বরতা বাড়ছে
সমাজে যে পরিবর্তন ঘটছে, তার মূলে রয়েছে রাজনীতি। এজন্য বৈশ্বিক রাজনীতিকেও সামনে আনতে হবে। বিশ্বমোড়ল তথা, যেসব দেশকে অনুসরণীয় মনে করা হয়, সেসব দেশেও উল্টোযাত্রা শুরু হয়েছে আগে থেকেই। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জুনিয়র বুশ নিউক্লিয়ার বোমা থাকার অভিযোগে ইরাকে হামলা করল। আমেরিকার শতভাগ মানুষ শিক্ষিত। অথচ তাদের মধ্যকার অধিকাংশ মানুষই ইরাকযুদ্ধে সমর্থন দিয়ে বসল। পরে ইরাকে কোনো নিউক্লিয়ার বোমাই পাওয়া গেল না।
এমন মিথ্যার বেসাতি প্রত্যেক সমাজেই গুরুত্ব পাচ্ছে। ভয়ের কথা এখানেই। আমরা সভ্যতার এমন সময়েও দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে চাঁদে দেখার গুজব শুনলাম।
মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে এ সমাজ কিছু বিষয়কে ফেলে এসেছে। অথচ সেই ফেলে আসা বিষয়গুলোকে পরিকল্পিতভাবে উসকে দেয়া হচ্ছে। যেমন- সাম্প্রদায়িকতা বা অতিধর্মীয় গোঁড়ামিকে ফেলে আসা হয়েছিল।
জাগো নিউজ : আদৌ কি ফেলে আসা হয়েছে?
মলয় ভৌমিক : একেবারে ফেলে আসা হয়েছে, তা বলা ঠিক হবে না। কারণ, তাহলে তো আবার ফিরে আসত না।
সমাজের অগ্রসররা সাধারণের কাছে পথপ্রদর্শক হয়। সাধারণত শিক্ষিত মধ্যবিত্তরাই সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যায়। এখন আমরা কী দেখছি! বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো জায়গাতেও পশ্চাৎপদ চিন্তার বিকাশ ঘটছে তীব্রভাবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞানের একজন শিক্ষক যদি মনে করেন, হ্যাঁ পদ্মা সেতুতে মাথা লাগতেও পারে! হয় সচেতনভাবে, না হয় অসচেতনভাবেই এ বিশ্বাস প্রচার করছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সচেতনভাবে জাতীয়তাবাদকে উসকে দিলেন। তিনি বললেন, আমরাই শ্রেষ্ঠ। অভিবাসীরা কেউ নন। তিনি এ তত্ত্ব প্রচার করেই কিন্তু জিতে গেলেন। ইংল্যান্ডেও তা-ই দেখলাম। তার মানে ইউরোপ-আমেরিকার মানুষও পেছনের দিকে যাচ্ছে।
জাগো নিউজ : কিন্তু আমাদের সমাজের এগিয়ে যাওয়ার একটি ইতিহাস ছিল...
মলয় ভৌমিক : গত শতকের চল্লিশ-পঞ্চাশের দশকে আমরা এগিয়ে যাওয়ার গল্প শুনি। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ দাশ গোঁড়ামি-কুসংস্কার ফেলে এসেছিলেন। ষাটের দশকে আমরা আরও পরিচ্ছন্নভাবে এগোতে থাকলাম। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর লালসালু তো আমাদের এগিয়ে যাওয়ার গল্প শোনায়। এ এগিয়ে যাওয়ার পরিণত সময়ের মধ্য দিয়েই মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে। অথচ আমরা ফের পেছনের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করছি।
জাগো নিউজ : পেছনে যেতে উসকে দেয়ার কথা বলছেন। আসলে উসকে দিচ্ছে কারা?
মলয় ভৌমিক : ক্ষমতা। যারা ক্ষমতায় যেতে চান তারাই উসকে দিচ্ছেন। এর মধ্য দিয়ে শিক্ষা ও সংস্কৃতির মধ্যে ঝামেলা তৈরি হচ্ছে। আপনি বিজ্ঞান ও দর্শনের চর্চা আর দেখতে পাবেন না। এ চর্চা থাকলে তো নতুন প্রজন্মের বিভ্রান্ত হওয়ার কথা নয়। ক্ষমতার জন্যই পাঠ্যসূচি পরিবর্তন করা হচ্ছে। ক্ষমতায় থাকার জিকির আমরা শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে দেখতে পাচ্ছি।
আপনি পাশের দেশ ভারতেও তা-ই দেখতে পাবেন। লোকবিশ্বাসকে সামনে এনে সেখানে বিজেপি ক্ষমতায় এলো। অথচ ভারত ধর্মনিরপেক্ষতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। জয় শ্রীরাম স্লোগান দিয়ে মুসলমানদের পিটিয়ে হত্যা করা হচ্ছে। সবই তো ক্ষমতাকে কেন্দ্র করেই।
জাগো নিউজ : নিষ্ক্রিয় সুশীল, বুদ্ধিজীবীরাও!
মলয় ভৌমিক : সমাজ, রাষ্ট্রে প্রচণ্ডভাবে মোসাহেবি বা তোষামোদকারী তৈরি হয়েছে। আর সুশীল, বুদ্ধিজীবীরাই এদের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। শিক্ষা, সংস্কৃতি কী হবে- এ সুশীলরাই তৈরি করে দিচ্ছেন। সমাজ, রাষ্ট্রের আচারও তারা-ই তৈরি করে দিচ্ছেন।
এমপি-মন্ত্রী আসবেন বলে সারাদিন রোদের মধ্যে শিক্ষার্থীদের দাঁড় করিয়ে রাখা হয়। প্রধান অতিথিকে একটি গান শোনানো হবে বলে স্কুলের ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ করে দেয়া হয়। আগে কিন্তু এমনটি ছিল না। বিষয়গুলো ছোট বলে আপনি অবহেলা করতে পারেন। কিন্তু এসব-ই সমাজ বিনির্মাণ করে থাকে। একজন মন্ত্রীর জন্য শিশুরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকবে, আর সেই শিশুরাই দর্শন-বিজ্ঞানে বিশ্বাস রাখবে, তা মনে করার কোনো কারণ নেই।
এখনকার শিক্ষা ব্যবস্থা চরমভাবে অধীনস্থ করে দিচ্ছে। অথচ শিক্ষার উদ্দেশ্যই হচ্ছে স্বাধীন করে দেয়া। মানুষকে মুক্তি দেয়া। আপনি কোথাও আর মুক্তির গান শুনতে পাবেন না।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাও লেজুড়বৃত্তি করেই সুবিধা নিতে চাইছে। এর চেয়ে বড় পচন তো আপনি দেখতে পাবেন না। আগে শিক্ষকরা ছিলেন শিক্ষার্থীদের কাছে অনুকরণীয়। এখন ১০ হাজারের মধ্যে দুজন শিক্ষকও নেই যারা বিশ্ববিদ্যালয়ের ধারণা রাখেন।
সবকিছুই যেন কর্তৃত্ববাদী কেন্দ্রাভিমুখী হয়ে যাচ্ছে। শিক্ষা, সংস্কৃতি, রাজনীতি, দর্শন- সবই যদি ক্ষমতার কেন্দ্রের দিকে যেতে থাকে, তাহলে মানুষ মুক্তভাবে ঘুরে দাঁড়াতে পারে না। আর গণ্ডগোল ঠিক এখানেই।
জাগো নিউজ : সমাজের এ অবনতির জন্য কোন বিষয়কে সামনে আনবেন?
মলয় ভৌমিক : আজকের এ পরিস্থিতির জন্য অনেক কিছুই দায়ী। অনেকভাবেই চাষ হচ্ছে অপশিক্ষা, অপসংস্কৃতি। প্রযুক্তির বিকাশও এজন্য দায়ী। মোবাইল ব্যবহার কারও কারও জন্য মাদকের চেয়েও ভয়াবহ পর্যায়ে চলে গেছে।
অনেকে আবার মাঠে না দাঁড়িয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দুই লাইন লিখে দিয়ে প্রতিবাদ করছেন। প্রযুক্তির মাধ্যমে দ্রুত যে তথ্য পাচ্ছেন, তা যাচাই করার মানসিকতা আর থাকছে না। আগে দল বেঁধে বিবিসির খবর শুনতাম। সেই খবর নিয়ে নানা রকম বিশ্লেষণ করতাম। ফেসবুকের আলোচনায় সেই বিশ্লেষণ আর নেই। দ্বিতীয়ত, মোবাইল ফোনে মানুষ এতই আসক্ত যে তার অতি প্রয়োজনীয় কাজগুলোও ভুলে থাকছে।
আবার মানুষের সংগ্রাম করার ক্ষমতাও কমে গেছে। শিশুরা না চাইতেই অনেক কিছু পেয়ে যাচ্ছে। রবীন্দ্রনাথ ছেলেবেলা নিয়ে লিখেছেন, ‘শীতের দিনে একটি শার্টের ওপর আরেকটি শার্ট গায়ে দিলেই আমাদের যথেষ্ট ছিল। এর চেয়ে বেশি চাইবার অধিকার আমাদের ছিল না।’ অথচ তিনি জমিদার পরিবারের সন্তান ছিলেন। তার লেখায় সমাজের চিত্রটা উঠে এসেছে। এখন আপনি এটি কল্পনা করতে পারবেন?
জাগো নিউজ : সমাজের এ পরিবর্তন তো মানতে হবে?
মলয় ভৌমিক : পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থা ভয়ঙ্করভাবে ভোগবাদী করে তুলছে মানুষকে। আগে অনেক মানুষ দিনে একবেলা খেতেন। এখন আয় ও ভোগব্যয় অনেক বেড়েছে। এ পরিবর্তন অবশ্যই স্বীকার করতে হবে। কিন্তু এ পরিবর্তনের সঙ্গে মানুষের চিন্তার পরিবর্তনও ঘটার কথা ছিল। সেটা ঘটেনি। অর্থাৎ দেহের ক্ষুধা মেটাতে মানুষ মরিয়া, অথচ মনের ক্ষুধা মেটাতে কোনো প্রয়াস নেই। এ চিত্র সমাজে ভারসাম্যহীনতা তৈরি করছে। মূলত মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তন না ঘটায় সমাজে বৈষম্য এখন সর্বত্রই। ভোগবাদী সমাজ এ বৈষম্যই জিইয়ে রাখতে চায়। সাম্যবাদী সমাজ তৈরি করতে যে বোধ বা শিক্ষার দরকার, তা উপরিতলের মানুষরা মানতে নারাজ। আর উপরিতলের মানুষের উচ্ছিষ্ট নিয়েই সাধারণরা সন্তুষ্ট থাকছে। এ কারণে সমাজে কোনো জাগরণ নেই।
এমন একটি সমাজে মানুষের বিবেক বা যুক্তি কাজ করে না। এ কারণেই গুজব ছড়িয়ে মানুষকে হত্যা করতে দেখছি।
এএসএস/এমএআর/জেআইএম