ভিডিও EN
  1. Home/
  2. বিশেষ প্রতিবেদন

বাংলাদেশের শ্রমিকদের মতো স্পিরিট পৃথিবীর কোথাও নেই

সায়েম সাবু | প্রকাশিত: ০২:০৭ পিএম, ০২ আগস্ট ২০১৯

শোভন ইসলাম। ব্যবস্থাপনা পরিচালক, স্প্যারো গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ। পেশায় কম্পিউটার বিজ্ঞানী। কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে মাস্টার্স করেছেন ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাস অ্যাট অস্টিন থেকে। ক্যালিফোর্নিয়ার প্রখ্যাত স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমবিএ করেছেন। চাকরি করেছেন বিশ্বখ্যাত প্রতিষ্ঠান হিলেট প্যাকার্ড ও মাইক্রোসফটে।

দেড় দশক আগে বাবার অনুরোধে দেশে ফিরে হাল ধরেন গার্মেন্ট ব্যবসার। বাবার গড়া প্রতিষ্ঠানে দুই হাজার শ্রমিকের হাত ধরে যাত্রা শুরু করলেও এখন প্রায় ১৪ হাজার শ্রমিক কাজ করছেন। দেশের বাইরে জর্ডানেও গার্মেন্ট ফ্যাক্টরি করে ২২শ’ বাংলাদেশি নারী শ্রমিককে নিয়োগ দিয়েছেন। শুরুতে শত কোটি টাকার রেভিনিউ হলেও এখন তা কয়েক হাজার কোটিতে দাঁড়িয়েছে।

আরও পড়ুন >> শ্রমিক সন্তুষ্ট থাকলে ব্যবসা ভালো হবেই

দীর্ঘ সাক্ষাৎকারে নিজের ব্যবসার সফলতার পাশাপাশি বাংলাদেশের গার্মেন্ট শিল্পের সমস্যা ও সম্ভাবনার কথা তুলে ধরেন। তিন পর্বের সাক্ষাৎকারের আজ থাকছে দ্বিতীয়টি।

জাগো নিউজ : ব্যবসার প্রসারে জর্ডানেও গার্মেন্ট ফ্যাক্টরি করেছেন। সেখানে ফ্যাক্টরি করার প্রেক্ষাপট কী?

শোভন ইসলাম : যুক্তরাষ্ট্রে জর্ডানের পণ্য পৌঁছায় শুল্কমুক্তভাবে। ৩৩ শতাংশ শুল্ক দেয়া লাগছে না। শুল্কমুক্ত পণ্য বিক্রি কে না চায়। ক্রেতারাও জর্ডান থেকে পণ্য নিতে আগ্রহী।

জর্ডানে গার্মেন্টের জন্য ফেব্রিকস আসে মূলত তুরস্ক থেকে। আর বাংলাদেশে ফেব্রিকস আসে ইন্ডিয়া ও চীন থেকে। তুরস্ক থেকে জর্ডানের দূরত্ব খুবই কম। সাত থেকে ১০ দিনের মধ্যে তুরস্ক থেকে জর্ডানে কাঁচামাল চলে আসে। জর্ডান থেকে ১২ দিনের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য রফতানি করা যায়।

জাগো নিউজ : জর্ডানে আপনার ফ্যাক্টরিতে শ্রমিক কারা?

শোভন ইসলাম : জর্ডানের ফ্যাক্টরিতে শতভাগ শ্রমিক আমরা বাংলাদেশ থেকে নিয়ে যাই। ২০১১ সালে শুরু জর্ডানে। পুরোদমে উৎপাদনে যাই ২০১৩ সালে। শুরু করেছিলাম ৬০০ শ্রমিক দিয়ে। এখন সেখানে দুই হাজার ২০০ শ্রমিক কাজ করছে। কিছু এক্সপার্ট (অভিজ্ঞ) শ্রীলঙ্কা থেকে নেয়া হয়েছে। ধীরে ধীরে বাংলাদেশি এক্সপার্টদেরই নিয়োগ দেয়া হচ্ছে। তবে মধ্যসারির কিছু ম্যানেজার ইন্ডিয়া থেকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে।

জাগো নিউজ : সেখানে কেমন আছেন বাংলাদেশের শ্রমিকরা?

শোভন ইসলাম : জর্ডানে শ্রমিকদের থাকা-খাওয়া সম্পূর্ণ ফ্রি। এসি (শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত) ডরমেটরিতে শ্রমিকরা থাকেন। ফ্যাক্টরির পাশেই থাকার জায়গা। একটি শিল্প এলাকায় আমার কারখানা।

সেখানে সবাই নারী শ্রমিক। একদম ফ্রিতে তাদের চাকরি দেয়া হয়। শুধুমাত্র পাসপোর্টটি শ্রমিককে করতে হয়। তিন বছরের চুক্তিতে যায়। এরপর সে চাইলেই চলে আসতে পারে।

sovon

অনেকে আমার বাংলাদেশের ফ্যাক্টরি থেকে যাচ্ছেন। শ্রমিকরা সেখানে কাজ করার সময়ও বেশি পান। কারণ তাদের বাড়িতে গিয়ে রান্না করার ঝামেলায় পড়তে হয় না, যা বাংলাদেশের নারী শ্রমিকরা করে থাকেন। এ কারণে জর্ডানের শ্রমিকরা ওভারটাইমও বেশি পাচ্ছেন।

জাগো নিউজ : বাংলাদেশের সঙ্গে তুলনা করে জর্ডানের ব্যবসায়িক পরিবেশ নিয়ে কী বলবেন?

শোভন ইসলাম : বাংলাদেশের পরিবেশ বদলেছে। তবে জর্ডানের পরিবেশ বাংলাদেশ থেকে আলাদা, তা জোর দিয়েই বলা যায়। বাংলাদেশের মতো এত চ্যালেঞ্জ নিতে হয় না। জর্ডানে আমাকে বিদ্যুতের জন্য আলাদা করে ভাবতে হয় না। গ্যাস নিয়ে ভাবতে হয় না। যোগাযোগ ব্যবস্থা নিয়ে ভাবতে হয় না।

মধ্যপ্রাচ্যের অন্য দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা আছে। আমাদের কারখানা ইসরায়েলের সীমানা ঘেঁষে। কিন্তু আমাদের কোনো ধরনের সমস্যা মোকাবিলা করতে হয় না। রাজতন্ত্র হওয়ার কারণে জর্ডানে রাজনৈতিক অস্থিরতা নেই বললেই চলে। যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা ব্যবস্থাও সেখানে সক্রিয়। এ কারণে ব্যবসায়িক পরিবেশ নিয়ে কোনো ধরনের সমস্যায় পড়তে হয় না। যেকোনো সমস্যায় আমি সহায়তা চাইলে, জর্ডান সরকার এগিয়ে আসে।

জাগো নিউজ : এরপরও বিদেশের মাটিতে এমন একটি ফ্যাক্টরি করা তো চ্যালেঞ্জেরও বিষয়…

শোভন ইসলাম : অবশ্যই। কিন্তু ব্যবসা প্রসারের জন্য সে চ্যালেঞ্জ আপনাকে নিতে হবেই। আমি জর্ডানে ফ্যাক্টরি করে ক্রেতাদের খুব সহজেই আকৃষ্ট করতে পেরেছি। এতে করে আমার বাংলাদেশের পণ্যেরও চাহিদা বাড়ছে। বাইরের দেশের অনেকে তাই করেন। একাধিক রাষ্ট্রে তারা ফ্যাক্টরি করে থাকেন। কোরিয়ান ব্যবসায়ীদের অনেকেরই কোরিয়া, বাংলাদেশ, ভিয়েতনাম বা ইন্দোনেশিয়ায় ফ্যাক্টরি রয়েছে। কোরিয়ার ইয়াংওয়ান গার্মেন্ট কোম্পানি বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ করেছে। ইয়াংওয়ানের কিন্তু ভিয়েতনামেও ফ্যাক্টরি আছে।

বহু দেশে ফ্যাক্টরি থাকলে ক্রেতারা আপনাকে বড় আয়োজনে অর্ডার দিতে পারেন।

জাগো নিউজ : দেশের বাইরে ফ্যাক্টরি করতে গেলে বাংলাদেশ সরকার কীভাবে দেখে?

শোভন ইসলাম : বাংলাদেশ সরকার কোনো প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে না। কারণ ট্যাক্স দিয়েই বাইরে বিনিয়োগ করতে হয়। বাইরে গার্মেন্ট ফ্যাক্টরি করা নিয়ে নীতিমালাও করা হয়েছে।

আমি সেই নীতিমালার সুযোগ নিয়ে জর্ডানে বিনিয়োগ করেছি। আর ব্যবসার যে প্রসার সেটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই হয়েছে। অর্থাৎ ৬০০ শ্রমিক দিয়ে শুরু করে আজ দুই হাজার ২০০ শ্রমিকের যে ফ্যাক্টরি, তা রিসাইকেল (পুনরায়) বিনিয়োগের মাধ্যমেই।

জাগো নিউজ : আপনার প্রতিষ্ঠানের অগ্রযাত্রার কথা বললেন। বাংলাদেশের পোশাক খাত নিয়ে নেতিবাচক কথাও আছে। শ্রমিক শোষণের শিল্পও বলছেন অনেকে। এ অভিযোগের বিপরীতে কী বলবেন?

শোভন ইসলাম : কিছুটা অভিযোগ তো আছেই। আমার প্রতিষ্ঠানের শুরুটা ঠিক অন্যরকম। এরপরও নিজেকে ফেরেশতা বলব না।

বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যক্তিকে আমার প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ দিতে হয়। তারা কোনো না কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে আসেন। নিয়োগ দেয়ার পর তাদের আচরণ স্পষ্টতই সামনে চলে আসে। তাদের আচরণেই প্রকাশ পায় শ্রমিক শোষণের মানসিকতা। কারণ তারা আগের প্রতিষ্ঠানে শ্রমিকদের সঙ্গে তেমন আচরণই করেছেন।

sovon

এরপর সেই ব্যক্তিকে ব্যাপক প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। তাকে বলতে হয়, তুমি শ্রমিকদের সঙ্গে আস্তে কথা বলবা। কারও গায়ে হাত দেয়া যাবে না। এসব বিষয়ে আমরা একেবারে জিরো টলারেন্স। আর কারখানার পরিবেশ যখন সে বুঝতে পারে, তখন আগের মানসিকতা থেকে সে সরে আসে।

মালিকপক্ষের শোষণের চিত্র থাকলেও পোশাক খাত কিন্তু এখন অনেক দূর এগিয়েছে। আমার নিজের প্রতিষ্ঠানের কথাই শুধু বলছি না। সার্বিক বিবেচনা থেকেই বলছি, বাংলাদেশের গার্মেন্ট ঠিক আগের জায়গায় নেই।

জাগো নিউজ : তুলনা করে বলছেন?

শোভন ইসলাম : হ্যাঁ। বাংলাদেশের অনেক কারখানা এখন বিশ্বমানের। পাশের দেশ ভারত থেকেও আমরা এগিয়ে।

জর্ডানের অধিকাংশ কারখানায় আগে ইন্ডিয়া ও শ্রীলঙ্কা থেকে শ্রমিক আসত। এখন আমার কারখানার আশেপাশে প্রায় ৩০ হাজারের ওপরে বাংলাদেশি শ্রমিক কাজ করছেন। আমার কারখানার পাশেই ইন্ডিয়ার ক্ল্যাসিক নামের একটি কারখানা আছে। সেখানে প্রায় ১৫ হাজার বাংলাদেশি শ্রমিক রয়েছেন।

জাগো নিউজ : কী দেখছেন বাংলাদেশের গার্মেন্ট খাতের ভবিষ্যৎ?

শোভন ইসলাম : আমি আশাবাদী মানুষ। আমি অগ্রযাত্রাকেই সামনে এনে আলোচনা করি।

দেখুন, এখন কিন্তু শ্রমিকরাও আওয়াজ দিতে শুরু করেছেন। প্রতিটি কারখানায় শ্রমিক সংগঠন থাকা বাধ্যতামূলক এবং সে সংগঠনের কমিটি হতে হবে নির্বাচিত। এ সংগঠনের সঙ্গে আলোচনা করেই মালিকদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

শ্রমিকদের বেতন-ভাতাসহ যাবতীয় তথ্য এখন ডিজিটালাইজড হয়ে গেছে। এ কারণে ১০ মিনিট ওভারটাইম করলেও তা হিসাবে চলে আসছে। এটিএম কার্ডের মাধ্যমে বেতন তুলতে পারছেন। এতে শ্রমিক ও মালিকদের মধ্যে পেশাদারিত্বের বিষয়টি আরও গুরুত্ব পাচ্ছে। মালিক-শ্রমিক উভয়ই এখন বুঝতে পারেন একে-অপরের পরিপূরক।

এ কারণে বাংলাদেশের গার্মেন্ট এখন বিশ্বমানের বলে মনে করা হচ্ছে। কারখানাগুলো ক্রমশই পরিবেশবান্ধব হয়ে উঠেছে। অসংখ্য কারখানা ইতোমধ্যে পরিবেশ সার্টিফিকেট পেয়ে গেছে। বাকিগুলোও অপেক্ষায় রয়েছে। বলতে পারেন, পরিবেশের দিক দিয়ে বাংলাদেশের পোশাক শিল্প বিশ্বকে নেতৃত্ব দিচ্ছে।

এ কারণেই আমাদের গর্ব করার অনেক কিছুই এসে গেছে। আগে কম দামি পোশাক তৈরি করতে বায়াররা বাংলাদেশকে বেছে নিত। এখন পৃথিবীর যেকোনো বায়ার উন্নতমানের পোশাক তৈরি করতে বাংলাদেশকে বেছে নিচ্ছে। পোশাক খাতে বাংলাদেশই এখন সবচেয়ে বড় খেলোয়াড় বিশ্বে।

আমরা সব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেই এগিয়ে যাচ্ছি। এ চ্যালেঞ্জ মালিক ও শ্রমিক উভয়ই গ্রহণ করছেন। গত বছর পোশাক খাতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১১ শতাংশ। অথচ গত বছরও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ছিল। শ্রমিকদের বেতন কাঠামো নিয়ে সমস্যা ছিল। নতুন করে কোনো গ্যাস সংযোগ, বিদ্যুৎ সংযোগ দেয়া হয়নি। এর মধ্যে তিন বিলিয়ন ডলারের বেশি রফতানি, অনেক বড় অর্জন বলে মনে করি।

জাগো নিউজ : এ অর্জনের জন্য কোন বিষয়টিকে সামনে আনবেন?

শোভন ইসলাম : সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টার ফল। তবে আমি শ্রমিকদেরই অধিক ক্রেডিট দিতে চাই। কারণ শ্রমিকই পোশাক শিল্পের প্রাণ। তারা খুবই পরিশ্রমী ও মেধাবী।

আপনি গাজীপুর গিয়ে দেখবেন, বৃষ্টি হলেই শ্রমিকদের থাকার ঘরগুলোতে পানি ওঠে। অথচ ঘরে পানি রেখেই ঠিক ৮টার সময় এসে ফ্যাক্টরিতে উপস্থিত। এটিই আমাদের শক্তি।

একদিন এক নারী শ্রমিক এসে বললেন, ঘরে পানি ওঠায় তার নতুন কেনা ফ্রিজটি নষ্ট হয়ে গেল। স্বামী-স্ত্রী দুজনই আমার ফ্যাক্টরিতে চাকরি করেন। অথচ, ফ্রিজ নষ্ট হয়ে যাওয়া নিয়ে তার কষ্টের কোনো প্রকাশ দেখলাম না। ঠিকই কাজে চলে এসেছেন। বাংলাদেশের শ্রমিকের মতো স্পিরিট পৃথিবীর কোথাও নেই।

এ কারণেই আমাদের কেউ দমিয়ে রাখতে পারবে না। প্রতিবন্ধকতা যতই আসুক, আমরা নিজস্ব স্পিরিটের মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাব। রাষ্ট্র, সমাজের দোষ আছে। কিন্তু এসব দোষের মধ্যেও মানুষ একধরনের স্পিরিট ধারণ করে চলছে।

আমাদের শ্রমিকরা খুবই পরিশ্রমী। পোশাক শ্রমিকরা বিষয়টি আরও স্পষ্ট করেছেন।

এএসএস/এমএআর/এমএস

আরও পড়ুন