খসড়ার পর খসড়া হয়, কৃষি জমি সুরক্ষা আইন আর হয় না
কৃষি জমি সুরক্ষা ও ভূমি ব্যবহার নিয়ে প্রথম আইনের খসড়া হয় ২০১১ সালে। এরপর আট বছর কেটে গেছে। কিন্তু চূড়ান্ত হয়নি কৃষি জমি সুরক্ষা ও ভূমি ব্যবহার আইন। তবে শিগগিরই কৃষি জমি সুরক্ষা আইনের খসড়া চূড়ান্তের ঘোষণা দিয়েছে ভূমি মন্ত্রণালয়।
অপরিকল্পিত বাড়িঘর, রাস্তাঘাট, শিল্পকারখানা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নির্মাণ, ইটভাটা, সরকারি প্রকল্প বাস্তবায়ন, পুকুর-দিঘি খনন, মাছ চাষ ও নদী ভাঙনের ফলে ক্রমাগত প্রতি বছরই বিপুল পরিমাণ কৃষি জমি হারিয়ে যাচ্ছে, যা খাদ্য নিরাপত্তার উপর তৈরি করছে ঝুঁকি। কিন্তু কৃষি রক্ষায় কোনো আইন নেই। এ অবস্থায় গত ২৯ জুন জাতীয় সংসদে ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী বলেন, দেশের কৃষি জমি বিশেষভাবে ফসলি জমি রক্ষায় সরকারের সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা রয়েছে এবং এ উদ্দেশ্যে ভূমি মন্ত্রণালয় ‘কৃষি জমি সুরক্ষা ও ভূমি ব্যবহার আইন-২০১৯’ এর খসড়া প্রণয়ন করেছে। শিগগিরই মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে আইনের খসড়াটি পাঠানো হবে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর কৃষি পরিসংখ্যান বর্ষগ্রন্থ-২০১৭ অনুযায়ী দেশে মোট আবাদযোগ্য জমি ৮৫ লাখ ৭৭ হাজার হেক্টর। পরিকল্পনা কমিশনের হিসাবে, প্রতিবছর দেশে কৃষিজমি কমছে ৮২ হাজার হেক্টর, যা মোট জমির ১ শতাংশ।
দেশে দ্রুতহারে কমছে ফসলি জমির পরিমাণ। যা অচিরেই অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে। গত এক দশক আগের তুলনায় দ্রুত হারে কমেছে ফসলি জমির পরিমাণ। এটাকে খাদ্য নিরাপত্তার জন্য বড় একটি হুমকি বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
ভূমি মন্ত্রণালয় থেকে জানা যায়, খসড়া প্রণয়নের পর ২০১১ সালের ১৫ মে কৃষি জমি সুরক্ষা আইন নিয়ে তৎকালীন ভূমিমন্ত্রী রেজাউল করিম হীরার সভাপতিত্বে একটি আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা হয়। ওই সভায় তৎকালীন আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ, কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী, গৃহায়ণ ও গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী আব্দুল মান্নান খান, ভূমি প্রতিমন্ত্রী মোস্তফিজুর রহমানসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। এরপর জাতীয় পর্যায়ে একটি সেমিনার করে সংশ্লিষ্ট সকলের মতামত নিয়ে খসড়াটি চূড়ান্তের কথা থাকলেও আর কোনো অগ্রগতি হয়নি।
আরও পড়ুন > ‘আইন-কানুনে চলে না কোনো সাব-রেজিস্ট্রি অফিস’
তখন ওই খসড়ায় বলা হয়েছিল, বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী ভূমি জোনিং করা হবে। কৃষি জমি শুধুমাত্র কৃষি কাজেই ব্যবহার করতে হবে। কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান এ আইন লঙ্ঘন করলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের নির্বাহী বা সহায়তাকারীকে সর্বোচ্চ দুই বছরের কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ ১০ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয়দণ্ডে দণ্ডিত হবে।
আইনের খসড়ায় আরও বলা হয়েছিল, দেশের নদী, খাল, হাওর, বাওড়, বিল, হাটবাজার, বালুমহাল, পাথরমহাল, বাগান, বনভূমি, টিলা-পাহাড়, সবার জন্য ব্যবহৃত ভূমির (খেলার মাঠ, সড়ক, জনপথ, রেল লাইন ও তার পার্শ্ববর্তী জমি ইত্যাদি) কোনো শ্রেণি পরিবর্তন করা যাবে না। তবে যাদের স্বল্প পরিমাণ (৩-৫ শতক) কৃষি জমি আছে তাদের ক্ষেত্রে বসতবাড়ি নির্মাণে এ বিধান কিছুটা শিথিল হবে।
পরে খসড়াটি ভিত্তি ধরে ২০১৫ সালে আরেকটি খসড়া করা হয়। সেখানে কৃষি জমির ব্যবহারভিত্তিক শ্রেণি পরিবর্তনের শাস্তি প্রস্তাব করা হয় সর্বোচ্চ ৫ বছরের কারাদণ্ড বা কমপক্ষে এক লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড। এ খসড়াটিও পরে আলোর মুখ দেখেনি।
এর পরের বছর করা হয় ‘কৃষি জমি সুরক্ষা ও ভূমি ব্যবহার আইন-২০১৬’ এর খসড়া। এখানে আইন লঙ্ঘনের শাস্তি নির্ধারণ করা হয় সর্বোচ্চ ৩ বছরের কারাদণ্ড এবং কমপক্ষে ৩ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয়দণ্ড। এছাড়া ওই কৃষি জমি সরকার বাজেয়াপ্ত করতে পারবে।
আবার ‘কৃষি জমি সুরক্ষা ও ভূমি ব্যবহার আইন-২০১৯’ এর প্রাথমিক খসড়ায় আইন লঙ্ঘনের শাস্তি নির্ধারণ করা হয় সর্বোচ্চ দুই বছরের কারাদণ্ড বা সর্বনিম্ন তিন লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড।
কৃষি জমি সুরক্ষা ও ভূমি ব্যবহার আইনের বিষয়ে জানতে চাইলে ভূমি সচিব মো. মাকছুদুর রহমান পাটওয়ারী জাগো নিউজকে বলেন, ‘সামগ্রিকভাবে খসড়াটা আমরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছি। সংশ্লিষ্ট দফতরগুলোর মতামত নিচ্ছি। এটা অনেক বড় একটা বিষয়, এটা নিয়ে আমরা আন্তঃমন্ত্রণালয় সভাও করব।’
ভূমি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (আইন) আনিস মাহমুদ বলেন, ‘কৃষি জমি সুরক্ষা আইনের খসড়া চূড়ান্ত করতে আমরা স্টেকহোল্ডারদের মতামত নিচ্ছি। খুব সহসাই খসড়াটি চূড়ান্ত করে ফেলব।’
ভূমি মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে জানান, গত ১২ সেপ্টেম্বর আন্তঃমন্ত্রণালয় সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কৃষি জমি সুরক্ষা আইনের আগের খসড়াটি সংশোধন করা হয়েছে। সংশোধিত আইনের খসড়া জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে প্রমিতকরণের পর মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানো হয়। পরে গত ১০ জানুয়ারি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের অতিরিক্ত সচিবের সভাপতিত্বে খসড়ার উপর একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় খসড়া আইনটির উপর কিছু সংশোধনীর সুপারিশ করা হয়। সুপারিশ অনুযায়ী আইনটি সংশোধন ও খসড়া আইনের অন্য বিষয়গুলো পর্যালোচনার জন্য গত ২৩ জানুয়ারি ভূমি সচিবের সভাপতিত্বে অভ্যন্তরীণ পর্যালোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় প্রস্তাবিত আইনটি ‘কৃষি জমি সুরক্ষা ও ভূমি ব্যবহার আইন-২০১৯’ নামে পুনর্গঠনের সিদ্ধান্ত হয়। সেই অনুযায়ী আইনের খসড়া সংশোধন করে পুনর্গঠিত আইনটির উপর সংশ্লিষ্ট সব মন্ত্রণালয় বা বিভাগের মতামত চাওয়া হয়েছে।
আরএমএম/এএইচ/জেআইএম