ভিডিও EN
  1. Home/
  2. বিশেষ প্রতিবেদন

কথিত উন্নয়নই নয়ন বন্ডের মতো সন্ত্রাসী তৈরি করে

সায়েম সাবু | প্রকাশিত: ০৩:৩০ পিএম, ১১ জুলাই ২০১৯

অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ। অর্থনীতিবিদ। অধ্যাপনা করছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে। শিক্ষকতার পাশাপাশি বিশ্বব্যাপী সব ধরনের নিপীড়নের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সক্রিয়। বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সম্পদে জনগণের মালিকানা প্রতিষ্ঠায় সংগ্রাম করছেন দীর্ঘদিন ধরে। তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা কমিটির সদস্য সচিবের দায়িত্ব পালন করছেন।

গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির প্রসঙ্গ নিয়ে সম্প্রতি মুখোমুখি হন জাগো নিউজ’র। দীর্ঘ আলোচনায় অর্থনীতি, জ্বালানিউন্নয়নের নানা অসঙ্গতির কথা তুলে ধরেন। তিন পর্বের সাক্ষাৎকারের আজ থাকছে শেষটি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সায়েম সাবু।

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

জাগো নিউজ : বাংলাদেশ তো উন্নয়নের মহাসড়কে। বড় বড় প্রকল্প হচ্ছে। অথচ আগের পর্বে ‘বিজ্ঞাপনী উন্নয়ন’ বললেন...

আনু মুহাম্মদ : সরকার উন্নয়ন নিয়ে সফল ক্যাম্পেইন করতে পারছে। রাস্তা, সেতু, নতুন নতুন গাড়ি উন্নয়নের সূচক বলে মানুষের মাঝে ধারণা দেয়া হয়েছে। এ ধারণা যে কত বড় বিপদের কারণ হতে পারে, তা নিয়ে বহু আলোচনা আছে।

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

অর্থশাস্ত্রে টেকসই উন্নয়ন বলতে একটা কথা আছে। প্রধানমন্ত্রী চীনে গিয়ে টেকসই উন্নয়নের কথা বলে বক্তব্য দিলেন। ভালো কথা। কিন্তু আমরা উন্নয়নের নামে কী দেখছি? টেকসই উন্নয়ন হচ্ছে, ভবিষ্যৎ নিরাপদহীন না করে। নদী ভরাট করে রাস্তা বানিয়ে আপনি জিডিপি বৃদ্ধি দেখাতেই পারেন। কিন্তু ৫০ বছর পর ওই নদী ভরাটের যে ক্ষতি, তা আপনি কোনোভাবেই পূরণ করতে পারবেন না। সুন্দরবন ধ্বংস করে যেসব প্রকল্প নেয়া হচ্ছে তাতে জিডিপি বাড়বে। কারণ, সুন্দরবন নিজে জিডিপি বাড়াতে সরাসরি ভূমিকা রাখছে না। কিন্তু দেশকে তো বাঁচিয়ে রাখছে।

আরও পড়ুন >> গ্যাসের সংকট বাড়াতেই নিষ্ক্রিয় করে রাখা হয়েছে বাপেক্সকে

বিজ্ঞাপন

ঢাকার নদীগুলো যদি ভালো থাকত, তাহলে দুই কোটি মানুষের ফুসফুস ভালো থাকত। চিকিৎসা ব্যয় কমে যেত। জীবন নিরাপদ থাকত। কিন্তু সরকার ওষুধের ব্যবহার বাড়িয়ে জিডিপির বৃদ্ধি দেখাতে চায়। জিডিপির মোহ মারাত্মক। জিডিপি মানে উন্নয়ন নয়। জিডিপি মানে হচ্ছে আর্থিক লেনদেন।

জিডিপি মার্কা উন্নয়নে জাতীয় সক্ষমতা অর্জন অথবা নিজস্ব সংস্কৃতিনির্ভর উন্নয়ন নেই। জিডিপিনির্ভর উন্নয়ন আচ্ছন্নতা তৈরি করে। উচ্চ ভবন, সেতু, রাস্তা দেখিয়ে মানুষকে তৃপ্তি দেয়া হচ্ছে। পদ্মা সেতুর বিজ্ঞাপনী ক্ষমতা আছে। অথচ সারাদেশে কয়েকশ সেতু অচল হয়ে পড়ে আছে, সেখানে সরকারের নজর নেই। কারণ এসব ছোট সেতুর বিজ্ঞাপনী ক্ষমতা নেই। অথচ কয়েকশ কোটি টাকা ব্যয় করলেই এসব সেতু মেরামত করা সম্ভব। তা না করে সরকার ৩০ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করে পদ্মা সেতু বানাচ্ছে।

রেললাইনের উন্নয়ন নেই। নাট-বল্টু খুলে আছে। অথচ সরকার উচ্চগতিসম্পন্ন ট্রেনের গল্প শোনাচ্ছে। আমরা এক অদ্ভুত পরিস্থিতির মধ্যে আছি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতালের অবকাঠামো নির্মাণে গুরুত্ব নেই। রাস্তাঘাট অচল সারাদেশে। রেল ছিটকে পড়ছে। সর্বত্রই বৈষম্য। কোনো জবাবদিহিতা নেই। শিক্ষিত জনবল তৈরির বিশাল ঘাটতি রেখে এমন সব প্রকল্পের ক্রমাগত বিজ্ঞাপন দেখানো হচ্ছে, যা দেখে মানুষ নিজের অধিকারও ভুলে যাচ্ছে।

বিজ্ঞাপন

বুড়িগঙ্গা নদীকে নর্দমা বানিয়ে এখন বলা হচ্ছে, এ নদীকে আমরা হাতিরঝিল বানাব। কতটা নির্বোধ হলে এমন পরিকল্পনার কথা বলতে পারে? নদীকে ঝিল বানানো, গ্রামকে শহর বানানোর পরিকল্পনা হচ্ছে অসুস্থ চিন্তার প্রকাশ। চরম দুঃখের মাঝে থেকে মানুষ যেমন বিনোদনের জন্য সিনেমা দেখে, সরকার সেই বিনোদন তৈরি করে চলছে।

ক্রসফায়ার, আটক বাণিজ্য, নিয়োগ বাণিজ্য, গুম, ধর্ষণে মানুষের জীবন জর্জরিত। অথচ সরকারের বিজ্ঞাপনী উন্নয়নে তুষ্ট থাকার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। কথিত উন্নয়ন যে আমাদের বড় বিপদ ডেকে আনছে, তা মানুষ জানছে না। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের বর্জ্য কোথায় ফেলবে, এটা মানুষ জানছে না। এর পরিবেশগত ব্যয় নিয়ে ভাবনা নেই। দুর্ঘটনা হলে কী করবে, তার কিছুই জানে না এর আশপাশের প্রায় নব্বই লাখ মানুষ। মানুষের সঙ্গে কোনো আলোচনাই করা হয়নি। আলোচনা করলে এ প্রকল্প হতো না।

রামপাল প্রকল্প নিয়ে মন্ত্রণালয়ের কর্তারা বলছেন, এটা সুন্দরবনের কোনো ক্ষতি করবে না। অথচ বুড়িগঙ্গা তার চোখের সামনে। রূপপুর নিয়ে প্রযুক্তিমন্ত্রী বলছেন, আমরা সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছি। অথচ রানাপ্লাজার ধস ঠেকাতে পারিনি।

বিজ্ঞাপন

ঝলকের উন্নয়ন দিয়ে মানুষকে ঘোরে রাখা যাচ্ছে বটে, কিন্ত এ ঘোর তো একসময় বিপদের কারণ হবেই। আমরা উন্নয়নের নামে এক অভিশপ্ত জায়গায় দাঁড়িয়ে আছি।

জাগো নিউজ : তাই বলে এ উন্নয়ন একেবারেই খারিজ করে দেবেন?

আনু মুহাম্মদ : খারিজের বিষয় নয়। বিজ্ঞাপনী উন্নয়ন মানুষের কল্যাণ বয়ে আনতে পারে না। হাজার হাজার কোটি টাকা দিয়ে ফ্লাইওভার তৈরি করে কার উন্নয়ন হচ্ছে? বাংলাদেশে রাস্তা নির্মাণ, সেতু নির্মাণের ব্যয় সবচেয়ে বেশি। এসব ব্যয়ে কমিশনও বেশি। যারা ঠিকাদার তারাই ব্যয় নির্ধারণ করছেন। এখানে কোনো জবাবদিহিতা নেই।

বিজ্ঞাপন

জাগো নিউজ : সম্ভাবনার কথা কী বলবেন?

আনু মুহাম্মদ : বাংলাদেশের বিশাল সম্ভাবনা আছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন না করে আপনি সে সম্ভাবনা কাজে লাগাতে পারবেন না।

বাংলাদেশের পাটশিল্প অপার সম্ভাবনার জায়গা। এ শিল্পের ওপর বাংলাদেশ দাঁড়িয়ে যেতে পারত। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, চীন থেকে শিক্ষা নিতে হবে। চীন তো বিপ্লবের মধ্য দিয়ে ভিত্তি দাঁড় করিয়েছে। আমরা কী করেছি?

বিজ্ঞাপন

শিক্ষার উন্নয়নে ব্যয় না করে অযথা উন্নয়নের নামে অর্থ অপচয় করা হচ্ছে। আমাদের জন্য উন্নয়ন দরকার ছিল রেলপথের, নৌপথের। অথচ সব দখল হয়ে গেছে। সড়কে প্রাণ ঝরছে অনবরত। সরকারের পক্ষ থেকে কোনো উদ্যোগ নেই।

আরও পড়ুন >> দেরি চীনা ব্যাংকের, ৬৬৫ কোটি গচ্চা বাংলাদেশের!

বড় বড় ভবন দেখবে আর ঢাকার মানুষ বিষাক্ত বাতাস নেবে- এটাকে টেকসই উন্নয়ন বলে না। বিদ্যুতের দরকার বলে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সুন্দরবন ধ্বংস হবে- এটাকেও টেকসই উন্নয়ন বলে না।

জাগো নিউজ : এমন প্রতিবন্ধকতার মাঝে এগিয়ে যাওয়ার গল্পও আছে...

আনু মুহাম্মদ : এগিয়ে যাওয়ার গল্প আছে বলেই আফসোসটা বেশি। মানুষের উদ্যম থেকে আমরা সম্ভাবনা দেখতে পাই।

প্রায় এক কোটি মানুষ দেশের বাইরে। তারা হাজার হাজার কোটি ডলার রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছে। যাদের জীবন হুমকির মধ্যে। প্রতি বছর শত শত লাশ আসছে। অকাল মৃত্যু হয় শ্রমিকদের।

গ্রামের অশিক্ষিত, অল্পশিক্ষিত নারীরা শহরে এসে গার্মেন্টে শ্রম দিচ্ছে। প্রায় ৪০ লাখ পোশাক শ্রমিক বিদেশি মুদ্রা অর্জনে বড় ভূমিকা রাখছে।

কৃষকরা উৎপাদন বাড়িয়ে খাদ্যনিরাপত্তা গড়ে তুলছে। অথচ তারা ফসলের দাম পাচ্ছে না। কৃষক আত্মহত্যা করছে। ফসলের ক্ষেত জ্বালিয়ে দিচ্ছে।

এগুলোই হচ্ছে আমাদের শক্তির জায়গা। অথচ আমরা এ শক্তির ব্যাপারে অবগতই নই। প্রবাসীরা হাজারও কষ্ট করে টাকা পাঠাচ্ছে। ক্ষমতার বলয়ে থাকা অল্পকিছু মানুষ সে টাকা বিদেশে পাচার করছে। গরিব মানুষের উন্নয়নের ঝুড়ির তলাটা ফুটো করে দিচ্ছে। কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। অথচ উন্নয়নের জন্য এ টাকাটার ভালো ব্যবহার হতে পারত।

জাগো নিউজ : ভরসা করছেন কোথায়?

আনু মুহাম্মদ : আমাদের তরুণরাই বিদেশে গিয়ে বিদ্যুৎ প্রকল্প চালাচ্ছে। রাস্তা নির্মাণ করছে। ভবন তৈরি করছে। তরুণরাই ভরসার জায়গা। অথচ বাংলাদেশের নীতিনির্ধারণে সেসব তরুণের কোনো জায়গা নেই। বিদেশিরা এসে কর্তৃত্ব দেখাচ্ছে।

পাওয়ার সেক্টরের মাস্টারপ্ল্যান-২০১৬ তে একজন বাংলাদেশিকেও রাখা হয়নি। তরুণদের মধ্যে যথেষ্ট সক্ষমতা আছে। একটু জায়গা দিলেই তারা প্রমাণ দিতে পারে। সেই সুযোগটা দিলে বাংলাদেশ বহু দূর এগিয়ে যেত।

উন্নয়নের কেন্দ্রে মানুষকে রাখলেই ভারসাম্য ফিরে আসবে বলে মনে করি। জিডিপি বা বিজ্ঞাপনীনির্ভর উন্নয়ন থেকে সরে আসতে হবে। এজন্য জনগণের মধ্য থেকে আওয়াজ তুলতে হবে। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিকভাবে সচেতন হওয়াও জরুরি।

শিক্ষিতজনরাই এসব বিষয়ে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখতে পারেন। অথচ তারাই কেউ নিজেদের স্বার্থে, কেউ দায়িত্বহীনতার কারণে আবার কেউ ভয়ের কারণে নীরব রয়েছেন অথবা বিভাজিত হয়েছেন। এ চিত্রটাই আমাদের কাছে বিপজ্জনক বলে মনে হয়।

কথিত উন্নয়নই নয়ন বন্ডের মতো সন্ত্রাসী তৈরি করে। হাতুড়ি বাহিনী, হেলমেট বাহিনী তৈরি করে। এমন উন্নয়ন বলয়ে থাকে বলেই ছাত্ররা শিক্ষকের গায়ে কেরোসিন দেয়। এগুলো নিয়ে প্রশ্ন না করে, সমালোচনা না করে যেসব বুদ্ধিজীবী চুপচাপ বসে আছেন, তারাই সমাজের বড় অপরাধী।

ক্রসফায়ার আর কুপিয়ে মারার মধ্যে কোনো তফাৎ নেই। এটা বুঝতে পেরেও যে শিক্ষিতজনরা নীরবতা পালন করছেন সেটাই ভয়ের কথা। কারণ সমাজে চূড়ান্ত পচন ধরলে আমরা কেউই রক্ষা পাব না। তবে তরুণরাই হয়তো এ পচন ঠেকাবে। আমি অন্তত মুক্তিযুদ্ধের সেই চেতনা তরুণদের মাঝেই খুঁজে পাই।

এএসএস/এমএআর/পিআর

আরও পড়ুন

বিজ্ঞাপন