ভিডিও EN
  1. Home/
  2. বিশেষ প্রতিবেদন

চলমান উন্নয়ন ধারা ভয়ঙ্কর বৈষম্য সৃষ্টি করছে

সায়েম সাবু | প্রকাশিত: ০৯:৫৩ পিএম, ৩০ জুন ২০১৯

রাশেদ খান মেনন। সভাপতি, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি। সাবেক মন্ত্রী। বামপন্থী এ রাজনীতিক মহাজোট গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। সরকারের নেতিবাচক কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করছেন জোটে থেকেও।

জোট গঠনের সার্থকতা, রাজনীতি, উন্নয়ন, অর্থনীতির নানা প্রসঙ্গ নিয়ে মুখোমুখি হন জাগো নিউজের। চলমান উন্নয়ন ধারার সমালোচনা করে বলেন, ‘এতে করে সমাজে বৈষম্য ভয়াবহ রূপ নিয়েছে।’

রাষ্ট্র সাধারণ মানুষের অধিকার রক্ষা করতে পারছে না উল্লেখ করে বলেন, ‘ক্ষমতার ভারসাম্যহীনতার কারণে সমাজে সহিংসতা বাড়ছে।’

দুই পর্বের সাক্ষাৎকারের আজ থাকছে প্রথমটি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সায়েম সাবু

জাগো নিউজ : মহাজোট সরকার এক দশক পার করল। জোট গঠনের সময় বিশেষ লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের কথা জানান দিয়েছিল। বিশেষ করে প্রগতির ধারায় অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় নিয়ে আওয়ামী লীগের সঙ্গে পথচলা। সেই লক্ষ্য-উদ্দেশ্য নিয়ে এখন কী বলবেন?

রাশেদ খান মেনন : বিশেষ প্রেক্ষাপটে আমরা মহাজোট গঠন করি। বিএনপি-জামায়াতের দুঃশাসনে মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছিল। রাষ্ট্রীয়ভাবে মৌলবাদের বিস্তার ঘটানো হয়েছে। আমরা জোট গঠন করে ক্ষমতায় গিয়ে এ পরিস্থিতির অবসান করতে চেয়েছিলাম। একই সঙ্গে আমরা নির্বাচন ব্যবস্থার পরিবর্তনেও অঙ্গীকারাবদ্ধ ছিলাম। ২০০৮ সালের পর পাঁচ বছর মহাজোট একটি বিশেষ পরিবর্তনের মধ্যে রাষ্ট্র পরিচালনা করে। সেই সময়ে যুদ্ধাপরাধের মতো বিচারও আমরা একটি কাঙ্ক্ষিত জায়গায় আনতে পারলাম। যে বিচারের বিরুদ্ধে জামায়াত-শিবির যুদ্ধ ঘোষণা করল।

বিশেষ পরিস্থিতি সৃষ্টি করে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি বিএনপি নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াল। একটি বড় দল নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ালে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হয় না, এটিই স্বাভাবিক। তা-ই হলো। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ১৫৪ জন সংসদ সদস্য নির্বাচিত হলো। আমিও নির্বাচিত হলাম। তবে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়া অপরাধের নয়। ১৯৯৬ সালের ৫ জানুয়ারি বিএনপির ৫৪ এমপি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছিল।

গত ১০ বছরে বিএনপি আসলে রাজনীতির মাঠে ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। আর সংসদ বা মাঠে শক্তিশালী বিরোধী দল না থাকলে ক্ষমতাসীনরা বিনা বাধায় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার সুযোগ পায়। এখন তা-ই হয়েছে।

আরও পড়ুন >> দেশ-স্বাধীনতা-ধর্মে বিভেদ নয়, জন-আকাঙ্ক্ষা পূরণই লক্ষ্য

জাগো নিউজ : তার মানে সত্যিকার বিরোধী দলহীন সংসদ স্বৈরনীতি অবলম্বন করছে…

রাশেদ খান মেনন : আমি ঠিক স্বৈরনীতি শব্দটি ব্যবহার করতে চাই না। ২০০৮ সালে ক্ষমতায় আসার পর আমি সংসদে বাজেট আলোচনায় বৈষম্য কমিয়ে এনে সামাজিক নিরাপত্তার কথা বলেছিলাম। এখনও বলছি। ওই বাজেটে জনকল্যাণের বিষয়টি মাথায় নিয়েই বরাদ্দ দেয়া হয়।

কিন্তু পরের বাজেটেই আর সাধারণ মানুষের বাজেট থাকল না। অর্থনীতি চলে গেল একেবারেই উন্নয়নকেন্দ্রিক। আমরা অবশ্যই উন্নয়নকে সমর্থন করি। কিন্তু বাজেটনির্ভর উন্নয়ন চলে গেল একেবারে গুটিকয়েক মানুষের হাতে। আমরা উন্নয়নের ধারাকে একেবারে ভিন্নভাবে উপস্থাপিত হতে দেখলাম। উন্নয়নে সাধারণের অংশ এবং জনকল্যাণের বিষয়টি ক্রমশই স্তম্ভিত হয়ে গেল।

আমি বারবার সংসদে বলেছি, চলমান উন্নয়ন ধারা ভয়ঙ্কর বৈষম্য সৃষ্টি করছে। যে কথা সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত স্বীকার করেননি। সম্পদ কুক্ষিগত হচ্ছে গুটিকয়েক মানুষের হাতে। আমি সচেতনভাবে বলছি, সমাজের বৈষম্য একটি ভয়ঙ্কর জায়গায় চলে যাচ্ছে।

জাগো নিউজ : অথচ আপনারা জনকল্যাণের কথা বলে মহাজোট গঠন করেছিলেন। আর এখন সচেতনভাবে বলছেন, বৈষম্য ভয়ঙ্কর জায়গায় চলে গেছে!

রাশেদ খান মেনন : হ্যাঁ, আমি সচেতনভাবেই ভয়ঙ্কর বৈষম্যের কথা বলছি। মহাজোট সরকারের শুরুতে বৈষম্যের গ্রোথ ছিল ০.৪৫ শতাংশ। সেটি যদি ০.৫ শতাংশে চলে যায়, তা অবশ্যই বিপদজনক। আমরা তা-ই হতে দেখেছি। অথচ মুহিত সাহেব সেই বিপদের কথা স্বীকার করেননি। আমরা আরেকটি বিষয় নিয়ে জোর দিয়ে কথা বলেছিলাম। কর্মসংস্থান না হলে সমাজে স্থিরতা আসবে না। লাখ লাখ শিক্ষিত তরুণ কর্মসংস্থানের সুযোগ না পেয়ে হতাশ। অথচ সেদিকে নজর না দিয়ে একতরফা উন্নয়ন করা হচ্ছে।

আরও পড়ুন >> পণ্যের মান নিয়ে ঢাবি শিক্ষকদের গবেষণা প্রতিবেদন বোগাস!

বেসরকারি বিনিয়োগ ও ব্যক্তি উদ্যোগের জায়গা যদি প্রসারিত না করা যায়, তাহলে কর্মসংস্থানের পথ আটকে যায়। সরকার পিপিপি (পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ) নিয়ে আসল। কাজে দিল না। এ বৈষম্যের উন্নয়নে সমাজে দুটি ধারা সৃষ্টি হয়েছে। প্রথমত, যারা এ উন্নয়নে অংশ নিতে পারছেন, তারা রাতারাতি বিত্তবান হচ্ছেন। দ্বিতীয়ত, যারা এ উন্নয়নে অংশ নিতে পারেননি, তারা আরও গরিব হচ্ছেন। আর অংশ না নেয়ার সংখ্যা ৯৫ ভাগ।

জাগো নিউজ : রাষ্ট্রীয় উন্নয়নের ধারা তো কোনো না কোনোভাবে সাধারণ মানুষকেও প্রভাবিত করে…

রাশেদ খান মেনন : উন্নয়ন প্রভাবের আনুপাতিক বিশ্লেষণ জরুরি। পদ্মা সেতু, কর্ণফুলী টানেল, পায়রা বন্দর, মেট্রোরেলের মতো দৃশ্যমান উন্নয়ন জনমনে স্বস্তি দেবেই। আমাদের গড় মাথাপিছু আয় বেড়েছে কয়েকগুণ। আমেরিকার অর্থনীতিবিদরা বলেছিলেন, বর্তমান মাথাপিছু আয়ের জন্য আমাদের ১২৫ বছর অপেক্ষা করতে হবে। আমরা এক দশকেই তা করতে পেরেছি।

প্রশ্ন হচ্ছে, গড় হিসাব দিয়ে আপনি সাধারণের মাথাপিছু মূল্যায়ন করতে পারবেন না। সাধারণ মানুষের ভাগ্যে কী পরিবর্তন হলো, সেটাই বড় বিষয়। বৈষম্যের উন্নয়ন যে সমাজের ভারসাম্য নষ্ট করছে, তা এখন যেকোনো সচেতন ব্যক্তিই বলতে পারবেন। অর্থ চলে যাচ্ছে ধনী লোকের পকেটে। তা-ও গরিবের পকেট কেটে।

জাগো নিউজ : এ উন্নয়ন তাহলে বাংলাদেশকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে?

আরও পড়ুন> জোট-মহাজোটে দূরত্ব বাড়ছে!

রাশেদ খান মেনন : সাবেক অর্থমন্ত্রী মুহিত সাহেব তার শেষবারের বাজেট বক্তব্যে বলেছেন, ‘সমতা এবং ন্যায্যতার ভিত্তিতে আমরা উন্নয়নের ধারা তৈরি করতে পারিনি’। অথচ আমি এক দশক আগে থেকেই তা বলে আসছিলাম। তিনি শেষ বেলায় স্বীকার করলেন। এবারের বাজেটে আশা করেছিলাম, জনকল্যাণের উন্নয়নে সরকার গুরুত্ব দেবে। নিরাশ হয়েছি। সেই একই ধারায় ধনী লোকের দিকে ঝুঁকে পড়েছে রাষ্ট্রীয় উন্নয়ন। ধনী লোকদের মধ্যেও আবার সবাই না। যারা ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকতে পারছেন, তারাই উন্নয়নের বড় সুবিধা নিচ্ছেন। এর প্রমাণও আছে।

আওয়ামী লীগের মোহাম্মদ নাসিম সাহেবই বললেন, একই ব্যক্তিরা বড় বড় ঠিকাদার, ব্যাংকের মালিক, গার্মেন্টের মালিক, আমদানি-রফতানি ব্যবসায়ী। এমনকি বিদেশে লোক পাঠানোর এজেন্সিগুলোও একই ব্যক্তিদের দখলে। বিশেষ একটি সিন্ডিকেট গরিবের অধিকার হরণ করে বিশাল অর্থের মালিক হচ্ছেন। উন্নয়নে এগিয়ে যাব, এতে কোনো সন্দেহ নেই। দারিদ্র্য অর্ধেকে কমিয়ে আনা এ সরকারের বড় সাফল্য। অতি-দরিদ্রের হার ২৬ শতাংশ থেকে কমে ১১ শতাংশে নেমে এসেছে। কিন্তু আপনাকে পৃথিবীর এগিয়ে যাওয়াও আমলে নিতে হবে।

বাংলাদেশে এখনও চার কোটি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে। তাদের মধ্যে দুই কোটি মানুষ অতি-দরিদ্র। এ বিপুলসংখ্যক মানুষকে তো আমরা উন্নয়নের মূল স্রোতে আনতে পারিনি। ১৮ কোটি মানুষের মধ্যে চার কোটি মানুষকে দরিদ্র রেখে আপনি তো সমাজে ভারসাম্য রক্ষা করতে পারবেন না। ভারসাম্য হারাচ্ছে অর্থনীতিতে, রাজনীতিতেও।

স্বাস্থ্য খাতে উন্নয়ন হয়েছে। কিন্তু এখনও সাধারণ মানুষকে চিকিৎসা নিতে গিয়ে পকেট থেকে শতকরা ৬৪ টাকা ব্যয় করতে হয়। কমিউনিটি হাসপাতাল সরকারের বড় অর্জন। চিকিৎসা খাতের অবকাঠামোর উন্নয়ন হলো। কিন্তু গ্রামের হাসপাতালে তো ডাক্তার খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। মানুষ তো দেশের বাইরে চিকিৎসা নিতে যাচ্ছে।

জাগো নিউজ : অবহেলা তো কৃষি খাতেও?

রাশেদ খান মেনন : এটি অবাক হওয়ার মতো। কৃষক আমাদের খাদ্য নিরাপত্তা গড়ে দিল। অথচ কৃষকের নিরাপত্তা সরকার গড়ে দিতে পারল না। কৃষক ঘাম ঝরিয়ে ফসল ফলাচ্ছে। সেই ফসলের মূল্য দিতে পারছে না সরকার। কৃষককে রক্ষা করতে না পারলে, সরকার তাহলে কার জন্য কাজ করছে? এটি আমি পার্লামেন্টেও বলেছি। বলছি, সর্বত্র।

এএসএস/এমআরএম/এমএআর/এমএস

আরও পড়ুন