সম্মানিতে সংসার চলে, বেতন থাকে ব্যাংকে
‘ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকতর উন্নয়ন’ প্রকল্পে সম্মানি ভাতার জন্য থোক বরাদ্দ ৫০ লাখ টাকা। নিয়মিত দায়িত্বের অংশ হলেও প্রকল্পের সভায় অংশ নেয়ার জন্য প্রকল্প-সংশ্লিষ্ট ও সরকারি কর্মকর্তাদের মাঝে সম্মানি ভাতা হিসেবে এ অর্থ বরাদ্দ রাখা হয়েছে।
শুধু ওই প্রকল্প নয়, বর্তমান সরকারের দু-একটি বাদে সবগুলো প্রকল্পেই সভায় অংশগ্রহণের জন্য সরকারি কর্মকর্তাদের বিশেষ সম্মানি ভাতা প্রদানের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। এ অর্থের পরিমাণ পাঁচ থেকে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত দাঁড়ায়। পদ অনুসারে সম্মানি ভাতার পরিমাণ নির্ধারণ হয়।
আরও পড়ুন >> ৩০ হাজার কোটি টাকা ছাড়াল পদ্মা সেতু প্রকল্পের ব্যয়
প্রকল্পের সভায় অংশ নিয়ে সরকারি কর্মকর্তারা সম্মানি হিসেবে যে অর্থ পান, তা কখনও কখনও মূল বেতনেরও দ্বিগুণ হয়ে যায়। এ কারণে কোনো কোনো কর্মকর্তার মূল বেতনে হাত-ই দেয়া লাগে না। জনগণের অর্থ এভাবে ব্যয়ের পক্ষপাতি নয় খোদ সরকারি কর্মকর্তাদের একাংশ।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এমন এক সচিব জাগো নিউজকে বলেন, ‘একটা জিনিস আপনাদের খোলামেলাই বলি। আমাদের একজন সচিব আছেন, নাম বলা যাচ্ছে না; উনি বলেন, তিনি যে সম্মানি পান, তাতে তার বেতনের টাকা তুলতে হয় না। উল্টো উনি প্রতি মাসে যে সম্মানি পান তাতে পুরো মাস চলে যায়। এমনও হয়, বেতনের চেয়ে দ্বিগুণ অর্থ ব্যাংকে জমা হয়।’
যত বেশি প্রকল্প তত বেশি সম্মানি
গত ১৮ জুন শেরেবাংলা নগরের জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় মোট ১১টি প্রকল্পের অনুমোদন দেয়া হয়। এর মধ্যে ‘ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকতর উন্নয়ন’ প্রকল্প ছাড়াও ছয়টি প্রকল্পের সম্মানির ওপর আলোকপাত করা হয়। এতে দেখা যায়, প্রকল্পগুলোতে ছয় লাখ থেকে ৫০ লাখ পর্যন্ত টাকা সম্মানি ভাতার জন্য বরাদ্দ আছে।
আরও পড়ুন >> আসবাব কিনতে ও ফ্ল্যাটে ওঠাতেই সাড়ে ২৫ কোটি টাকা!
এর মধ্যে ‘রাসায়নিক গুদাম নির্মাণ’ প্রকল্প ২০১৯ সালের মার্চ থেকে ২০২০ সালের জুনের মধ্যে বাস্তবায়নের কথা। এই ১৫ মাসে প্রকল্পের সভায় অংশ নেয়া কর্মকর্তাদের জন্য সম্মানি হিসেবে বরাদ্দ রাখা হবে ছয় লাখ টাকা।
সম্মানির সঙ্গে আপ্যায়ন, যাতায়াত কিংবা পরিচ্ছন্নতার খরচ এক করার সুযোগ নেই। প্রায় প্রতিটি খাতে আলাদা আলাদা অর্থ বরাদ্দ আছে। দেখা গেছে, একটি মন্ত্রণালয়/বিভাগে যদি ৩০টি প্রকল্প থাকে, তাহলে প্রায় প্রতিটি প্রকল্পের জন্য আলাদা আলাদা সম্মানি, আপ্যায়ন, যাতায়াত খরচের জন্য বরাদ্দ আছে। যেমন- ‘রাসায়নিক গুদাম নির্মাণ’ প্রকল্পে আপ্যায়ন খরচে বরাদ্দ রাখা আছে ছয় লাখ টাকা। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার জন্য আছে ১০ লাখ টাকা।
প্রকল্পের সময় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ে এসব সম্মানির পরিমাণও। ‘প্রাণিসম্পদ উৎপাদন উপকরণ ও প্রাণিজাত খাদ্যের মান নিয়ন্ত্রণ গবেষণাগার স্থাপন’ প্রকল্পের প্রথম সংশোধনী আনা হয় একনেকের ওই সভায়। সংশোধনীর আগে এতে ‘সম্মানি, ফি ও পারিতোষিক’ বাবদ থোক বরাদ্দ ছিল ১০ লাখ টাকা। সংশোধনীর পর তা বাড়িয়ে করা হয়েছে ২০ লাখ টাকা। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে প্রাণিসম্পদ অধিদফতর এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে।
‘পোল্ট্রি গবেষণা ও উন্নয়ন জোরদারকরণ’ প্রকল্পে ২৫ লাখ, ‘খুলনা ৩৩০ মেগাওয়াট ডুয়েল ফুয়েল কম্বাইন্ড সাইকেল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ (প্রথম সংশোধন)’ প্রকল্পে ২৬ লাখ ৮৮ হাজার (বিজ্ঞাপন, মিটিং ও অন্যান্য খাত), ‘কুমিল্লা-চাঁদপুর-ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা সেচ এলাকা উন্নয়ন’ প্রকল্পে সম্মানি ২৫ লাখ এবং ‘পোল্ট্রি গবেষণা ও উন্নয়ন জোরদারকরণ’ প্রকল্পে ২৫ লাখ টাকা কর্মকর্তাদের মাঝে সম্মানি ভাতা হিসেবে বিলি করা হবে।
আরও পড়ুন >> জাপানি হাতেই ফের কেরামতি
দেশে বর্তমানে এক হাজার ৮০০ এর বেশি প্রকল্প চলমান।
যেভাবে সম্মানির প্রচলন
কোনো সভায় যোগ দেয়ার ক্ষেত্রে সরকারি কর্মকর্তাদের অনীহা থেকে উদ্ভব হয় সম্মানি ভাতার প্রচলন। এ প্রসঙ্গে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই সচিব বলেন, ‘প্রজেক্ট স্টিয়ারিং কমিটি আছে; আছে পরিকল্পনা কমিশন, অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি), বাস্তবায়ন পরীবিক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি)। তাদের সভা হয়। আগে সভা ডাকলেই দেখা যেত, লোকজন আসে না। সভা হয় ওই সচিবালয়ে, ওরা থাকে এদিকে (শেরেবাংলা নগর)। যে অফিসারদের সভায় পাঠানোর কথা বলা হতো, তারা ছিল জুনিয়র। ওদের তো গাড়ি নেই। টাকা খরচ করে গাড়ি ভাড়া দিয়ে ওরা সভায় যোগ দিতে চাইত না। এটা অনেক আগের কথা বলতেছি।’
‘সরকার এখন বলছে যে, প্রত্যেকটা প্রজেক্টে টাকা রাখ, যেন ওরা আসে। তারপর থেকে চার থেকে পাঁচ হাজার টাকা সম্মানি হিসেবে রাখা হয়। এর মধ্যে দুই হাজার টাকা খরচ করে ওরা যায়, তিন হাজার টাকা ওরা নিয়ে আসে।’
আরও পড়ুন >> বাংলাদেশ আর অনুদান নির্ভরশীল নয়, চুক্তিতে পরিবর্তন চায় ইইউ
সম্মানি হিসেবে টাকা দেয়া শুরুর পর চিত্র পুরো উল্টে যায়- বলেন ওই সচিব। ‘এখন হয়ে গেছে কী জানেন? ডাকা হয় যদি সিনিয়র (জ্যেষ্ঠ) সচিব, দেখা যায় যুগ্ম সচিব এসে বসে আছে। যুগ্ম সচিব এসে বলল, আসসালামু আলাইকুম স্যার। আমি বলি, কী খবর, কেমন আছেন? বলে যে, আপনি একটা মিটিং ডাকছেন। আমি বলি যে, মিটিংয়ে আপনি আসছেন নাকি? সে বলে, আমিই আসলাম। দেখলাম একটা জরুরি মিটিং। আমারই যাওয়া উচিত। এহন আমি এ কথা লজ্জা করে ক্যামনে বলি…!’
কোনো কোনো সভায় মেলে ৫০ হাজার
আলাপের একপর্যায়ে ওই সচিব জানান, তিনি একটি কমিটির সদস্য ছিলেন। সম্মানি ভাতা নিয়ে তিনি একটা প্রস্তাব দিয়েছিলেন। এরপর সেই কমিটিতে আর থাকতে পারেননি তিনি।
সচিব বলেন, ‘এক সভায় একটা কথা বলছিলাম, হাইয়ার অথরিটিকে (সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ)। বলেছিলাম, স্যার এত টাকা দেয়ার কি দরকার আছে? পাঁচ হাজার টাকা দেয়া কি ঠিক হবে, দুই হাজার করা যায় না? এরপর থেকে আমাকে আর ডাকে না। পরে আমার (সচিবের) পরিবর্তে অতিরিক্ত সচিবকে ওই কমিটির মেম্বার বানাইছে। হে হে হে।’
কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে সভা করলে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত দেয়া হয় বলেও জানান এ সচিব। বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা কমিটির মেম্বার ছিলাম। ওইখানে গেলেই সাড়ে সাত হাজার টাকা দিত। ওটা ওদের স্ট্যান্ডার্ড। আবার একটা বিশ্ববিদ্যালয় আছে, সেটার নাম বলব না। সেখানে গেলে ৫০ হাজার টাকা দেয়। কিন্তু আমি নেইনি। তাদের কথা হচ্ছে, সিন্ডিকেট মিটিংয়ে যাব, এটা কোনো কথা হলো নাকি? কত হুমকি, কত কিছু, তার মধ্যে সিদ্ধান্ত নিতে হয়। তারপরও আমরা সারাদিন অফিস করে রাত সাড়ে ৯টা পর্যন্ত মিটিং করি, এই সাড়ে সাত হাজার টাকা পোষায় না-কি?’
‘সমস্যা আছে-রে ভাই, নানা রকম সমস্যা আছে’- যোগ করেন ওই সচিব। অধীনস্থ সচিবালয়ে এমন খরচ প্রসঙ্গে তিনি জানান, এগুলো লাগামহীন খরচ, নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করবেন।
যেভাবে সম্ভব হচ্ছে এমন খরচ
গত ২২ জুন জাতীয় প্রেস ক্লাবে বাজেট বিষয়ে এক গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)। সেখানে সরকারের উন্নয়ন প্রকল্পের এমন বাড়তি খরচের বিষয়ে কথা বলেন তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির আহ্বায়ক ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ।
আরও পড়ুন >> এক ভুলে গচ্চা ৩০০ কোটি!
তিনি বলেন, ‘আমরা তো অনেকগুলো রেকর্ড করেছি। তার মধ্যে একটা বড় রেকর্ড হচ্ছে, সবচেয়ে ব্যয়বহুল সেতু। সবচেয়ে ব্যয়বহুল সড়ক, মহাসড়ক। সবচেয়ে ব্যয়বহুল ভবন। দুই থেকে তিনগুণ বেশি ব্যয়ে এটা কীভাবে সম্ভব হচ্ছে? ভারতের চেয়ে বেশি, চীনের চেয়ে বেশি, এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চেয়েও বেশি ব্যয় করা হচ্ছে প্রকল্পগুলোয়। এই বেশি খরচ হতে পারছে, এর একমাত্র কারণ হলো যারা এটার সুবিধাভোগী, তারা প্রকল্প ব্যয়টা নির্ধারণ করছে।’
আনু মুহাম্মদ বলেন, ‘যারা প্রকল্প ব্যয় নির্ধারণ করেন, যারা এটার সুবিধাভোগী– দুজন যদি একই ব্যক্তি হয় বা একই গোষ্ঠী হয়, তাহলে এগুলোতে কোনো জবাবদিহির জায়গা থাকে না। ফলে তাদের প্রয়োজন অনুযায়ী, তাদের আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী, তারা ক্রমাগত ব্যয় বাড়াতে থাকে। আট টাকার কাজ ১০ টাকা দিয়ে হয়। সেটা আমরা প্রত্যেকটা প্রকল্পের ক্ষেত্রে দেখি।’
পিডি/এমএআর/এমএস